Best Modern Online Bangla Galpo | Shabdodweep Story

Sharing Is Caring:

Modern Online Bangla Galpo | Collection of Bengali Stories

প্রুফরিডার

নকুল মণ্ডল, একজন মানুষ। কিন্তু নিজেকে সে কখনও মানুষ বলে কেন জানি ভাবতে পরে না। গ্রামে তার মত একজনের কোন কাজ নেই, বাপকেলে জমিজমাও কিছু নেই। শুধু কাকার দক্ষিণ্যে পাওয়া এক চিলতে বসত বাটি নিয়ে স্বামী স্ত্রী আর দুই মেয়েকে নিয়ে ছিল তার সংসার। বেশ কয়েক বছর হল সে শহরতলির একটা বাসা জোগাড় করেছে। মেয়ে দুজনের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল তার শ্বশুর মহাশয়, এই বাজারে তাই রক্ষে। ইদানিং সে একটা কাজ পেয়েছে বলা যাবে না, ধরেছে বললে বোধ হয় ঠিক হয়।

সেই সত্তরের দশকের মাঝামাঝি, পড়াশুনো তেমন ভাবে করা যায়নি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও গ্র্যাজুয়েট হওয়ার সাধ পূরণ হয়নি তার। অথচ ছাত্র হিসেবে যে খারাপ তাও বলা যাবে না। আর বর্তমানের সিলেবাস অনুযায়ী পাশ – ফেল প্রথার বিলুপ্তি তখন ঘটে নি। ভাগ্যের ফেরে ডিগ্রী খানা আটকে গেল। গ্রামে থাকতে কোন কাপড়ের দোকান, কোন চালের আড়তে কাজ করে দিন চলত। তবে নকুল পড়াশুনোর চর্চায় ছিল, যদি কোন চাকরি একটা জোটানো যায় এই আশায়। কলকাতায় প্রকাশনার কাজ সারা বছর লেগেই থাকে। কোন এক শুভানুধ্যায়ী তাকে কয়েকটা প্রকাশনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছে পাণ্ডুলিপি দেখার কাজের জন্য। তেমন কিছু ইনকাম এর থেকে হয় না, তবু কোন উপায় ছিল না তার এই কাজটি ছেড়ে দেওয়ার। আগে লিখিয়েদের ছিল হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি, এখনও আছে তবে বেশিরভাগ প্রিন্টেড পাণ্ডুলিপি তৈরি করতে ওস্তাদ। আবার অনেকেই পিডিএফ ফরম্যাটে প্রকাশকের হাতে দিয়ে দেয় দ্রুত প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য। সেক্ষেত্রে নকুলের কাজের পরিধি কম।তবুও সে এই উত্তর পঞ্চাশে কলকাতায় ঘুরে ঘুরে পাণ্ডুলিপি সংগ্রহ করে দু মুঠো অন্ন সংস্থানের জন্য। যদিও বেশিরভাগ লেখক তাঁদের পাণ্ডুলিপির ডিটিপি নিজেরাই দেখে, অনেকে অভিজ্ঞ পাণ্ডুলিপি দেখিয়েদের কাছে দেখতে দেয়।

কাজ সে করে খুব নিষ্ঠা ভরে। তবে সময়ে কেউ তার পারিশ্রমিক দেয় না। প্রকাশক বই প্রকাশ করে বাজারে ছাড়ছে। লেখক মোড়ক উন্মোচন করছেন, কিন্তু নকুল বাবুর পকেটে একটা পয়সা আসছে না। যা পায় তাও আবার কিস্তিতে কিস্তিতে। অথচ দ্রুত বই প্রকাশের তাড়া থাকে লেখক ও প্রকাশকের,উভয় তরফের। নকুল মণ্ডল ভাবে, কী এক অদ্ভুত জীবিকা সে নিয়েছে! না আছে কোন বাঁধা ইনকাম, না আছে তার কোন নির্দিষ্ট পরিমাণ। কোন মাসে পকেটে কিছু এল, কোন মাসে ফাঁকা। দুজনের সংসার তাই টেনেটুনে চলে যাচ্ছে। বছর পাঁচেক হল, তার এই ‘লাইনে’ আসা। এরই মধ্যে প্রযুক্তি থাবা বসিয়েছে বিশাল। আর প্রযুক্তির সঙ্গে সড়গড় হতে এখন কী রকম নাকানি চোবানি! যে কোন প্রকারে মাটির ওপর দাঁড়াতে পেরেছে প্রতিযোগিতার বাজারে।

একদিন এক প্রকাশক মহাশয় নকুলকে পাঠাল এক নামি লেখকের ঠিকানায়। খুঁজে খুঁজে ধরতে বেশ দুপুর হয়ে গেল। লেখক দুপুরের আহার অন্তে বিশ্রামে যাওয়ার মুহূর্তে বেল বাজিয়ে দিয়েছে নকুল মণ্ডল। অচেনা লোককে দেখে প্রথমে অবাক হলেও শেষে সব শুনে বসতে বললেন। ‘আপনি কী আগের প্রিন্টেড পাণ্ডুলিপিটি দেখেছেন।’ – লেখকের প্রশ্নের উত্তরে মাথা নাড়ল নকুল। ‘ভালই তো দেখেছেন ও নিখুঁত সংশোধন করেছেন। কত দিন এই কাজ করছেন?’ নকুল বলে, – ‘বছর পাঁচেক হবে।’ একটু আনমনা হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, – ‘আপনি আমার পাণ্ডুলিপির দ্বিতীয় পাতার তৃতীয় অনুচ্ছেদের বাক্যগুলো পরিবর্তন করলেন কেন!’ নকুল খুব মুশকিলে পড়ে গেল। কী উত্তর দেবে সে, এই বিখ্যাত লেখকের প্রশ্নের উত্তরে। খুব দৃঢ়তার সঙ্গে বলে সে,- ‘মনে হল ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত আর চরিত্রের স্বভাব অনুযায়ী ওই রকম কথোপকথন হওয়ার প্রয়োজন।’ লেখক মাথাটা কয়েকবার সামনে ঝাঁকিয়ে বললেন, ‘আপনি ঠিকই করেছেন। আরও যদি কিছু অসঙ্গতি থাকে তো ফাইনাল প্রুফ সেরে দেবেন।’ একথা বলে দুশো টাকা নকুলের পারিশ্রমিক বাবদ দিয়ে পাণ্ডুলিপির ফাইলটা ফেরত দিলেন। প্রকাশকের কাছে এসে সব কিছু বলে পাণ্ডুলিপিটা ফেরত দিলেন এবং ফাইনাল কতদিন নাগাদ দেখে দিতে হবে তা জিজ্ঞেস করল। সপ্তাহ খানেক পর আসতে হবে, এই কথা শুনে নকুল বের হয়ে গেল, অন্য প্রকাশকের কাছে যাওয়ার জন্য। সন্ধের আগে তার ব্যাগ ভর্তি পাণ্ডুলিপি নিয়ে বাড়ি ফিরল। এখন এক সপ্তাহের কাজ তার ওই পুরোনো দিনের কাঁধে ঝোলা সাইড ব্যাগে।

আজকে আবার অন্য এক মাঝারি মাপের উঠতি লেখকের বাড়িতে গিয়ে অবাক সে। এই লেখকের লেখার বিষয় আর তাঁর লাইফ স্টাইল তো এক নয়! নকুল কে দ্বিতীয় বারের জন্য পাণ্ডুলিপি ধরিয়ে বললেন, ‘কী বুঝছেন নকুল বাবু পাণ্ডুলিপি দেখে, সরকারের থেকে প্রাইজ আশা করা যায়! ‘ নকুল মণ্ডল কে এখানে বসতে দেওয়া হয়েছে চেয়ারে। একটু মাথা চুলকে সে উত্তর দেয়। ‘আপনার লেখায় এত যুক্তাক্ষর ব্যবহার করেছেন যা কিনা এখনকার ছেলেমেয়েরা একটু মুশকিলে পড়ে যাবে, কারণ ওরা যুক্ত অক্ষরের প্যাঁচ ঠিক বোঝে না। এখনকার সরকারি বইগুলো দেখেছেন যুক্ত অক্ষর ভেঙে অদ্ভুত বানানের সৃষ্টি করছে। ফলত ওরা পড়তে গিয়ে একটু হোঁচট খেতে পারে। ‘ লেখকের স্পষ্ট উত্তর, ‘আপনি মশাই যে কাজটি করছেন করুন, এত ভাবতে আপনার হবে না।’ নকুল মণ্ডল নিরুত্তর থাকে, পাণ্ডুলিপি নিয়ে সে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেল।

বাসায় ফিরে কাজ নিয়ে বসে নিত্য দিনের মত। ভাবে, সে তো আদা ব্যাপারী, জাহাজের খবর নেওয়া তার কী সাজে! তবুও মনটা খুঁত খুঁত করে, অনেক কিছু এসে মাথায় ঢোকে। সেদিন কোন এক পরিচিত বলছিল কোন এক প্রসঙ্গে। ক্লাস নাইনের ছাত্র নাকি নিজের নাম ঠিক করে লিখতে পারে না। আবার সে স্পষ্ট জানে, তার এক আত্মীয়র ছেলে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে পড়ে। বাংলা অক্ষর শেখেনি, তাই বাংলা বলতে পারলেও বাংলা বই পড়তে পারে না। বিষয়টি নিয়ে মা বাবার কোন চিন্তা নেই।

নকুল বাবু ভাবছে – তাহলে আরও দশ কুড়ি বছর পরে আমাদের বাংলা ভাষার বিখ্যাত উপন্যাস, গল্প, কবিতা কারা পড়বে। আবার যাদের পড়ার ইচ্ছা হবে তারা যুক্তাক্ষর শব্দ গুলো নিয়ে ধন্দে পড়ে যাবে না তো! এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে রাতের খাবার খাওয়ার সময় হয়ে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে লোডশেডিং। রোজ এই কাণ্ডটি হচ্ছে প্রায় এক সপ্তাহ ধরে। কিন্তু তার ভাবনার লোডশেডিং হয় না। তার মনে হল বাংলা ভাষাকে সম্প্রতি ধ্রুপদী ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার মনে হয় আমাদের সুললিত বাংলা ভাষা তো ধ্রুপদী ছিল, এখন হয়তো ওই উচ্চতা ধরে রাখতে পারছে না। বাতি জ্বেলে খেতে বসে স্বামী স্ত্রী। তার আসল প্রুফ দেখার কাজ হচ্ছে না, পিছিয়ে পড়তে হচ্ছে খুব।

পরের দিন এক প্রকাশকের কাছে কয়েকটা পাণ্ডুলিপি জমা করে নতুন দুটি নিয়ে এলেন বাসায়। এই প্রকাশক মশাই একটু বোঝেন নকুল বাবুর টাকার প্রয়োজন। তিনি ধার বাকি না রেখে কাজের হিসেবে মত পেমেন্ট দিয়ে দেন। তাই নকুল বাবু এই প্রকাশনার কাজ ফেলে রাখে না। আজকের দুটো পাণ্ডুলিপি নিয়ে তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে দেখেন বাড়ি ওয়ালা অর্থাৎ মালিক গত মাসের ভাড়ার জন্য হাজির। ভাগ্যিস আজকের নিখিল বাবু (প্রকাশক) পারিশ্রমিক দিয়েছিলেন!

আজকাল ভিড় ট্রেনে আসতে যেতে খুব কষ্ট হয়। তাই একটু বিশ্রাম নিয়ে নতুন হাতে লেখা পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসলেন। রাত্রে কাজ করতে চোখে এখন খুব বাধে। ডাক্তার তো কবেই বলেছিলেন ক্যাটারাক্ট ক্রমশ বাড়ছে। সে যাই হোক পাণ্ডুলিপি খুলে একটা পাতা দেখে নকুল মণ্ডল তাজ্জব! এত বানান ভুল! কোন এক মাস্টার মশাই ইতিহাসের বই লিখছেন, স্কুলের সিলেবাসে ধরাবেন। এত দিনে নকুল বাবু বুঝেছেন কাজটি খুব ধৈর্যের। খুব মন দিয়ে মেজাজ না হারিয়ে করতে হয়। এখন তিনি বুঝলেন, ডি টি পি না করে প্রকাশক মশাই তাকে কেন পাণ্ডুলিপিটি ধরালেন। ঠিক পাঁচদিনের মাথায় নকুল মণ্ডল মাস্টারমশাই এর পাণ্ডুলিপির সংশোধন করে গেলেন প্রকাশকের কাছে। ওদিকে সেই মাস্টার মশাইও গিয়েছেন খোঁজ নিতে, তাঁর প্রস্তাবিত ইতিহাস পুস্তকের। প্রকাশক নকুল বাবুর সামনে বসালেন মাস্টারমশাইকে।

ভাবী ইতিহাস লেখক তাঁর পাণ্ডুলিপির কাটাকুটির অবস্থা দেখে হতবাক। নকুল বাবুকে প্রশ্ন করলেন, কী করেন মশাই। বানান সম্পর্কে এত ব্যাকরণ জানলেন কোথায়! আপনি হয়তো জানেন না ইতিহাস বিষয়ে আমরা শিক্ষকরা বানান নিয়ে তেমন মাথা ঘামাই না। নকুল বাবু কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। শেষে উত্তর দেয়,’ মাস্টারমশাই, বিষয়টি পরীক্ষার খাতায় চলে, মুদ্রিত পুস্তকে নয় কিন্তু। মাস্টার মশাইয়ের উত্তর দেওয়ার আগে প্রকাশন সংস্থার মালিক পাণ্ডুলিপিটি নিয়ে ডি টি পি সেকশনে দিয়ে দিলেন।

