Jagannath in pottery influenced by Chaitanya – Avijit Pal
চৈতন্য প্রভাবিত বঙ্গের মৃৎশিল্পে জগন্নাথ – অভিজিৎ পাল
প্রাগাধুনিক সময়পর্বের ষোড়শ শতাব্দীতে বঙ্গবাসী যখন অহিন্দু শাসকদের কাছে দিনের পর দিন শাসিত ও শোষিত হয়ে চলেছে তখন হতশ্রী বাঙালি জাতিকে ঐশীবোধের অমোঘ স্পর্শ দিয়ে ঐক্যবদ্ধ করে এক নবজাগ্রত চেতনায় উজ্জীবিত করে তুলেছিলেন মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। চৈতন্যদেব যখন জন্মেছিলেন তখন বঙ্গদেশের হিন্দু বাঙালি স্বধর্ম পালনের সাধারণ অধিকার হারাতে শুরু করেছিল। স্বৈরাচারী অহিন্দু শাসকের তরোয়ালের ভয়ে বাধ্য হয়ে বহু মানুষ ধর্ম পরিবর্তন করতে শুরু করেছিল। পূর্ব-সন্ন্যাসজীবনে নবদ্বীপের শ্রেষ্ঠ নৈয়ায়িক পণ্ডিত রূপে তিনি সম্যক প্রতিষ্ঠা পেয়েছিলেন। দিগ্বিজয়ী পণ্ডিত তাঁর কাছে এসে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়ে নতিস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু বৈরাগ্যের আগুন তাঁকে স্পর্শ করেছিল। বৈরাগ্যাগ্নি স্পর্শের পর তিনি অবলীলায় গৃহ-জন-মান-যশ সমস্ত কিছু নিমেষের মধ্যে ত্যাগ করে কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণ করেছিলেন।১ সন্ন্যাস গ্ৰহণের পর তাঁর সন্ন্যাসনাম হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য ভারতী।
কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাস গ্রহণের বহুদিন আগে থেকেই চৈতন্যদেব বাঙালি সমাজের সার্বিক সংস্কার শুরু করেছিলেন। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের ধর্মজীবনের ওপর বাংলার অহিন্দু শাসকের অভব্য জুলুমের বিরুদ্ধে তিনি সজ্ঞানে সুপরিকল্পিতভাবে সমবেত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। চৈতন্যদেবের অপার পৌরুষের বলে বলিয়ান হয়ে সাধারণ হিন্দু জনতা শাসকের ধর্মীয় শোষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছিলেন।২ জনতার মধ্যে হরিনামের মাধুর্য বিলিয়ে দিতে দিতে নগরসংকীর্তন করে তিনি নবদ্বীপের মাটিতে এক নতুন ধারার বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। তিন স্তরের বিরাট এক সংকীর্তনের দলের প্রথম স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হরিদাস ঠাকুর, মধ্যের স্তরে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অদ্বৈত আচার্য এবং শেষ স্তরে তথা সমগ্র বিরাট দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন একসঙ্গে চৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দ।৩ চৈতন্যদেবের অহিংস বিপ্লবের বিরাট স্বরূপ দেখে আঞ্চলিক প্রশাসক চাঁদ কাজী রীতিমতো ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে লুকিয়ে পড়েছিলেন। কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী এই প্রসঙ্গে ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-তে লিখেছেন :
কীর্তনের ধ্বনিতে কাজী লুকাইল ঘরে।
তর্জন গর্জন শুনি না হয় বাহিরে।।৪