এক সপ্তাহ পরের এক রবিবারের দিন। নকুল বাবুর ছুটি আজ, প্রকাশনা সংস্থা রবিবার বন্ধ থাকে। একটা বইয়ের প্রুফ দেখতে দেখতে বিশ্রামের ফাঁকে খবরের কাগজের প্রথম পাতায় চোখ গেল। দেখল সেই বিখ্যাত লেখকের বাড়িতে যে বইটির পাণ্ডুলিপি আনতে গিয়ে প্রশ্নের মুখে পড়েছিলেন, সেই বইটি পুরস্কারে ভূষিত। আর কৌতূহল বশত খবরের মধ্যে বইয়ের যে অংশের উদ্ধৃতি করা হয়েছে, সেখানে নকুল মণ্ডলের চোখ গেল আটকে। তার সেই সংশোধিত অংশটি উদ্ধরণ চিহ্নিত। বিশাল অনুষ্ঠান করে লেখক পুরস্কৃত হয়েছেন, অনেক গণ্যমান্য অতিথির উপস্থিতিতে।

নকুল মণ্ডল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল। ভাবল, একটা নিমন্ত্রণের কার্ড তার কী প্রাপ্য ছিল না! স্ত্রী সান্ত্বনা দিয়ে বলে, – কত বড় বড় বই বের হচ্ছে, তোমাদের কথা কে মনে রাখে বল! তোমরা পর্দার পিছনের মানুষ, অন্তরালের অন্ধকারে চিরকাল।

শিউলি ফুলের গাছ

শহরতলির ছাদে ছাদে আর গলিতে গলিতে আলোকমলা আর নানান বাজি ফাটা শুরু হয়ে গেল। এখনও দীপাবলির তিন দিন বাকি। যেদিন শ্যামা কালী পুজো সেদিনই দীপাবলি। খোকন হালদার বছর দশেক আগে গ্রাম ছেড়ে শহরতলির বাসিন্দা। সুখের আশায় গ্রাম ছেড়ে আসা তা পূরণ হল কই! পূরণ হোক আর নাই হোক, দীপাবলির রাতটা কিভাবে পার করবে সেই চিন্তা মাথার মধ্যে অনবরত পাক খাচ্ছে। গত বছরের অভিজ্ঞতা মনে পড়লে বুকের মধ্যে ধুক-পুকুনি শুরু হয়ে যায়। ভাবতে ভাবতে একটা সূত্র পাওয়া গেল। শ্যামা কালী পুজোর দিন যদি গ্রামের পুরোনো বাড়িতে যাওয়া যায়, কেমন হয়! গৃহিণী জানে গত বছরের আতঙ্ক আর উদ্বেগ। সেই সন্ধে থেকে শুরু হল শব্দ অসুরের দাপাদাপি। চৈনিক কারিগরের দক্ষতায় ঘরে ঘরে আলোর বন্যা। আলো আর শব্দের লাগামহীন উৎপাতে যার কিছু হোক বা না হোক খোকন বাবুর অবস্থা ভাবলে আঁতকে উঠতে হয়। নির্ঘুম সারা রাত তার বিড়ালটি কোলে করে নিয়ে কেটেছে।

হাঁপানির রোগী, শব্দ হলেই প্রতিক্রিয়া তার ওপর ধোঁয়া আর বারুদের গন্ধ। বন্ধ জানালার ফাঁক দিয়ে ধোঁয়ার উপস্থিতি। হাত জোড় করে অনুরোধ করলেও কেউ কর্ণপাত করেনি। পাড়া বে পাড়ার নাবালক থেকে ধাড়ি,সবাই শব্দ বাজি আর বিচিত্র বাহারি চোখ মুখ জ্বালা করা রঙিন ধোঁয়া উদ্রেককারী বাজিতে আগুন দিচ্ছে। মনে হচ্ছে ‘গাজা ভূখণ্ড’ আক্রান্ত হয়েছে শত্রু বাহিনীর হাতে। মিনিট মিনিটে চারিদিক থেকে শব্দের ঢেউ ঘরের দরজা জানালায় আছড়ে পড়ছে। শেষ রাতে ‘যুদ্ধ বিরতি’। তখন সংলগ্ন বাতাস হয়ে গেছে ভারী। ধোঁয়ার চাদর মুড়ি দিয়ে মানুষ হাঁপাচ্ছে। চেষ্টা করেও পুজোর আগের দিন খোকন তার গ্রামের বাড়িতে যেতে না পারলেও, পুজোর দিন দুপুরে বাড়িতে হাজির একা। বাড়িতে সবাই এই একাকীত্বের কারণ জানতে চাইলেও উত্তর দিতে পারেনি সে। শহর জীবনে প্রাচুর্য থাকলেও প্রশান্তি নেই, এই কথাটি সে বোঝাতে পারল না। মূল সড়ক থেকে গ্রামের সেই চেনা পথ দিয়ে সে আসছিল, ঠিক দুপুরে। পথ ঘাট, বাড়ি ঘর সব যেন নতুন নতুন। আসলে গ্রামের ভূগোল গেছে বদলে। তবুও সে গ্রাম এখনও ছায়াময়, মায়াময়, ভালোবাসার ঠিকানা। উত্তর ষাটের খোকন হালদার চেনা মুখ দেখে কথা বলে, তখন যেন সেই বাল্যের দিনগুলো এসে হাজির হয়। সেই সব প্রাণচঞ্চল মুখগুলো আজ বয়সের ভারে মলিন, তবুও হাসি মুখে কুশল বিনিময় ক্লান্ত দুপুরে বাড়তি প্রাপ্তি।

তাদের পুকুর পাড়ের পাশ দিয়ে, বাঁশ ঝাড় ডাইনে রেখে, কাঁঠাল গাছের নিচ দিয়ে এসে স্নানের ঘাট। ঘাটের পাশে চালতা আর বাতাবি লেবুর গাছ। কী সুন্দর হলুদ বর্ণের লেবু ঝুলছে গাছের ডালে। সে তো লেবু নয়, পৃথিবী ঝুলছে মহাকাশে। এই ক্লান্ত দুপুরে মা বারান্দায় বসে কাঁথা বুনতো। খোকনকে দেখা পেয়ে কী ব্যস্ত হত, আনন্দে যেন মায়ের দুটো ডানা গজাত। খোকনের দু চোখ তখন ব্যস্ত চারিধারে, কী ছিল কী হল এবং কী হবে। আজ তার মাতৃহীন জন্মভূমির ভিটে। শুধু মায়ের হাতে পোঁতা শিউলি গাছটা বেশ বড় হয়েছে। দেখলে দুচোখ জুড়িয়ে যায়।

শহরতলির ব্যস্ততা এখানে নেই। শরৎ পার করে হেমন্তে সেজেছে তার গ্রাম। চির কালের অভ্যাস মত বিকেলে চেনা মাঠের দিকে গিয়ে বুকের ভিতর থেকে বেরিয়ে এল, – “একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী “। সামনে আদিগন্ত শস্যবতী ধানখেত। আসন্ন গোধূলি। দিনের শেষ আলোর আভা কে যেন বিছিয়ে দিয়েছে সারা মাঠ জুড়ে। কৃষকের পরিশ্রম সফল হয়েছে আজ হেমন্তের দিনে। আসন্ন নবান্নের দিন, কৃষাণীর স্বপ্ন পূরণ হবে। ক্ষণিকেই খোকন হালদার গ্রামের জীবনে সম্পৃক্ত হয়ে গেল। সমস্ত প্রকৃতি যেন তাকে আবাহন করে নিতে চায় আজিকার গোধূলি লগনে। আজ সে অভিভূত!

সাঁঝের প্রদীপ জ্বালানোর আগে সে ঘরে ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু অমাবস্যার আলো আঁধারি তাকে যেন নিশ্চল করে দিয়েছে। হালকা উত্তুরে বাতাস, আকাশের বুক চিরে সীমিত সংখ্যক তারা জ্বলে উঠেছে। পাখির কলতান বন্ধ হল সবেমাত্র। ক্ষণিকের জন্য জীবন ও জগৎ থেকে সে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। হঠাৎ দূর থেকে ভাইয়ের ডাক। ডাক শুনে তার সম্বিৎ ফেরে। অনেকদিন আগের কথা মনে পড়ে। সন্ধে পার করে চলত তাদের আড্ডা, ফাল্গুন মাসের জোছনায় ওই খটখটে শুকনো ধানজমির ঘাসের উপর বসে। তখন বাবা ডাকত, দূর থেকে গম্ভীর আওয়াজে। তাদের সেই বিদ্যুৎ হীন গ্রাম এখন আলো ঝলমল। ব্যস্ত সবাই বাড়ির, আজ যে পুজো অন্ধকারের কল্পিত দেবী শ্যামা কালীর। দক্ষিণ পাড়ায় গ্রামের সর্বজনীন পুজোর মাইক বাজে। সেখানেও পুজোর তোড়জোড়। কত স্মৃতি ভিড় করে আসে খোকনের মাথার ভিতর। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরোনো তাদের গ্রামের এই পুজো। ছোটবেলায় কত উন্মাদনা এই পুজো নিয়ে। সে এক অন্য আঙ্গিকের পুজো আর অনুষ্ঠান। এখন সে সব অনুষ্ঠান হয়না। ছিল না কোন শব্দের তাণ্ডব, আলোর চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনী। অনেকদিন পর মনে হয় আজ রাত তার কাছে হবে শব্দহীন, উদ্বেগ আর আতঙ্কহীন।

ভোরের আলো ফোটার আগে ঘুম ভেঙে গেল খোকন বাবুর। ঘরের বাইরে বেরিয়ে আসতেই শিউলি ফুলের সুবাস, হৃদয় গেল ভরে। হিম ছোঁয়া বাতাস সঙ্গে শিউলি ফুলের টাটকা সৌরভ, যেন এক অন্য পৃথিবী। আস্তে আস্তে সে গিয়ে দাঁড়ালো মায়ের সেই শিউলি গাছের নিচে। সেদিনের সেই ছোট চারা গাছটি আজ পল্লবে, কুঁড়িতে গেছে ভরে। শাখা প্রশাখায় সে এক উন্নত শির নিয়ে দাঁড়িয়ে মায়ের তুলসী মঞ্চের ঠিক পাশে। তার মনে হল সে যেন তার মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মা ভোর বেলা উঠে সতেজ ফুলগুলো দূর্বা ঘাসের উপর থেকে কুড়িয়ে সাজিতে রাখত। আজও শিশির ভেজা ফুল গুলো কী সুন্দর ঝরে পড়ছে টুপ টুপ করে গাছের সমস্ত শাখা থেকে। প্রকৃতির এক অদ্ভুত দৃশ্য এই প্রথম খোকন হালদারের কাছে। হেমন্তের ভোর ক্রমশ ফিকে হয়ে আসে। গাছের চারিধারে শিউলির গন্ধ, মধ্য রাতে কুঁড়ি থেকে জন্মানো ফুল গুলো শেষ রাত থেকে ঝরে পড়ে মাটির পৃথিবীতে। ক্ষণ জন্ম নিয়ে যে এল, সে তো মানুষের বুক ভরে দিয়ে গেল অনেক সুবাস। হঠাৎ শ্বেত বসনা কে যেন ফুল কুড়ুচ্ছে, মায়ের মতন। তার বৌদি জিজ্ঞেস করে, – ঠাকুরপো তুমি এই ভোরবেলা গাছ তলায় দাঁড়িয়ে কেন, ঠান্ডা লেগে যাবে যে!

খোকন হালদার কিছুক্ষণ নিরুত্তর, সে হয়তো অন্য এক জগতে পৌঁছে গেছে। যেখানে নেই কোন শব্দের উৎপাত, অসংস্কৃত মানুষের দল, দূষণ দুষ্ট আবহাওয়া। তারপর সে উত্তর দিল, – মায়ের হাতে পোঁতা গাছ কত বড় হল দেখ। মাও তোমার মত ফুল কুড়িয়ে সাজি ভরত ভোর বেলা। মা হয়তো আজ শিউলি গাছ হয়ে গেছে। তুমি শ্বেত বসনা আমাদের মা হয়ে গেছ। তখন সাজি ভরা শিউলি ফুল হাতে বৌদি তার সামনে নির্বাক দাঁড়িয়ে সজল চোখে। অমাবস্যার রাত শেষ হয়ে তখন আলো ফোটার অপেক্ষায়।

কালো হরিণী চোখ

সুরেশ, সীমান্তকে নিয়ে যখন চণ্ডীপুর থানায় ঢুকলো, তখন বিকেল তিনটে। ভাড়াবাড়িতে থানা। কেমন আগোছালো ভাব। মানুষ গুলোও। ঠিক থানা বলে তো মনে হয় না। কিন্তু ওদের তাতে কী যায় আসে! ডিউটি সম্পাদন মূল বিষয়। এক অস্বাভাবিক মৃত্যু সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এখানে আসা। কজন স্কুলের ছাত্রী এক কনস্টেবল কে প্রণাম করে, কোন অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ লিপি দিচ্ছিল। ওই ভদ্রলোক থানার খেলাধুলোর বিষয়টা দেখেন। সবে মাঘ মাস পড়েছে। এ বছর শীত ভালোই বিছানা মেলেছে। তাই গৃহস্থের ছাদে, রেলিঙে, উঠোনে বিকেলের রোদ পোহাচ্ছে লেপ, কাঁথা, বালাপোষ ইত্যাদি ইত্যাদি। আসার পথে হাওয়ার ঝাপটায় রীতিমত কাঁপ দিচ্ছিল।

বড়বাবু নেই, কোথাও কাজে বেরিয়েছেন। মেজ বাবু খেতে গেছেন। আমরা যতই খবর নিতে বলি, ততই কনস্টেবল ভদ্রলোক, গল্পের জাল বিস্তার করেন। পুলিশের অসহায়তার হাজার কাসুন্দি। কোনো এক শাশুড়ি বৌমার গল্প। পাড়ার পারিবারিক কোন্দলের জেরে, শাশুড়ি বৌমা যুগলে থানায় এসেছে অভিযোগ করতে। আবেদন পত্র লেখার শেষে শাশুড়ির দস্তখতের প্রশংসা করেছিলেন মেজবাবু। এই প্রশংসায় বৌমার হোল গোঁসা, তিনি শুনিয়ে দিলেন, – আমিও সই করতে পারি! একটা সাদা কাগজ দিয়ে নমুনা দেখতে চাইলেন ওই অফিসার। শেষে আবার যখন শাশুড়ির হাতের লেখার প্রশংসা, তখন উল্টো বিপত্তি। শাশুড়ির প্রশংসায় বৌমার পিত্তি জ্বলে এবং শাশুড়ির বিরুদ্ধে অন্য এক অভিযোগ জমা দিয়ে উভয়ের দ্রুত প্রস্থান। ইতোমধ্যে মেজবাবুর প্রবেশ ঘটেছে। তিনি ঝগড়া প্রিয় বৌমার চিরকুটে লেখা দস্তখত দেখিয়ে ছাড়লেন। একটা কাগজে লেখা, ‘ময়নামতি সামন্ত’ । খুব কষ্ট করে পাঠোদ্ধার করা গেল। তারপর যে ঘটনার নেপথ্য রহস্য সন্ধানে ওরা এসেছে তার কুড়টা ধরিয়ে দিলেন মেজোবাবু।

শশীকান্ত দাস, একজন অবসরপ্রাপ্ত সরকারি আধিকারিক। বীথিকা, কণিকা আর মালবিকা, তিন মেয়ে ও স্বামী স্ত্রীর সংসারে আপাত কোন অভাব ছিল না। শিক্ষিত এবং শালীন পরিবার। প্রথম ও তৃতীয় মেয়ের বিবাহ সম্পন্ন, পাড়া পড়শিদের কাছে ভদ্র পরিবার। অকস্মাৎ বাড়ির মেজো মেয়ের মৃত্যু, সংসারটা বিধ্বস্ত করে দিয়ে গেল! মেয়েটি প্রাইমারি স্কুলের একজন প্রিয় শিক্ষিকা। মাস দুই আগের এক সকালে শশী বাবুর এক পরিচিত বাসিন্দা এসে বলেন, – স্যার ওই বাড়ির মেজো মেয়ে খুব সকাল থেকে অস্বাভাবিক আচরণ করছে। কী করা যায় বলুন তো! – আমরা মশাই পুলিশের লোক, কোন অভিযোগ ছাড়া আগ বাড়িয়ে কিছু করতে পারি না। তবে ওনার শুভানুধ্যায়ী হিসেবে বলছেন যখন, বিকেলে একবার যেতে পারি। ভদ্রলোক চলে গেলেন। কিন্তু দুপুর দুটোর পর খবর এলো, ওই মেয়েটি স্বহস্তে অগ্নিদগ্ধ হয়ে তমলুক হাসপাতালে ভর্তি। আমার আর যাওয়া হল না, মনে হোল ভুল করলাম।

মেজোবাবুর পথ নির্দেশের সূত্র ধরে ওরা শশী বাবুর বাড়ির হদিস পেল। সংশ্লিষ্ট ব্লকের বিডিও অফিসের কাছাকাছি দু তলা সাজানো বাড়ি। দরজায় গিয়ে জিজ্ঞাসা করতে এক ভদ্রমহিলা ওদের প্রবেশাধিকার দিয়ে দরজা খুলে দিলেন। বোঝা গেল উনি শশী বাবুর স্ত্রী। বাড়িটি বড়ো রাস্তার খুব কাছেই। মেচেদা – দীঘার ব্যস্ততম রাস্তা। ঠিক শহরতলী নয়, গ্রামও নয়। প্রযুক্তিময় সভ্যতার এক অদ্ভুত নগরী। অতিথিদের মত করে বসার ব্যবস্থা করলেন, বারান্দায় নয় নিচের তলার একটা ঘরে। ভদ্রমহিলা অনেকটা শোক সামলে নিয়েছেন, কিন্তু শশী বাবুর আত্ম – যন্ত্রণা সীমাহীন। মেয়ের কথা বলতেই ঝর ঝর শ্রাবণের ধারায় চোখ ভাসছে। কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন ঘটনাটা।

‘মেয়েটা শেষ করলো নিজেকে, আমাকেও হয়তো ওই পথে বেছে নিতে হবে এই সত্তর উত্তর কালবেলায়! সরকারি আধিকারিক ছিলাম শিক্ষা দপ্তরে এবং অবসরের পরেও দপ্তরের প্রয়োজনে দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর কাজ করেছি। সুনাম ছাড়া দুর্নামের কোন ছায়া গ্রাস করেনি দীর্ঘ কর্মজীবনে। কিন্তু মেয়েটা দুর্নামের ভারী পাথর আমার বুকের উপর চাপিয়ে দিয়ে গেল।’ – একটানা বলে আবার কান্নার দমক!

তিনটি সন্তানই কন্যা। বড়োটি এম এ পাশ এবং হাই স্কুলের শিক্ষিকা ও বিবাহিতা। ওই ছিল মেজো। বিগত নয় বছর ধরে একটা প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। স্কুলে, পাড়ায়, পরিচিত পরিজনদের প্রিয়তমা। বাবা-মার আদরের স্নেহের কোন খামতি ছিল না। অসম্ভব উচ্চাশা আর প্রচণ্ড জেদ। গায়ের রংটা ছিল চাপা আর সেজন্য মানসিক একটা অস্বস্তি। এবং সেইটি শেষে কাল হোল তার বত্রিশ ছুঁই ছুঁই জীবনে। ছোট মেয়েটা বাগনানের একটা প্রাইমারি স্কুলে পড়ায়। বয়স হচ্ছিল, বাবা মা চাইছিল পাত্রস্থ করতে। বড়ো মেয়ে জামাই বেশি উৎসাহী ছিল তার বিয়ের ব্যাপারে। শশী বাবু একটু পিছনের যাপন চিত্রে গেলেন। সালটা হবে ২০০২, হঠাৎ একটা মানসিক অস্থিরতা। বলা যেতে পারে মানসিক অসংলগ্নতা । প্রথমে ভাবা হয়েছিল, সেরকম কিছু নয় হয়তো। কিন্তু বাবা মায়ের মন, তখন থেকেই নামী ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া শুরু। কখনও দিব্যি ভালো আবার কখনও অসংলগ্ন। বাড়িতে থাকলে বাড়ে অস্বস্তি। কর্মস্থলে প্রচণ্ড সিরিয়াস। যেন এক বিচিত্র ধাঁধা। শুভানুধ্যায়ীদের পরামর্শে ব্যাঙ্গালোর নিয়ে যাওয়া হোল সু চিকিৎসার জন্য। কিছুদিন স্বাভাবিক মানুষের মত, মনে হোল তাদের, সুদিন বুঝি এলো। কিন্তু না!

মাকে বললো, – মা চা খাবো। চা করে কাপ হাতে দিয়ে পিছন ফিরতেই, মায়ের পিঠে গরম চা ঢেলে দিয়ে সে প্রমাণ করলো তার বাতুলতা বিদ্যমান। – তোমরা আমাকে ভালোবাসো না, কেন আমি কালো বলে! তোমরা তোও কালো, তবে আমায় দেখতে পারো না কেন? … আমি বিয়ে করবো কলকাতায়, যে সে ছেলের সঙ্গে নয়। ফর্সা। তার কলকাতায় বাড়ি, গাড়ি থাকবে। ….. বাবা তো শিক্ষা দপ্তরে কাজ করে, তবে আমি কেন এমএ পাশ করে প্রাইমারি টিচার! হাই স্কুলে চাকরি আমার দিতেই হবে। – পাগল মেয়ের অসম্ভব আবদার। এভাবেই চলছিল এক বিচিত্র সংসার যাত্রা। সঙ্গে চলছিল চিকিৎসা এবং পাত্র দেখা। দশবার কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া হোল। মধ্যমানের অনেক ছেলে পাওয়া গেল, কিন্তু মেয়ের কোন পাত্রকে পছন্দ হল না। এখনও বাংলার সমাজ ব্যবস্থায় বিয়ের জন্য পাত্রী দেখানো, বিশেষ করে শ্যাম বা কৃষ্ণ বর্ণের, খুবই যন্ত্রণার ও বেদনাদায়ক। সব পছন্দ হল পাত্র পক্ষের। জাগল আশা, অন্ধকারের বুক ফেটে। শেষে জানায় ফোনে কথা হবে। এ বাংলায় ঘরে ঘরে আজও সেই মর্মস্পর্শী ছবি। প্রত্যেক সপ্তাহে, মেয়েকে সেজে বসতে হয়, পাত্র পক্ষের শকুন চোখের সামনে। কোনো মতে মন ভরাতে পারে না, অভাগী কালো মেয়েটা। যদিও তার গুণবতী স্বভাব – চরিত্র মরমী মায়াবী আলোয় উদ্ভাসিত! জগৎ ও জীবনকে সে ভালবাসে অন্য পাঁচটা মানুষের মত।

দিন দিন তার মানসিক এবং দৈহিক ভাঙন শুরু হয়। শুরু হয়েছে অনেকদিন আগে, বাবা – মার হৃদয়ের অপার অতল যন্ত্রণা। বাংলার সেই আবহমান বিবর্ণ চিত্র নাট্যের শেষ হল না কোনো দিন! কলকাতার ছেলেরা এত দূর আসতে পারে না। তাই তাদের ইচ্ছে অনুসারে বার পাঁচেক মেচেদাতে লজ ভাড়া করে, পাত্রী দেখানোর ব্যবস্থা করা হোল। ধন্য আশা কুহকিনী! সমস্ত প্রচেষ্টা বৃথা গেল, পাত্রীকে পাত্রস্থ করা সম্ভব হল না। কলকাতার এক খ্যাতনামা চিকিৎসকের পরামর্শে কাউন্সেলিং এর জন্য একটা নামী নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হোল। কিছুদিন আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে, সেই পুরনো চিত্রের করুণ পুনরাবৃত্তি।

২০১৪ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাস। সেই বীভৎস কালো রাক্ষুসে দিনটা এলো। সেদিনের কথা মনে পড়লে শশী বাবুর বুকটা, কালবৈশাখী ঝড়ের সময় শুকনো তালপাতার কাঁপনের মত করে কাঁপে। সেদিন সম্ভবত ওর স্কুল ছিল না। সবাই বাড়িতে। বেলা যত বাড়ে, বাঁধ ভাঙা বেপরোয়া অবস্থা হল মেয়ের। সবাই যেন বুঝতে পারলো, – বিপদের অশনি সংকেত। কেরোসিন ভেজা আপদ বস্ত্রের আগুন সহ, যখন সে নিচের ঘরে নামলো, সমস্ত আকাশ যেন ভেঙে পড়লো সাজানো ওদের বাড়িটার মাথায়। বাঁচার শেষ চেষ্টায় যত দৌড়াদৌড়ি করছিল, ততই আগুনের লেলিহান শিখা তার সারা শরীরে ছোবল বসিয়ে দিচ্ছিল। ছোটো মেয়ের ধাক্কাতে, যখন সে পড়ে গেল, শরীরে পুড়ে যাওয়ার মত জায়গা আর ছিল না। ….. অ্যাম্বুলেন্স যখন ছাড়ছে তখন সে পাগল। শুধু বলছে, – বাবাই আমার মেরে ফেললো। আমি কালো বলে ঘৃণা করতো, তাই আমার এই দশা। রাস্তার পাবলিক আর ভুঁইফোঁড় সাংবাদিক হামলে পড়লো নিমেষেই। চণ্ডীপুর হাসপাতাল থেকে তমলুকের হাসপাতাল। বাবা মেয়েকে বাঁচাবে না মুমূর্ষু মেয়ের গঞ্জনা শুনবে! শশী বাবু মনে মনে প্রার্থনা করছেন, – ধরণী দ্বিধা হও। কণিকাকে বাঁচানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে সবাই। তমলুক থেকে নিয়ে যাওয়া হল কলকাতা। সেখানেও তেমন আশার কথা শোনা গেল না। কিডনি নাকি প্রচন্ডভাবে আক্রান্ত। একদিন পর আবার ফিরিয়ে আনা হল তমলুক জেলা হাসপাতালে।

যমে মানুষে তিনদিন টানাটানির পর তাকে বিদায় জানানো ছাড়া অন্য পথ আর রইলো না! হতভাগ্য বাবার মুখ পুড়িয়ে সে এখন অনন্ত পুরের বাসিন্দা। ছবি হয়ে দেওয়ালে পিঠ রেখে বাবা মাকে দেখছে কেমন! মুখ টিপে টিপে হাসছে আর বলছে, – কেমন ফাঁকি দিলেম বলো, কাঁদো তোমরা অনন্ত কাল। মুক্তি দিলেম কালো কুচ্ছিত মেয়েটা। নিজের ঘরের দেওয়ালে কী সব লিখতো। এখনও মুছে দেওয়ার স্পষ্ট দাগ। কিন্তু বাবা মার হৃদয়ের ক্ষত তো মোছার নয়! হয়তো তার দেওয়ালের লেখার মধ্যে ফুটে উঠত, সমাজের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ। সাজানো বিছানা, বই, আলমারি। সাজাতে ও সাজতে খুব ভালোবাসতো। বাবা মাও তেমনভাবে সমস্ত সত্তা দিয়ে মেয়েকে ভালোবাসতো। যদি পরজন্ম থাকে, ও যেন আবার এই বাবা মার ঘরে টুকটুকে ফর্সা মেয়ে হয়ে আসে!

বুকভরা কান্না নিয়ে শশী বাবু করুণ এক বাস্তব চিত্র তুলে ধরলেন। যতই সুরেশ আর সীমান্ত উঠতে চাইছে, বাবা কান্না দিয়ে সমস্ত যন্ত্রণা ভাসিয়ে দিতে চায়। ‘সত্যি বলছি, ওকে কালো মেয়ে বলে কোনদিন ভাবিনি, ও ছিল আমাদের হৃদয়ের ধন, সন্তান এক। এখন মনে হচ্ছে, সমস্ত আকাশে – বাতাসে – আলোতে আগুনের লেলিহান শিখা ধেয়ে আসছে আমার দিকে ! আর সেই আগুনের স্বর্ণালী আলোর মধ্যে বসে আমার হতভাগী মেয়েটা, বত্রিশটা বসন্ত কে পোড়াচ্ছে। ও! কী বীভৎস সেই মৃতদেহটা! কেবলমাত্র ওর কাজল কালো চোখ দুটোতে ফুটে উঠেছিল এক আকাশ বাঁচার আর্তি!’ ….

শশীকান্ত বাবুর বাড়ি থেকে যখন বের হোল ওরা, মাঘ মাসের বিকেল দিনের সব আলো শুষে নিয়ে গুমরে গুমরে কাঁদছে। ছুটন্ত গাড়ির মধ্যে বসে সুরেশ ভাবছে, কী ভাবে সে রিপোর্টটা লিখবে!

অবতরণ

অধীরবাবুর চাকরি আর দু-বছর চার মাস বাকি। এখন থেকেই বিভিন্ন অফিসে খোঁজ খবর চলছে, বন্ধুদের কাছে খোঁজ নিচ্ছে। আসলে অবসরের পরে কোন একটা প্রাইভেট কনসার্ন বা সরকারি অফিসে কাজ পেলে সময় কাটবে আবার পয়সাও আসবে। এই মতলবে শুধু কী অধীরবাবু একা ঘোরে! অবসরের কাছাকাছি এমনই অনেকেই অনুসন্ধানের লাইনে। বিজ্ঞাপন দেখা আর বিভিন্ন অফিসে যাতায়াত করে একটা কাজের যোগাড় অর্থাৎ পুনর্বহাল। কিছু চাকরিজীবীর প্রয়োজন আছে সেকথা অস্বীকার করা যায় না। অওনেকে বাড়িতে বসে থাকতে পারবে না এই অজুহাতে চাকরি খোঁজে। আবার কোন কোন চাকরিজীবী অফিসে অপরিহার্য হয়ে পড়েন, অবসরের পর তাঁরা সহজেই পুরনো অফিসে থেকে যান অন্তত পাঁচটা বছর।

সুযশ মণ্ডল অধীর বাবুর সহকর্মী। তাঁরও অধীর বাবুর তিন মাস পরে বিদায় ঘণ্টা বাজবে। ব্যাপারটা নিয়ে তার কোন উদ্বিগ্নতা নেই। ছেলেটি বেকার, মেয়েটিরও পাত্রস্থ করতে পারেননি। স্ত্রীর তো ভাবনায় ভাবনায় রাতের ঘুম প্রায় উধাও। স্বামীর অবসরের দিন যতই এগিয়ে আসে ভাবনার আঁধার যেন তাঁকে ঘিরে ফেলে ক্রমশ। অফিসে কাজের লোক হিসেবে সুযশ বাবুর যথেষ্ট যশ আছে। সহকর্মীরা সব সময় তাঁর সাহায্য পেয়ে কৃতজ্ঞও বটে। আধিকারিক বৃন্দ তাঁর ফাইল আগে ছাড়ে, কোন কিছুতে আটকে গেলে তাঁর সঙ্গে পরামর্শ করে। সারাটা সময় ফাইলে মুখ গুঁজে কাজ করে চলেছেন। পাশের ধীরেন চাটুজ্যে মাঝে মাঝে সেই সংস্কৃত বাক্যটি শোনায়, – কর্মন্যে ব্যধিকা….. ফলেষু কদাচন। সুযশ বাবু ফাইল থেকে মুখ তুলে শুধু মিচ মিচ করে হাসে। জুনিয়র সহকর্মীরা কাজের ফাঁকে তাঁর কাছে আসে, গল্প করে। জিজ্ঞেস করে আর কতদিন দাদা ? তিনি একদম যেন মুখস্থ বলে দেন, – একবছর এক মাস। কী করবেন দাদা, অবসরের পর ? কিছুই না । সাবলীল ভাবে উত্তর দেন সুযশ। সময় কাটবে কী করে? – সময় কী আমার জন্য বসে থাকবে ভায়া ! ঠিক কাটবে। প্রতি বছর এই অফিস থেকে অনেকেই অবসর নেন। তারা দেখেছি কেমন যেন আতঙ্কে থাকেন যত অবসরের সময় এগিয়ে আসে। এই মানুষটার দেখছি কোন বিকার নেই, পুরোদমে অফিস করে যাচ্ছে। আবার বলে কী না, যেদিন কাজের বেশি চাপ থাকে আর তার বেশির ভাগ বা সম্পূর্ণ করতে পারলে মনটা ভরে যায়, যাকে বলে satisfaction । এইসব ভাবতে ভাবতে সহমর্মী চলে যায় তার টেবিলে।

তার বড়দা সুযশকে বলতো অফিসে অনেকেই বন্ধু হবে, কিন্তু কাজের সময় কেউ পাশে থাকবে না। নিজের কাজ নিজের দায়িত্বে করতে পারলেই নিরাপদ থাকা যায়। কেউ কারোর দায় নেবে না। ঠিক পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যাবে। আগের কালে ছিল বিষয় ভিত্তিক ফাইল। তাতে সমস্ত সংশ্লিষ্ট গাইড লাইন, চিঠিপত্র, নোট শিট, তাতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের মন্তব্য নির্দেশ থাকতো। সেই নির্দেশ অনুযায়ী ড্রাফট তৈরি করবে স্টাফ। এই ভাবেই উত্তর প্রত্যুত্তরও চূড়ান্ত কাজ হত। বর্তমানে সবটাই কম্পিউটার নির্ভর। একালের ছেলেপুলেরা বেশ পোক্ত প্রবীণের দল তাই আজ অকেজো।

কাজের গতি বেড়েছে কিন্তু মাঝখানে বেশ ফাঁক থেকে যাচ্ছে। অবশ্য সেই ব্যাপারটা আজকের তরুণরা বুঝবে না। অফিসের কাজের যে একটা স্বচ্ছ পদ্ধতি ছিল তা যারা করেছে তারাই বুঝতে পারে ‘ফাইল মাহাত্ম্য’। কোন কাজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ফাইলের ‘নোট শিট’ আর ‘ট্যাগ’ দিয়ে আটকে রাখা চিঠি সব কথা বলবে। সুযশ বাবুর মনে পড়ে, চাকরি জীবনের শুরুতে তার লেখা ‘ড্রাফট’ দেখে সংশ্লিষ্ট আধিকারিক নোট শিটে লিখেছিলেন বড় বড় করে, – A good draft! আজও যেন তিনি সেই লেখাটা দেখতে পান।

……. দেখতে দেখতে সুযশ বাবুর হাতে গোনা দিনগুলো কিভাবে যে শেষ হয়ে গেল, নিজেই বুঝতে পারলে না। সময়ের রেলগাড়ি এইবার তার স্টেশনে এসে থামলো। বিভিন্ন জেলায় কর্মসূত্রে কেটেছে তার। অবসরও তার সেই এক ভিন জেলায়। এক ভদ্রলোকের বাড়ির ‘দেড় তলার’ একটা ঘরে থাকতো। স্বপাকে খাওয়া দাওয়া এবং হেঁটে পাঁচ মিনিটের মধ্যে অফিস। সহকর্মীরা বলতো, – কিভাবে পারেন আপনি এই অফিস সামলে রান্না বাড়ি! রাতে কী খান, ভাত না রুটি! রুটি শুনে সবাই অবাক হয়ে বলতো, – আপনি রুটি গোল করে তৈরি করতে পারেন! সুযশ বাবু বলতেন, – ভাবছেন রুটির আকার ম্যাপের মতন হয়ে যায়! একদম না, গ্রহের মত গোলাকার রুটি, পরখ করতে আমার বাসায় যেতে হবে। শুধু মাছ ভাজাটা একটু অসুবিধা হয় বটে। ভাত গলে যায় না, ঝরঝরে হবে। যখন কুচবিহারে ছিলাম পুরনো মেসে মাঝে মাঝে বন্ধুদের ভাত রেঁধে দিয়ে আসতে হত। সে বেলার খাওয়া ফ্রী। কিছুদিন পরে পরিবার নিয়ে অন্য বাড়িতে তখন থাকতাম ওদের মেসের কাছাকাছি। সেসব গল্প বলতে গেলে ফুরোবে না।

মাঝে মাঝে তার মনে হয়, কী ভাবে তেত্রিশটা বছর চলে গেল জীবন থেকে! মন থেকে ক্রমশ মুছে যাচ্ছে কী স্মৃতির ছবিগুলো! সংসার আর সংসারের মানুষগুলোকে ভালোভাবে দেখার ফুসরত পাওয়া যায়নি, শুধু অফিস আর অফিস। বেচারি স্ত্রীর ঘাড়ে সব কিছু দায়িত্ব দিয়ে তার সামাল দিতে হয়েছিল কাজের নানান ঝক্কি তথা অর্পিত দায়িত্ব। পাশের সহকর্মী সুশান্ত রায় বলতো, – যত কর ভাই, কেউ তোমার এই পরিশ্রম মনে রাখবে না। কথাটা সত্যি, কিন্তু নিজের দায়িত্ব এড়িয়ে চলা তো যায় না। কেউ মনে রাখে না কী করে বলি! সুযশ বাবু একদিনের কথা ভুলতে পারে না আজও। তখন পোস্টিং কোন এক মহকুমা শহরে। সেদিন অফিসে অনেক মানুষের সঙ্গে এক নিরীহ সাধারণ মানুষ কে দেখে তাঁর অবাক লাগলো। মলিন ধুতি আর জামা গায়ে এবং মাথায় একটা আধ ময়লা গামছা। অনেকক্ষণ ধরে ঘুরপাক খাচ্ছে। এ ঘরের সামনে একবার তো অন্য ঘরের সামনে। কেউ যেন তার পাত্তা দিচ্ছে না। কী করে সে বাবু দের টেবিলের সামনে যাবে তার কুড় খুঁজে পাচ্ছে না মনে হল। শেষে সুযশ বাবু অফিসের পিয়ন সোমনাথকে দিয়ে নিজের টেবিলের সামনে হাজির করলো। সামনের চেয়ারে বসতে বলায় মানুষটা অস্বস্তিতে কুঁকড়ে গেল। অনেক ক্ষণ বলার পর বসে ঘরের চারদিকে তাকায় ছোটদের মত। সুযশ বাবু বলে, – আপনার এই অফিসে কী দরকার ? বলুন তো দেখি। ঝোলা থাকে এক গুচ্ছ কাগজ দিয়ে বলেন,- জমি জমার কাগজ গুলোন একটু দেখপেন ছার, ঠিক আচে কী না। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে বাবু বলেন, – ঠিক আছে সব, তবে দুবছরের খাজনা বাকি ওটা শোধ করে দেবেন তাড়াতাড়ি। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে চলে গেলেন হাসি মুখে। তখন বিকেল চারটা হবে, এই অফিসে এসেছিল বেলা এগারটার সময়।

সপ্তাহ খানেক পরে বেলা বারোটার দিকে সুযশ বাবু দেখেন সেই মানুষটা গামছা মাথায় আবার দরজায় উঁকি মারছে। আফিসঘরের মধ্যে ডাকলে গুটি গুটি টেবিলের সামনে হাজির। কী খবর বলুন। খাজনা পরিশোধের রশিদ দিয়ে বলেন, – কাজ হয়ে গেচে ছার। তবে কষ্ট করে এলেন যে আবার। সুযশ বাবু বলেন। আপনার সঙ্গে দেকা করতে এলুম। আসার আগে আমাদের পাড়ার থানে পোনাম করে বলি, – ঠাকুর ওই ছারের সঙ্গে যেন দেখা হয়। সুযশ বাবু মিনিট খানেক অপলক চেয়ে থাকলেন ওই নিরীহ মানুষটার দিকে। উভয় পক্ষ নির্বাক। রশিদ খানা ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, – প্রত্যেক বছর খাজনা শোধ করে দেবেন না হলে অনেক টাকা একসঙ্গে পরিশোধ করতে কষ্ট হবে, বুঝলেন? মাথা ঝুঁকিয়ে তাঁর উত্তর দিলেন। তারপর আবার দুই হাত জোড় করে কপালে ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। সুযশ বাবু বেশ কিছুক্ষণ মানুষটার কথা ভাবলেন। কিছুই তো করা হয়নি মানুষটির জন্য। অথচ ভেতরটা কাঁপিয়ে দিয়ে গেলেন।

…… দেখতে দেখতে পাঁচ বছর পার, তিন দশকেরও বেশি কালের ধারাবাহিকতা থেকে তিনি বিচ্ছিন্ন। এখন সম্পূর্ণ এক আটপৌরে জীবনের মধ্যে তাঁর অবস্থান। মাটির সঙ্গে সম্পৃক্ত মানুষ তার ভালো লাগতো সেই ছোটবেলা থেকে। জীবনের প্রথম আড়াই দশক সে ছিল মাটির কাছাকাছি। তারপর তিন দশকের উড়ান। মানসিকতা যদিও মাটির দিকে নিবদ্ধ, তাই আপ্রাণ চেষ্টা ছিল মাটির সঙ্গে জড়িয়ে থাকা মানুষের জীবন আরো বেশি করে বোঝার প্রচেষ্টা । সে কাজে সে কতটা সফল অথবা বিফল তা সে নিজেই জানে না। উড়ান থেকে ফিরে এসে তাই উড়ানের দুঃখ সুখ মান অপমান নিয়ত সংগ্রাম, তথাকথিত উচ্চ আসনে আসীন মানুষের মানসিকতা ঘৃণা অনুভূতিহীন আচরণ অবশ্য সীমিত ব্যতিক্রম ছাড়া, ভুলে গেলেন।

এখনকার যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে মানসিকতার সঙ্গে নিয়ত দ্বন্দ্ব। মূল্যবোধের শূন্যতা, নীতি হীনতা, সোজা পথের অভাব, পাশবিক শক্তির বাড় বাড়ন্ত, সর্বোপরি সমাজ ব্যবস্থায় এক ঘূর্ণির মধ্যে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন। এখন তাঁর মনে হয়, সে এক অচেনা গ্রহের জীব। তবু তাঁর বাঁচতে হয় দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে, অনিয়মের স্রোতের সঙ্গে তাল মিলিয়ে, কুকথা আর অশ্লীলতার বাতাবরণে যেন বিধি বৈপরীত্যের দয়ায়। অনাকাঙ্ক্ষিত শুকিয়ে যাওয়া সমাজ চেতনার মধ্যে সে যেন এক অচেতন জীব!

খেজুর গুড়

‘জলজীবন মিশন’ প্রকল্পের গাড়িটা এসে সরু গলি, মোটা গলি সব চষে দিচ্ছে। তারপর সে কী হাল হচ্ছে! মনে হয় পালং শাকের বীজ বুনে দিই। সকলের সঙ্গে ওই পথ বেয়ে বেলা বারোটার সময় যে লোকটা আসছে তাকে আগে দেখেনি রসময় বাবু। রসময় হালদার এই পাড়ায় নয় নয় করে বছর দশেক এসেছেন। পরনে একটা ময়লা ধুতি, গায়ে একটা হাতকাটা জামা। মাথায় মাঝারি মাপের একটা কলসি খড়ের ‘আলটা’র ওপর বসিয়ে মাথায় নিয়ে রোগাটে চেহারার লোকটা খুব সাবধানে এগিয়ে আসছিল। রসময় বাবু সেই লোকটাকে দেখে দাঁড়িয়ে ছিল, বাজারের ভরা থলেটা হাতে নিয়ে। আজ তার বাজারে খুব দেরি হয়ে গেছে। দুটো বাড়ির সামনে দাঁড় করানো হলেও বিক্রি হল না, ওই খেজুরের গুড় ব্যাপারীর। অতঃপর রসময় বাবুর সামনে এসে হাজির। গুড় কত করে? – প্রশ্ন করে রসময়। খুব আস্তে উত্তর আসে, – দেড়শো টাকা কিলো। কোথাকার গুড় নিয়ে এসেছ। চন্দনেশ্বর। উত্তর দেয় প্রবীণ গুড় ব্যাপারী।

মিনিট তিনেক হেঁটে গুড় ব্যাপারীকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে পৌঁছায়। গেটের সামনে গুড়ের কলসি নামায়। রসময় বাবু একটা প্লাস্টিকের খালি বোতল নিয়ে এসে এক কিলো গুড় নিয়ে ঘরের মধ্যে টাকা আনতে গেল। প্রবীণ গুড় ব্যাপারী ততক্ষণে একটু জিরিয়ে নেয় গেটের সিমেন্টের ওপর বসে। খড়ের আলটার সঙ্গে পাটের দড়ি বেঁধে গুড়ের কলসি সাবধানে বসিয়ে রেখেছে। এ হল সেই মান্ধাতা আমলের পদ্ধতি। রান্নাঘরে ‘শিকে’ তে যে পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় জিনিস ঝুলিয়ে রাখে, ঠিক সেই রকম আর কি। রসময় বাবু টাকা দিয়ে বলে, – গুড় কেমন বাপু, ভালো তো। – একটু পরক করে দেক, বলে তার কাঁধে ঝোলানো কাপড়ের থলে থেকে একটা চামচ বের করে নেয়। গুড়ের কলসিটা একটু আড় করে এক চামচ গুড় রসময় বাবুর হাতের তালুতে দেয়। মুখে দিয়ে অবাক হয়ে গেলেন তিনি। এত ভালো গুড় ইদানিং পাওয়া যায় ! এই ভেজালের যুগে ! তাঁর কৌতূহল হল, বিশদ জানার। রসময় বাবু আদতে গ্রামের মানুষ । ছোটবেলায় তাঁদের কত যে খেজুর গাছ ছিল পুকুরের পাড়ে। শীতকালে পাড়ার কাঞ্চন কাকা রসের জন্য গাছ কাটত। কাঞ্চন কাকা পাকা শিউলি ছিল।তাদের বেশির ভাগ গাছ রস আর গুড় দেওয়ার বিনিময়ে প্রত্যেক বছর নিত। আজকের এই গুড় মুখে দিয়ে মনে পড়ে গেল কত দিন আগে ফেলে আসা কিশোর কালের কথা।

তুমি কি এখনও গাছ কাটতে পার। – ‘না বাবু, আমার মেজ ছেলে কাটে, আমি প্রায় তিরিশ বছর গাছ কেটেছি, এখন আর পারি না। তবে চার ছেলের মধ্যে ওই মেজ ছেলেটা শিখেছে, আমার কাছে। অন্যরা কলকাতায় কাজে যায়, যেকোনও প্রকারে সংসার চালায়। মেজ ছেলেটা বাড়ির জমি জমা অল্প যা আছে তাই চাষবাস করে, শীত কালে খেজুর আর গরম কালে তাল গাছ কেটে সংসার চালায়, আমি আর আমার ইস্তিরি ওর সংসারে আছি। গ্রামে লোকে তেমন পয়সা দেয় না, তাই এই কষ্ট করে আপনাদের অঞ্চলে আসি দুটো পয়সা পাব বলে। ‘রসময় বাবুর সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করে গুড় ব্যাপারী চলে গেল।

গুড় ব্যাপারী চলে গেল ঠিক, কিন্তু রসময় বাবু যেন অনেকদিন পর সেই তাদের গ্রামের জীবনে ফিরে গেলেন। একদিন যে গ্রামের মাটির ঘরে, পুকুরের জলে, মাঠের জমিতে, মাটির রাস্তায়, সবজি বাগানে, গাছে পালায় চড়ে কৈশোর থেকে যৌবন কেটেছে, সেই কথা সেই গ্রাম কী করে ভুলে যেতে পারে! আজ ওই গুড় ব্যাপারী বুঝিয়ে দিয়ে গেল না কী গ্রামের বিশুদ্ধতা, গ্রামের পরিবেশ ! এই শহরতলি কী প্রশান্তি দিয়েছে তার! তার ভাবনা দোল খায়।

শীত কাল আসার আগে ওরা ভাই বোনেরা উদগ্রীব হয়ে থাকত কখন কাঞ্চন কাকা খেজুর গাছ মুড়ো দিতে আসবে। কাঞ্চন কাকা খেজুর গাছে উঠত কার্তিক মাসের মাঝামাঝি নাগাদ। ওরা গাছতলায় হাজির হত খেজুর গাছের ‘চাঁপ’ খাওয়ার জন্য। চাঁপ অর্থাৎ খেজুরের ফুল ফোটার আগের কচি আধার। সব গাছে পাওয়া যেত না, কোন কোন গাছে পাওয়া যেত। আর খুব কচি অবস্থায় এগুলো খেতে চমৎকার। কাঞ্চন কাকা সকলকে ভাগ করে দিত, আমাদের ঝগড়া দেখে। তারপর ওদের কিছুদিনের অপেক্ষা, কখন রস ঝরবে কঞ্চির নলি বেয়ে। একটু বেশি রস না ঝরলে নলির মুখে মাটির ডাবরি ঝুলিয়ে দিত না শিউলি কাকা। তখন ওরা ওই গাছের গোড়ায় এসে হাত পেতে থাকত, ফোঁটা ফোঁটা রস হাতের তালুতে পড়ার জন্য। এক ফোঁটা পড়লেই জিভ দিয়ে চেটে নিত। আহা, কী স্বাদ। আজকে হাতের তালু পেতে গুড় ব্যাপারীর গুড় নেওয়ার সময় ওই ছবিটা ভেসে উঠেছিল রসময় বাবুর মনের আয়নায়। সেই সব কথা, সেই জীবন ফেলে আজ কেন যে শহরতলির বাসিন্দা!

কাঞ্চন কাকা গাছ গুলো দু ভাগে ভাগ করে কাটত। আসলে তিন দিন কাটার পর গাছের ‘জিরেন’ অর্থাৎ বিশ্রাম দিতে হয় তিন দিন। এক ভাগ গাছের যখন জিরেন, অন্য গাছ গুলোতে রস নামে। তবে ওই জিরেন গাছ থেকে অল্প অল্প রসের ফোঁটা পড়তে থাকে। কিশোর রসময় আর ওর ভাইবোনেরা, ঘটবারি পুজোর পাওয়া ঘট নিয়ে, তাতে মোটা সুতো বেঁধে জিরেন গাছের ফাঁকা নলিতে ঝুলিয়ে দিয়ে আসত। দুপুরের চানের আগে ওই গাছে উঠে দেখত,ঘট ভর্তি হয়ে গেছে। তখন কী আনন্দ যে হত, মনে পড়লে আজও রোমাঞ্চ জাগে মনে।

এ তো গেল জিরেন গাছের রস গল্প। রাতের রস চুরির গল্প তো ভয়ংকর রোমাঞ্চকর। যতই কাঞ্চন কাকা গাছের রস গুড় চুক্তি অনুযায়ী দিক না কেন, পাড়ার ছেলেদের পাল্লায় পড়ে রাতের রস চুরি করার লোভ সামলানো দায়, ওই কিশোর বয়সে। অবশ্য চুরি করা রসের পরিমাণে কাঞ্চন কাকার লোকসান কিছুই ছিলনা, কারণ কত খেজুর গাছের রস যে শেষ রাতে ডাবরি উপচে পড়ে যেত তার হিসেব ছিল না। আর যেদিন শীত পড়বে কন কনে, রসের পরিমাণ বেড়ে যাবে। চুরি তো আর রোজ রোজ হত না, সপ্তাহে এক বা দুদিন। আর পাড়ার দুষ্টু ছেলে মেয়েরা যে রস চুরি করে খায়, সেকথা কাকার অজানা ছিল না। কত খাবে, ছেলেরা তো মজা করে খায়, মনে মনে হাসে কাঞ্চন কাকা । তাদেরও কিশোরকালে এরকম মজা তো করেছে ! কৈশোরের স্বপ্ন মাখা দিনের কথা, সকলেই উপভোগ করে।

কাঞ্চন কাকা জানলে ঠিক আছে, কিন্তু বাড়ির অভিভাবক জানলে নিস্তার নেই, এই রস চুরির কাহিনী। রসময় বাবুর খুব মনে পড়ে, একদিন ভাত খাওয়ার পর রাতে ওরা চার বন্ধু মিলে বাড়ি থেকে কিছু দূরে একটা বাগানে রস চুরি করতে যায়। ওরা জানে কোন গাছে রস বেশি হয় । শীতের রাত জ্যোৎস্নায় ভাসছে, শীতের দাপটও কম নয়। রস যখন চুরি করতে আসে ওরা, টেনশন তো থাকে, থাকে ভূতের ভয়। চাঁদের আলো আর গাছের ছায়া, ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টির পক্ষে অনুকূল। একটা পরিষ্কার ভাঁড় জোগাড় করে এনে, প্রথমে যে ওস্তাদ বেশি, সে গাছে ঝোলানো রস ভর্তি ডাবরির কাছাকাছি পৌঁছে গেল। শীতের রাত কেউ তো কাছাকাছি থাকার কথা নয়। দ্বিতীয় জন ও গাছের কিছুটা উঠল, সে প্রথম জনের কাছে থেকে রসের ভাঁড় ধরে নিয়ে একটু নেমে তৃতীয় জনের হাতে দেবে। এভাবেই খুব সহজে গাছের রস নেমে আসবে। তারপর সবাই মিলে বাড়ি থেকে আনা গামছা দিয়ে ছেঁকে গ্লাসে করে …।

কী আনন্দের রস পান শীতের রাতে। রস খাওয়ার পর প্রচণ্ড শীত অনুভূত হয়। তবে মজার কাছে সে শীত যে তুচ্ছ। সেদিন রাতে বাড়ি ফিরলে তার বড়দা ধরতে পেরেছিল রস চুরির কথা, কিছুই বলেনি। কারণ ক’দিন আগে ওরাও তো … । শীতে রস চুরি আর গ্রীষ্মে আম চুরি, অনেক কিছু ভুলে যাওয়ার মাঝখানে মনে থাকে। রসময় আজকে একটু উদাস হয়ে যেন অনেক কিছুই ভাবছে। আর ভাবনার মূলে প্রবীণ ওই গুড় ব্যাপারীর আগমন । গুড় ব্যাপারী যেন তার গ্রামটাকে নিয়ে সামনে হাজির করল । গুড় ভরা প্লাস্টিকের বোতল হয়ে গেল মাটির একটা গুড় ভরা কলসি। এমন সময় স্কুল ফেরত তার নাতিকে দেখে রসময় বর্তমান ভুলে চলে গেল সেই তার অতীতে। সে যেন ফিরছে তাদের মর্নিং স্কুল থেকে। মাটির দেওয়াল, টালির ছাউনির প্রাইমারি স্কুলটা স্পষ্ট হল তার চোখে। পাড়ার সহপাঠীদের সঙ্গে সর্দারদের পুকুর পাড়ের পথ ধরে, গায়েনদের বট তলার ছায়া মাড়িয়ে ঘরে যখন এল, দুপুরের চানের বেলা হয়ে গেছে। এখন তেল মেখে এক দৌড়ে বড় উঠোন পার হয়ে, আম জাম জামরুল গাছের ছায়াময় পথ পেরিয়ে পুকুরের জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়বে, সেখানে তখন অন্য সঙ্গীরা সাঁতারে মেতেছে।

কর্তাকে অন্যমনস্ক দেখে গৃহিণী বলে উঠল –
‘বেলা যে গড়িয়ে গেল চান খাওয়া হবে?’ থতমত খেয়ে রসময় হালদার বাস্তবে ফেরে। –
‘হ্যাঁ, এই তো যাচ্ছি।’

দীক্ষিত পাঠক

বছর পঁয়ত্রিশ সরকারি অফিসে কাজ করার বিচিত্র অভিজ্ঞতা নিয়ে, অবসর নিল বীরেন মণ্ডল। এখন তার হাতে সময়ের আধিক্য তা কিন্তু নয়। সহধর্মিনী ভাবে, অনেকদিন সংসারে ফাঁকি দিয়ে দিব্যি শুধু অফিস ছিল ধ্যানজ্ঞান। ছেলে মেয়েদের দিকে তাকানোর সময় ছিল না, একাই সামলেছেন তিনি, সন্তানদের পড়াশুনো, শ্বশুর শাশুড়ির দেখভাল ইত্যাদি ইত্যাদি। অবসরের পর একটু সংসার করে দেখাক, সংসারের কী জ্বালা। শুধু ভাবনা নয়, মাঝে মাঝে মুখ ফুটে বলে দেয়, সব সুখ আহ্লাদ ত্যাগ করে মুখ বুজে সংসারের ঘানি টেনেছে। অতএব এইবার একটু স্বস্তি দাও হে অফিস বাবু।

বীরেন মণ্ডল সরাসরি বাক যুদ্ধে নামতে রাজি নয়, শুধু কান পেতে শুনে যায়। এবং কথাগুলোর যুক্তি গ্রাহ্য সারাংশ মাথার মধ্যে নিয়ে মাঝে মাঝে চিন্তা করে, কতটা গ্রহণীয় ও কতটা নয়। শাশুড়ির কানে মাঝে মাঝে বউমার কথাগুলো যায় না এমন নয়, বউমা তো আর রাখঢাক করে বলে না? কিন্তু উত্তর পঁচাত্তরের বিধবা, ছেলেকে তো জানে। কী ভাবে সে পড়াশুনো থেকে সংসার দেখা ও অফিস চালিয়ে এসেছে। বউমার কথা তিনিও গায়ে মাখেন না।

এখন বীরেনবাবু ভাবে, দিব্যি ছিলাম ভালো অফিসের কাজের মধ্যে। সেখানে যে হ্যাপা নেই তা নয়, সেখানে কী জটিল আবহে কাজ করতে হয়েছে, সে তো আর সংসারের সদস্যরা বুঝবে না। পান থেকে চুন খসার জো নেই, তারপর রাজনীতির নেতাদের কত না আবদার, কত না কূট কৌশল। জনগণ, নেতা, উপর মহল, সব কিছু ব্যাল্যান্স করে রোজ সন্ধে বেলা বাসায় ফিরে বাড়িতে ফোন করা ছিল তার রুটিন। বাড়ির সব কুশল জেনে তবেই ছিল স্বস্তি। তারপর একটু বিশ্রাম নিয়ে স্বপাকে রান্না। সকাল বেলা ভাত, আলু ভাতে, একটা তরকারি আর ডাল। একলা মানুষ এর বেশি করতে ভালোও লাগে না। তারপর সময়মত অফিসে পৌঁছে সেই যে কাজের মধ্যে ডুবে গেল, বাড়ির কথা, স্ত্রী, মা, ছেলে মেয়ের কথা মাথা থেকে বেরিয়ে যেত। বাসায় ফিরে খোঁজ নিয়ে একটু বিশ্রাম। যদি বাড়িতে কেউ অসুস্থ হয়ে পড়ে, মনটা খুব খারাপ হয়ে গেল, হয়তো সেদিন রাতে আর রান্না করার ইচ্ছে রইল না। বাটি খানেক মুড়ি ভিজিয়ে আহার। ফোন করে কিছু নির্দেশ দেওয়া, কী করলে জ্বর কমবে, ডাক্তারের কাছে তাড়াতাড়ি যেতে হবে ইত্যাদি বলে মানসিক সাহায্য ওই দূর থেকে করা ছাড়া আর কিই বা উপায় আছে।

বদলির চাকরি, এক বছর এ জেলা তো পরের বছর অন্য। সপ্তাহে একদিন বাড়িতে আসা যায়, তাতে বাড়ির কোন সাহায্য হয় না। স্ত্রীর কথা যে একেবারে ফেলনা নয়, সে কথা জানে বীরেনবাবু। তবে তার এই একাকী জীবন কিভাবে কাটে, কী উদ্বিগ্নতা, কী আশঙ্কার মধ্যে তার প্রত্যেকটা দিন অতিবাহিত হয়, সে কথা একটু ভাবার তো আছে! এই অবসরের দিনগুলোতে মাঝে মাঝে তার মনে হয়, কী এক অসাধ্য সাধন সে করে এসেছে। কী করে যে সেই সব দিনগুলো, সেই সব বাধাগুলো, পার করে এসেছে দিনের পর দিন প্রচণ্ড ধৈর্য আর উদ্বিগ্নতার মধ্য দিয়ে, ভাবলে অবাক লাগে আবার একটা ভালো লাগার অনুভূতি জন্মায়। আজ সেই সব কথা শোনানোর মত মানুষ কোথায়! সে দেখল না কারোর, না সেই সব দিনগুলোর কথা শোনার মত আগ্রহ বা উৎসাহ আছে। অন্যের কথা কী বলবে, নিজের মানুষের কাছে সে যেন ব্রাত্য। সকাল হলেই বাজার , বাজার থেকে ব্যাংক, ব্যাংক থেকে অন্য দোকান, অন্য দোকান থেকে ডাক্তারখানা, ডাক্তারখানা থেকে এসে নানা সংসারের কাজ। কোথায় পুকুরের মাছ মরছে দূষিত জলে, কোথায় নলকূপ খারাপ হয়ে গেছে, ইলেকট্রিকের সুইচ ক’দিন চলছে না, ম্যাশিন থেকে গম না ভাঙিয়ে আনলে রুটি হবে না। সব যেন তার গুরু দায়িত্ব এবং পালন করছে রীতিমত, ঘোরতর একনিষ্ঠ সংসারী হয়ে।

সব কিছু প্রায় ঠিকঠাক চলছে। ইতিমধ্যে বড় মেয়ের পাত্রস্থ করেছেন সুচারু ভাবে। সাংসারিক দায়িত্ব পালনে বীরেনবাবু যে লেটার মার্কস পেয়েছেন, সকলে একবাক্যে স্বীকার করবেই। বাড়ির সন্তানেরা এবং তাদের মাতৃদেবী মুখে না বললেও মনে মনে প্রশংসা করেন বীরেনবাবু বুঝতে পারেন পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডল পর্যবেক্ষণ করে। এই সব দৈনন্দিন ব্যস্ততা শেষ হলে, অর্থাৎ আঁধার নামার পর বীরেন মন্ডলের যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে মনটা। এই ফাঁকা জায়গাটা কী করে পূরণ করা যায়, সেই ভাবনা হয়েছে নতুন সংযোজন। খবরের কাগজ আজকাল দেখার মত নয়, মিনিট কয়েক চোখ বোলালে শেষ এবং অস্বস্তি। টিভির পর্দায় চোখ রাখা যায় না, তার মত মানুষের মানসিকতায়।

পুরোনো রেডিওটা মাঝে মাঝে শুনতে ভালো লাগলেও বাড়ির কেউ পছন্দ করে না। শেষে এক বন্ধুর পরামর্শ অনেকটা মনে ধরেছে। বিষয়টা হল একটু লেখালেখি। ছোটবেলায় লেখালেখি করার ইচ্ছে যে ছিল না তা নয়, তবে হয়ে ওঠেনি, যেমন ঐচ্ছিক বিষয় পড়তে ভালো লাগত না স্কুলে। যাইহোক, লেখালেখি শুরু হল, বেশ আটঘাট বেঁধে। পরামর্শদাতা বন্ধুবর তার উৎসাহের মাত্রা দিল কয়েকগুণ বাড়িয়ে। প্রথমে কবিতা দিয়ে শুরু করে একটা কাব্যগ্রন্থ বের হয়ে গেল। পরিবার, আত্মীয়স্বজন, পরিচিত মানুষের দল, পাড়া পড়শি সবাই ধন্য ধন্য করে, আপ্লুত তিনি এই সবার প্রশংসা প্রাপ্ত হয়ে। কাব্যগ্রন্থ মৃত পিতার নামে উৎসর্গ, দেখে স্বাভাবিক ভাবে তার মায়ের চোখে জল এবং সকলকে ছুঁয়ে গেল বিষয়টা। ইদানিং কবিতার বই কেউ পছন্দ করে না, গল্প লিখুন স্যার। প্রকাশক মশাই বললেন। তাহলে কী হবে! বীরেনবাবুর খাতায় ইতিমধ্যে কিছু গল্প আগে মকশো করা হয়েছে বিচ্ছিন্ন ভাবে। এখন প্রকাশকের কথাটা মনে ধরল তাঁর। সুতরাং আদা জল খেয়ে বীরেনবাবু নেমে পড়লেন গল্প লিখতে।

মাস ছয়েক পরের ঘটনা। একদিন আবার বাড়িতে নতুন বইয়ের গন্ধ। এবারের গল্পের বই উৎসর্গ করা হয়েছে মায়ের নামে। সন্ধে হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ আগে। মায়ের নিত্য দিনের প্রার্থনা গৃহদেবতার কাছে, শেষ হল একটু আগে। বীরেন মণ্ডল নতুন বইটা হাতে নিয়ে মায়ের নির্জন ঘরে প্রবেশ করে। মা তখন প্রয়াত বাবার প্রতিকৃতিতে প্রণাম করছে। ছেলের উপস্থিতি বুঝতে পারেন তিনি। ছেলের দিকে ফিরে মা বলে, – ‘কিছু বলবি খোকা?’ ছেলে কিছু না বলে, মাকে প্রণাম করে নতুন বইটা হাতে তুলে দেয়। সুন্দর প্রচ্ছদের বইটা দেখে চশমার আড়ালে মায়ের চোখে আনন্দাশ্রু। ছেলে বুঝতে পারে।

এক সপ্তাহ পর এক দুপুরে মা তাঁর ঘরে ছেলে, বউমা আর নাতনিদের দেখে পাঠাল। সবাই হাজির হলে মা তাঁর ছোট আলমারি থেকে গল্পের বইটা বের করে বলে, – ‘শোন খোকা, তুই তো পাগল হয়ে যাবি!’ একথা শুনে সবাই অবাক, মা কী বলছে! ছেলে অনেকক্ষণ মনে মনে হাসল। অন্যরাও হাসি চাপতে পারে না। বউমার প্রশ্নে শাশুড়ি বলে, – খোকার গল্প গুলো পড়ে মনে হল, কী অসম্ভব চিন্তা করতে হয়েছে এই সব গল্প লিখতে, তোমরা তা জান না। এই জগত, এই জীবন,সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবন যুদ্ধ বর্তমানের কুটিল মানুষ, মূল্যবোধের অবক্ষয়, সম্পর্কের আলগা বাঁধন এবং উত্তরণের যে সব অক্ষর মালা বইটার পাতায় পাতায়, সেসব বুঝে কথাটা বললাম। সারা জীবন অনেক কষ্ট করতে হয়েছে তোর অফিস চালাতে, এখন একটু বিশ্রাম দে বাবা মগজের!’

এই তো সেদিন বড় মেয়ে বলছিল, – বাবা তুমি তো লিখেছ ভালো, ছাপানো হয়েছে পয়সা খরচ করে, কিনবে কজন আর পড়বে কারা! আজকে তার মা বড় নাতনির যুক্তি কী অপূর্ব বোধ দিয়ে খন্ডন করল, ভাবা যায় না! বীরেন মন্ডলের মনে হল, একাকী তার মা গল্পের বইটার লক্ষ পাঠক! সফল হল তার গল্প লেখা।

স্বপ্ন ভূমি

সবাই অবাক হয়ে দেখত, একজন দীর্ঘদেহী প্রবীণ মানুষ রোজ সকাল বেলা গ্রামের দখিন দিকে ঝাঁপুর দোকানে চা খেতে যাচ্ছে হেঁটে হেঁটে। ।আবার বিকেল বেলাও । ছোট ভাই শহরতলির বাসা থেকে রোজ খোঁজ নিতে পারে না তার অশীতিপর দাদার। সব সময় মোবাইলের নেট থাকে না , চার্জ থাকেনা ওদের। সে তো আর কম দূরের গ্রাম নয় ! সেই মনি নদীর ধার ঘেঁষে তাদের গ্রাম। বামুনের ঘেরি।

ছবির মত সাজানো এক আদিবাসী গ্রাম। সেই সত্তর দশকের সময়। অর্ধ শতক পার করে সেই গ্রাম, গ্রামের মানুষ, প্রকৃতির কত যে পরিবর্তন হয়েছে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে। তবুও সেখানে কয়েক দিনের জন্য গেলে এখনও অন্তত বুক ভরে শ্বাস নেওয়া যায়। দাদা তার আজীবনের গ্রাম্যতা নিয়ে দিব্যি ছিল দুঃখে সুখে অসুখে বিসুখে। বিপত্নীক মানুষটি বড় যেন নিঃসঙ্গ, ছেলেদের সংসারে থেকেও। জীবনের প্রতি আর কোন মোহ ছিল না। ছোট ভাইকে যখন পেত, দুঃখের পাঁচালি নয়, মায়াময়ী সংসার ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে যেত। কেন যে তার এই পৃথিবীর প্রতি বিতৃষ্ণা জন্মালো অন্য কেউ না বুঝলেও ছোটভাই বেশ খানিকটা অনুভব করত। ভাই সান্ত্বনা দিয়ে বলে, – এত যাই যাই কর কেন তুমি । সময় হলে চলে যাবে, কেউ তোমার আটকাতে পারবে না। কে যে কখন চলে যাবে, কেউ জানে না। সময়ের ঘরে মানুষ বন্দি, মুক্তিও তার হাতে।

দীর্ঘ সময়ের প্রতিকূল স্রোতে জীবন তরণী বাইতে বাইতে আজও তিনি সংসারের সকলের নিয়ে সারাক্ষণ চিন্তা মগ্ন থাকে। মাঝে মাঝে উদাস পথিকের মত আনমনা হয়ে গেলে , কেন যে এই পৃথিবীর জল বাতাস তাঁর পছন্দ হত না! তখন কথায় কথায় চলে যাওয়ার ভাবনা। কিন্তু সেই তাঁর ভাবনা হঠাৎ যে বাস্তবে কার্যকরী হবে, পরিবারের কেউ বুঝতে পারেনি। …সেদিন সন্ধে বেলা হঠাৎ ছোট ভাইয়ের মোবাইল বেজে উঠল। হঠাৎ মেজদাকে তাদের ব্লক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আপাতত স্থিতিশীল। ছোট ভাইয়ের উদ্বিগ্নতা কাউকে বোঝাতে পারে না। সেই রাত্রি তার কেটে গেল নির্ঘুম।

হাসপাতালের বেডে, স্যালাইন চলছে। ডাক্তার বাবুরা বলছেন আরও আগে ভর্তি করা উচিত ছিল। কিন্তু গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষের জীবনের প্রেক্ষাপট, তাদের জীবন ভাবনার সঙ্গে ডাক্তার বাবুদের ভাবনার সামঞ্জস্য কোনদিন ছিল না, আজও নেই। তবুও আর সকলের সঙ্গে ছোট ভাই আশায় বুক বেঁধে ছিল, – অনেক যুদ্ধের পোড় খাওয়া সৈনিক মেজদা ফিরে আসবে সুস্থ হয়ে। তবে আশা জাগিয়েও তৃতীয় দিনের গোধূলি বেলায় মুঠোফোনে যে খবর ভেসে এল তাতে নিজেকে স্থির রাখতে পারে না প্রিয় ছোট ভাই। এক অপ্রত্যাশিত সংবাদের অভিঘাতে তার সমস্ত শরীরের রক্ত প্রবাহ সাময়িক যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। সহধর্মিণীর জিজ্ঞাসার উত্তরে সে শিশুর মত কাঁদল কিছুক্ষণ।

আজ একুশ দিন পর জন্ম গ্রামে এসে, মেজদার ফ্রেমে বাঁধা প্রতিকৃতির সামনে দাঁড়াল প্রিয় ছোটো ভাইটি। যে মানুষটির সামনে এসে দাঁড়ালে অচিরেই ছেলে মানুষের মত হয়ে কত কথা, কত কিছু জানার, শারীরিক ও সাংসারিক কুশল সংবাদ শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠত, আজ ছবি হয়ে তার সামনে যেন মুচকি হাসছে ! বলছে, – দেখ ভাই, বলেছিলাম আর ভালো লাগছে না তোদের এই পৃথিবী, পৃথিবীর সংসার! তাই দিব্যি চলে গেলাম অন্ধকারের দেশে। আর তোরা কেউ খুঁজে পাবি না আমার। এসব ভাবতে ভাবতে ছোট ভাই তখন অনেক অনেক পিছনে চলে গেছে।

তাদের জন্ম ভিটের উপর এক অস্থায়ী মঞ্চে তার মেজদা বসে আছে, নির্বাক নীরব। এই তো সেদিনের কথা, – দুষ্টু ছোটো ভাইকে নিয়ে তিনটে নদী পার হয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিল। তখন মেজদার উপর কী রাগ! মা বাবা দাদাদের আর খেলার বন্ধুদের ছেড়ে বন্দি করে দিল স্কুলের হোস্টেলে! আর একলা কী অমানসিক পরিশ্রমে সংসারের সকলকে আগলে রাখলো অদ্ভুত স্নেহ বন্ধনে। নিজে কোনদিন স্কুলের দরজা দেখল না দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত এক সংসারের ঘেরাটোপের মধ্যে দুর্দিন থেকে মুক্তির আশায়।

তারপর সেই দুর্ভাগ্য তাড়িত সময়ের ভাঙা সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে কখন যে সংসার জীবনে এল নিজেই বুঝতে পারেনি। …. একদিন মেজদা তার ছোটো ভাইকে আলাদা করে দিয়ে বলল, – এখন তুই রাগ করবি জানি, কিন্তু সময়ের চাহিদা আমাকে ভিতর থেকে বলেছে তাই তোকে ….! সেদিন বুক ফেটে গেলেও ছোট ভাইয়ের কান্না আসেনি চোখ বেয়ে। মেজদা হয়তো অনুভব করেছিল, সংসার এক কঠিন জায়গা। সেদিন থেকে তার মেজদা আরও গাঢ় হয়ে বসে ছিল তার হৃদয়ে। …. ছোট ভাইটি তার আজ খুব কষ্ট পাচ্ছে তার অবলুপ্ত সংসারের ধ্বংস স্তূপের উপর দাঁড়িয়ে । তার সেই যত্ন করে সাজানো মাটির ঘর, নিকোন উঠোন, গোয়াল ঘর, রাশোয়া ঘর (উপাসনা ঘর), রান্না ঘর সবই নিশ্চিহ্ন। শুধু তার বিশাল কয়েত বেল গাছটা দাঁড়িয়ে আছে সংসারের স্মৃতিচিহ্ন হয়ে।

সে, সেই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে ফাল্গুনের বিরহী দুপুরে। সন্নিকটে আত্মীয় স্বজন পাড়া প্রতিবেশীর দল শ্রদ্ধা জানাতে এসেছে অস্থায়ী শামিয়ানার নিচে। …. ছোটো ভাইটি যেন স্পষ্ট দেখা পায়, তার ফেলে যাওয়া সংসারের স্বপ্ন মাখানো ছবিগুলো। মায়ের শেখানো মন্ত্রে তার গৃহিণী কী সুন্দর পরিচ্ছন্ন স্বচ্ছ করেছে মাটির পৃথিবীর মাটির ঘর বাড়ি। মা সেই বিস্তীর্ণ উঠোন পার হয়ে বারান্দায় এল, বারান্দায় ঝোলানো দোলায় নাতিকে ঘুম পাড়ানি গান গেয়ে ঘুম পাড়াতে! গৃহিণী তখন রান্না ঘরে অফিসের ভাত রাঁধায় ব্যস্ত। সন্ধে বেলায় অফিস থেকে ফিরতে দেরি হলে মা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে, দাদা টর্চ নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে ।শেষে দুই ভাই গ্রামের মাটির পথে , মনি নদীর পাড় ধরে ঘরে ফিরলে স্বস্তি সকলের। ছুটির দিনে মাঠে নেমে চাষের কাজ, সবজি খেতে স্বামী স্ত্রী। এ দৃশ্য গ্রামের চোখে যেন নতুন। সব কিছু নিয়ে, সকলকে নিয়ে সে এক নিমগ্ন সংসারে স্বপ্নের দিন। … আজকের এই শূন্য তার ভিটে, মানুষের অভাবে, অযত্নে নষ্ট হয়ে গেল, তার হৃদয় আরও বেশি শূন্য করে দিয়ে গেল তার প্রিয় মেজদা!

অতীতের প্রীতিময় স্মৃতি বুকের বিপন্ন চর ভূমিতে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে বসন্তের গোধূলি বেলায় ছোটো ভাইটি। তারপর আবার ইট কাঠ সিমেন্টের বন্দি বাসায় । মনি নদীর তীরে পড়ে রইলো তার প্রিয় গ্রাম, প্রিয়তর পরবর্তী প্রজন্মের সন্তান ও তাদের সংসার। সে গ্রামে নেই তার প্রিয় ঘর, উঠোন পুকুর, সবজি খেত আর মেজদা।

ভুবনেশ্বরের ভাবনা

ঋতু বৈচিত্র্যের বাংলায় এখনও শীত বসন্ত বর্ষা স্বমহিমা হারায়নি। বসন্ত পড়লেই কোকিল সেই ভোরবেলা থেকে ডাকাডাকি শুরু করে। বিছানা ছাড়ার আগে খুব মন দিয়ে কোকিলের মিষ্টি কন্ঠস্বর বুকের মধ্যে নিয়ে চোখ বুঝিয়ে থাকে ভুবনেশ্বর হালদার। সকাল হলেই আগে অফিসের তাড়া ছিল, অবসরের পর কর্ম সূচি বদল হয়েছে। সকলে বলে এখন নাকি অখণ্ড অবসর, বেড়িয়ে বেড়ানোর উপযুক্ত সময়। সত্যি কী তাই!

এখন সকালে বাড়ির মূল দরজাটা তাকেই খুলতে হয়। শীতে কষ্ট হলেও এই ফাল্গুনে সূর্য ওঠার আগে, দরজা খুলেই পাশের ফাঁকা প্লটের সজনে গাছের শাখা থেকে ভেসে আসে বেশ সুবাস। সব ডাল ভরে গেছে ফুলে ফুলে। অন্য পাশের বাগানে একটা শিমুল গাছেও ফুলে ফুলে ছয়লাপ। শালিক, বুলবুলি আর কাকেরা কী মজা করে খাচ্ছে ফুলের নরম কেশর। তখন উত্তর সকাল। দুটো অজানা পাখি এসে কী ভাবে খাচ্ছে ফুলের কেশর আর পাপড়ি। এই ফাল্গুনের দিনে বিগত কালের কত স্মৃতি ফেলে এসে আজ ইট কাঠ সিমেন্টের দেশে বন্দি জীবন।

বাজারের থলে নিয়ে পথে বেরোলেই গুনগুনিয়ে গান গায় দেখি, হালদার মশাই। পাশে ব্যস্ত পায়ে তরুণী হয়তো মুচকি হাসে। হাসুক না, কিছুই যায় আসে না তার। ভুবনেশ্বর হালদার ভাবে, মানুষের মনে প্রত্যেক ঋতুর একটা প্রভাব তো পড়ে, সেটা প্রমাণিত সত্য। পূর্বজ কবি, গীতিকার সৃষ্টি করে গেছেন ঋতু বৈচিত্র্যের হৃদয় ছোঁয়া কবিতা আর গান। আজও সেইসব সৃষ্টি কত যে প্রাসঙ্গিক, বর্তমান প্রজন্ম না বুঝলেও প্রবীণদের কাছে অমূল্য রতন। গ্রাম বাংলার পথে প্রান্তরে এই বসন্ত ছড়িয়ে দিয়েছে ফুল, বাতাসে ছড়িয়ে দিয়েছে সুবাস। সবুজ পল্লবে পল্লবে সেজেছে গাছের সারি, ঝোপঝাড়। জীবনানন্দের প্রিয় ভাঁট ফুলের আজ উৎসব গ্রামের পথের দুপাশে। গুনগুনিয়ে গান থেকে এই রকম আবেগ মথিত ভাবনা হালদার বাবুর মনে খেলছিল। এমন সময় বাজারে ঢোকার মুখে দেখে একজন বয়স্কা মহিলা কলাপাতা বিছিয়ে চুপড়ি খানেক যুক্তিফুল নিয়ে বসে আছে। সদ্য তোলা সেই ফুল দেখে কেনার লোভ হল। এবং সবটুকুই কিনে নিয়ে মূল বাজারে ঢুকলেন। যুক্তি ফুলের সঙ্গে তার কিশোর কালের স্মৃতি যে জড়িত।

ঘরে ফিরে দেখেন অতিথি হাজির। মনটা ভরে গেল ,কতদিন পরে গৃহিণীর ভাইঝি সেই সুদূর মাইথন থেকে তার ছেলেকে নিয়ে পিসিমার বাড়ি এসেছে। কত প্রশ্ন কত কথা ঘর ময় ছড়িয়ে পড়ছে। ছটফটে কিশোর ছেলেটা দেখি আমাদের পোষা বিড়ালের সঙ্গে ভাব জমাবার চেষ্টা করে। আবছা আবছা চেনে আমার। মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে কেমন লাজুক লাজুক ভাব। পিসিমার সঙ্গে ভাইঝির এক গঙ্গা গল্প বাকি ছিল, সব কপাট খুলে দিয়ে ওরা গল্পে মজেছে। হালদার মশাই বাধা না দিয়েই শুধু শুনেই চলেছে।

দুপুরে খাওয়ার টেবিলে ভুবনেশ্বর বাবু একটু সুযোগ পেলেন, দুটো কথা বলার। জামাই আসেনি ছুটি পায়নি, ছেলের স্কুলে খুব পড়ার চাপ, দুদিনের ছুটি স্কুলে তাই এই আসার সুযোগ হল। কতদিন আমাদের দেখেনি তাই বাপের বাড়ি না গিয়ে এখানে । ছেলে পড়ে ইংলিশ মিডিয়ামে , তার পিছনে সময় দিতে কী হিমসিম অবস্থা। ওদের স্কুলে দ্বিতীয় ভাষা হিন্দি। বাংলা বর্ণপরিচয়-এর সঙ্গে কোন পরিচয় হল না।…

ওরা দুপুরের বিশ্রাম নিচ্ছিল। ভুবনেশ্বর বাবু অবাক হয়ে ভাবছিলেন, বাঙালির ছেলে স্কুলে যাচ্ছে অথচ স্বরবর্ণ – ব্যঞ্জনবর্ণ জানে না। অর্থাৎ বাংলা বই তার কাছে অচ্ছুৎ! এখন গর্বিত বাংলার ঠাকুরদা সম্প্রদায় এই নাতিদের নিয়ে কী গর্ব করবে! ভুবনেশ্বর হালদার জানে এই রকম ঘটনা ঘটছে, নীরবে। সবাই জানে না, তা কিন্তু নয়। যখন সে যৌবনে চাকরিতে, এমন ঘটনা শুনে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে ছিল অনিমা গুহ দিদির দিকে। তিনি ছিলেন এক সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা। স্বামীর অকাল প্রয়াণে একমাত্র সন্তানের মুখ চেয়ে অনন্যোপায় হয়ে চাকরি নিয়েছিলেন। খুব পরোপকারী এবং সোজা কথা সোজাসুজি বলতেন। ভুবনেশ্বর বাবুকে খুবই স্নেহ করতেন। এবং গ্রামের ছেলেকে শহুরে আদব কায়দা রপ্ত করতে বিশেষ ভূমিকা ছিল তাঁর। তাঁর মুখে শুনেছিলেন প্রায় চল্লিশ বছর আগে। কলকাতার অভিজাত গুহ পরিবারের নাতিদের ভর্তির বন্দোবস্ত খুব সহজেই হয়ে যেত নামী ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে। বাংলা বইয়ের সংস্পর্শে তারা ছিল না, ইংরেজিতে স্মার্ট। প্রয়োজন ছিলনা বাংলা ভাষার, হিন্দি আর ইংরেজিতে সবাই চোস্ত। তাদের প্রয়োজন হত না, কারণ খাদ কলকাতার পারিবারিক ও পারিপার্শ্বিক বাতাবরণ ছিল এবং এখনও আছে ওই হিন্দি আর ইংরেজির অনুকূলে।

ভাইঝিটিকে ভুবনেশ্বর বলে, – ছেলেকে বাংলা শেখাতে পারিস বাড়িতে, অন্তত স্কুলের পড়ার বাইরে বাংলা ছোটদের গল্পের বই পড়তে পারে। তার উত্তর, – বাংলা কথা বোঝে আর বলে তো, শুধু পড়তে পারে না। বাড়িতে শেখানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু স্কুলের পড়ার এত চাপ! ভুবনেশ্বর ভাবে, – শুধু কী এই একটা পরিবারের সন্তান! বাংলার কত না ঘরে ঘরে এই ইংরেজির প্রতি মোহ, শুধু মাত্র উচ্চ আয়ের উচ্চ সমাজ উন্নত জীবনরেখার তাগিদে। যেখানে মাটির মানুষের সঙ্গে ভেদ রেখা স্পষ্ট।

বিষয়টা একলা ভুবনেশ্বর ভেবে বা কী করে! ইংলিশ মিডিয়ামের প্রতি এখন ঝোঁক সর্বত্র। চোখ কান খোলা রাখলে দেখা যায়, সকাল হলেই সবে মাত্র হাঁটা শেখা সন্তানকে বেশ যত্ন করে সাজিয়ে নিয়ে স্কুলে যাচ্ছে মাতৃকুল। সে ধনী, না ধনী সবাই। পথের কুকুরকে দেখিয়ে বলছে শিখে নাও ওটি ডগ, ওটি ক্যাট, ওটি বার্ড, পাশে দেখ কত গ্রাস ইত্যাদি ইত্যাদি। একবারও বলছে না কিন্তু, – কুকুরের ইংরেজি ডগ, বিড়ালের ইংরেজি ক্যাট, ঘাস হল গ্রাস।
মনে হয় না কী, শুধু মাত্র ইংরেজি শব্দ দিয়ে করতে চাইছে প্রকৃতি পরিচয়!

ভুবনেশ্বর বাবু ভাবে, আরও অনেক মানুষ ভাবছে, কিন্তু সমাধান সূত্র কোথায়! সমাজের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট কোন এক অজানা বিশ্বায়নের দিকে ধাবমান, কোথায় গিয়ে থামবে কেউ জানে না। …. দু দিন পর অতিথি বিদায়কালে মনটা স্বাভাবিক বিষণ্ন। ছটফটে নাতিটি টাটা বলতে বলতে মায়ের হাত ধরে ফিরে যাচ্ছে তাদের বর্তমান ঠিকানায়। ভুবনেশ্বর বাবু ঘরে এসে ভাবনার ঘরে চলে গেল। নিজের আলমারিতে যত্ন করে সাজানো বাংলার স্বর্ণযুগের কবি সাহিত্যিক সমূহের ধ্রুপদী বাংলা সাহিত্যের সৃষ্টিগুলি পড়বে কারা!

কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | Krishna Kishore Middya

Fathers Day History | পিতৃ দিবসের ইতিহাস ও বাঙালি আবেগ | 2023

Emblem of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের প্রতীকের অর্থ | নক্‌শা ও তাৎপর্য | 2023

Advantages & Disadvantages of Tattoo | ট্যাটুর উপকারিতা এবং অপকারিতা | Bengali Article 2023

ট্যাটুর ইতিহাস ও আমরা | History of Tattoo | Reasons for using tattoos | 2023

Shabdodweep Web Magazine | Modern Online Bangla Galpo | Krishna Kishore Middya

The world of Bengali literature has always been rich with creativity and cultural significance. However, with the rapid advancement of technology, a new era of Modern Online Bangla Galpo (modern Bengali stories) has emerged, reshaping the way readers connect with Bengali storytelling. Online platforms have made it easier than ever for readers to access Bangla Golpo (Bengali stories) from both established and emerging writers, sparking a renaissance of Bengali literature in the digital space.

Among the many platforms contributing to this revolution, Shabdodweep Web Magazine stands out as a significant player. Known for its diverse collection of contemporary Bengali stories, poetry, and essays, Shabdodweep Web Magazine has become a key destination for readers seeking high-quality Bangla Golpo. Bengali writer Krishna Kishore Middya has contributed several thought-provoking stories to this platform, showcasing his talent and solidifying Shabdodweep’s place in the landscape of Modern Online Bangla Galpo.

In this article, we will delve into the growing significance of Modern Online Bangla Galpo, the role of Shabdodweep Web Magazine in promoting this genre, and the contributions of writers like Krishna Kishore Middya to the evolving world of Bengali Literature.

What is Modern Online Bangla Galpo?

Modern Online Bangla Galpo refers to contemporary Bengali stories that are published and shared on digital platforms. Unlike traditional print publications, these stories are accessible to a global audience via the internet. Whether through websites, blogs, or online magazines, Modern Online Bangla Galpo offers readers an easy way to enjoy Bengali literature without geographical constraints.

The world of Bangla Golpo has evolved significantly in recent years. Writers now have the freedom to experiment with various writing styles, themes, and formats, making the genre more diverse and exciting. Additionally, digital platforms like Shabdodweep Web Magazine have opened up space for emerging Bengali writers to showcase their work to a wider audience, enriching the field of Bengali Literature.

Shabdodweep Web Magazine: A Leading Platform for Bengali Literature

One of the most prominent online platforms that publish Modern Online Bangla Galpo is Shabdodweep Web Magazine. This platform has established itself as a hub for modern Bengali literature, featuring a wide array of stories, poems, and essays by talented writers. With a particular focus on contemporary themes, Shabdodweep provides a space where writers can share their voices, explore new ideas, and engage with a growing community of readers.

Krishna Kishore Middya, a Bengali Writer, is one of the most notable contributors to Shabdodweep Web Magazine. His evocative and deeply emotional stories have earned him recognition in the world of Modern Online Bangla Galpo. Through his contributions, Krishna Kishore Middya has captured the essence of contemporary Bengali life, touching on social issues, personal struggles, and the complexities of human relationships.

For readers, Shabdodweep Web Magazine serves as a portal to explore Bangla Golpo in all its modern forms. Whether you’re looking for short stories that reflect societal changes or poetic expressions that capture the beauty of Bengali culture, Shabdodweep offers an extensive collection that caters to all tastes.

The rise of Modern Online Bangla Galpo can be attributed to several factors, which have made it increasingly popular among both young and mature readers alike.

  1. Accessibility and Convenience
    In today’s fast-paced world, people often prefer consuming content digitally. With the availability of smartphones, tablets, and laptops, readers can now enjoy Bangla Golpo at their convenience, wherever they are. Online platforms provide easy access to a vast collection of stories and poems, making it much more convenient than traditional print media.
  2. Diverse and Inclusive Content
    One of the key advantages of Modern Online Bangla Galpo is the wide variety of stories it offers. Online magazines like Shabdodweep Web Magazine feature works from a diverse range of writers, offering fresh perspectives on Bengali culture, politics, and society. The content is more inclusive, embracing a variety of themes, from modern-day struggles to personal reflections and societal critiques.
  3. Creative Freedom for Writers
    The digital medium gives writers the creative freedom to experiment with different styles and formats. This has led to the emergence of unique storytelling approaches in Bangla Golpo. Whether it’s experimental fiction or contemporary narratives with a twist, online platforms allow writers to explore their creativity without the constraints of traditional publishing.
  4. Engagement and Community Building
    Unlike print media, digital platforms provide readers with the opportunity to directly engage with writers. Comment sections, social media platforms, and discussion forums allow fans to connect with their favorite authors, share their thoughts, and discuss the stories. This fosters a sense of community and strengthens the connection between writers and readers.

Krishna Kishore Middya: A Bengali Writer

Krishna Kishore Middya is one of the voices in Modern Online Bangla Galpo. His works often explore the complexities of human emotions, societal pressures, and the internal struggles individuals face in an ever-changing world. Krishna Kishore Middya’s writing is known for its depth, sensitivity, and relatability, making his stories stand out in the landscape of Bengali Literature.

His stories featured on Shabdodweep Web Magazine have garnered widespread praise for their emotional resonance and insightful observations about modern-day Bengali life. Middya’s work resonates with readers across generations, making him one of the most important contributors to contemporary Bangla Golpo.

For readers looking to explore compelling Bangla Golpo, Krishna Kishore Middya’s stories on Shabdodweep Web Magazine are a must-read. His writing continues to inspire and challenge the boundaries of Bengali Literature in the digital age.

Conclusion

The world of Modern Online Bangla Galpo has transformed the way we experience Bengali literature. Platforms like Shabdodweep Web Magazine play a crucial role in bringing together writers, readers, and diverse narratives, creating a vibrant ecosystem for Bengali storytelling. Krishna Kishore Middya, with his profound and evocative storytelling, is a key figure in this literary movement, contributing significantly to the popularity of Bangla Golpo online.

As digital platforms continue to gain prominence, Modern Online Bangla Galpo is set to play an even more significant role in the future of Bengali literature. If you are passionate about exploring contemporary Bengali stories, Shabdodweep Web Magazine offers a treasure trove of literary gems that will keep you coming back for more.

FAQ Section: Modern Online Bangla Galpo and Shabdodweep Web Magazine

Q1: What is Modern Online Bangla Galpo?
A: Modern Online Bangla Galpo refers to contemporary Bengali short stories that are published on digital platforms like websites and online magazines. These stories are easily accessible to a global audience and explore a wide range of modern-day themes and narratives.

Q2: Why should I read Modern Online Bangla Galpo on Shabdodweep Web Magazine?
A: Shabdodweep Web Magazine features a curated selection of high-quality Bangla Golpo by writers like Krishna Kishore Middya. The platform offers fresh, diverse stories that reflect the changing dynamics of Bengali society, making it an ideal space for readers looking for engaging contemporary literature.

Q3: Who is Krishna Kishore Middya?
A: Krishna Kishore Middya is a Bengali Writer whose works have contributed significantly to the world of Modern Online Bangla Galpo. His stories, featured on Shabdodweep Web Magazine, are known for their emotional depth, thought-provoking themes, and relevance to contemporary Bengali life.

Q4: How can I access Modern Online Bangla Galpo?
A: You can access Modern Online Bangla Galpo on platforms like Shabdodweep Web Magazine. Simply visit the website and explore a variety of Bangla Golpo by various writers, including Krishna Kishore Middya.

Q5: Can I contribute my own stories to Shabdodweep Web Magazine?
A: Yes, Shabdodweep Web Magazine welcomes submissions from new writers. If you have a unique and engaging Bangla Golpo, you can submit it for consideration and potentially be featured on the platform.

By embracing the digital age, Modern Online Bangla Galpo has opened up new avenues for writers and readers alike. Platforms like Shabdodweep Web Magazine are leading the charge in reshaping the future of Bengali literature, making it more accessible, diverse, and exciting for audiences around the world.


Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio

Leave a Comment