চৈতন্য মহাপ্রভুর জনগণের নেতৃত্ব হিসেবে এই বিশেষ প্রকাশের ইতিবৃত্ত বৃন্দাবন দাস গোস্বামীর ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত’-এ আরও অনুপুঙ্খ ও বিস্তারিত রয়েছে। এই চাঁদ কাজী খুব সাধারণ লোক ছিলেন না। কথিত, চাঁদ কাজী স্বয়ং গৌড়েশ্বর নবাব হোসেন শাহের অন্যতম প্রিয় দৌহিত্র ছিলেন।৫ মতভেদে তিনি নাকি হোসেন শাহের গুরুদেব ছিলেন।৬ চাঁদ কাজীর সঙ্গে গৌড়েশ্বরের প্রকৃত সম্পর্ক ঠিক কী ছিল তা এখানে আলোচ্য বিষয় নয়। শুধু একটি ঐতিহাসিক তথ্য এখানে অনুধাবনের বিষয় যে, এই চাঁদ কাজীই তখন নবদ্বীপের যথেষ্ট ক্ষমতাবান স্থানীয় প্রশাসক ছিলেন এবং তিনি গৌড়েশ্বরের সুনজরে ছিলেন। গৌড়েশ্বর হোসেন শাহের এমন প্রিয়পাত্রকে যিনি ভীত করার ক্ষমতা রাখেন সেই চৈতন্য মহাপ্রভুর সংগঠক ক্ষমতা, নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা, মানুষকে উজ্জীবিত করার ক্ষমতা ও সামাজিক বিপ্লবের ক্ষমতা, কেমন ছিল তা সহজেই এখন অনুমেয়। হিন্দুদের ধর্মযাপনের যে স্বাভাবিক অধিকার ভারতভূমিতে আবহমান কাল থেকে প্রচলিত ছিল, নবদ্বীপের সাধারণ মানুষকে সেই আবহমান অধিকারকেই আবার ফিরিয়ে দিতে চাঁদ কাজী বাধ্য হয়েছিলেন। অবশ্য চৈতন্যদেবের সংস্পর্শে এসে ও চৈতন্যপ্রভাবিত পূর্বোক্ত জনরোষ দেখে কাজী নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন।
চাঁদ কাজী বুঝেছিলেন চৈতন্যদেব সাক্ষাৎ অগ্নি। চৈতন্যদেবের অগ্নিস্পর্শে স্তিমিত বাঙালি হিন্দু জাতির প্রতিটি মানুষের চেতনার দীপশিখা জ্বলে ওঠা শুধু সময়ের অপেক্ষা। চৈতন্যদেবের এই অহিংস গণ-আন্দোলনের সাফল্যের কথা মানুষের মুখে মুখে নবদ্বীপের গণ্ডি ছাড়িয়ে গ্ৰামে গ্রামান্তরে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালি হিন্দুরা বুঝতে পেরেছিলেন এবার তাদের সার্বিক জাগরণের সময় উপস্থিত, তাদের উত্তরণের কাণ্ডারীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছে। চৈতন্যদেবের অভ্যুত্থান ও বাঙালি হিন্দুদের জেগে ওঠার সংবাদ পৌঁছে গিয়েছিল বঙ্গের শাসকের দরবারে।৭ অদ্বৈত আচার্য, গঙ্গাদাস পণ্ডিত সহ নবদ্বীপের প্রাচীন বৈষ্ণবরাও বুঝতে পেরেছিলেন চৈতন্যদেবই সেই ব্যক্তি যিনি মৃতচেতনায় আচ্ছন্ন সমগ্র জাতিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারেন। তাই নবদ্বীপের প্রাচীন বৈষ্ণবরা চৈতন্যদেবকে তাঁর যে কোনো প্রচেষ্টায় বিনা দ্বিধায় অসপত্ন সমর্থন করতে শুরু করেছিলেন। নবদ্বীপের বৈষ্ণব সমাজের প্রাচীনদের এই নির্ভরতা, সমবয়স্কদের সমর্থন ও নবীনদের সহযোগিতা চৈতন্য মহাপ্রভুকে তৎকালীন সমাজ-সংস্কৃতির সংস্কারে মনোযোগী করে তুলেছিল। চৈতন্যদেবের চিন্তাচেতনার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাব এসে পড়তে শুরু করেছিল বাংলার ধর্ম, সাহিত্য, শিল্প, কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও সমাজে। শুরু হয়েছিল বাংলার প্রথম নবজাগরণ।৮ পরবর্তী সময়ে ইতিহাস যাকে চৈতন্য-রেনেসাঁ বলে চিহ্নিত করতে বাধ্য হয়েছে।
কেশব ভারতীর কাছে সন্ন্যাসগ্ৰহণের অনেক আগে থেকেই সাধারণ মানুষের চোখে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব যে উচ্চতায় অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন তাতে চৈতন্যদেব চাইলেই তৎকালীন বঙ্গসমাজে প্রচলিত লোকসংস্কার বা লোকাচার অতিক্রম করে সন্ন্যাসের পরেও নবদ্বীপে অবস্থান করতে পারতেন। অদ্বৈত আচার্য, নিত্যানন্দ প্রভু সহ শান্তিপুর ও নবদ্বীপের অনেক বৈষ্ণবই চেয়েছিলেন সন্ন্যাসী চৈতন্যদেব যেন এই অঞ্চল ছেড়ে অন্যত্র না চলে যান। চৈতন্যদেব কিন্তু সন্ন্যাসীর প্রচলিত আদর্শ থেকে বিচ্যুত হতে তিনি চাননি। তিনি সন্ন্যাসের পর বৃন্দাবনবাসী হতে চেয়েছিলেন। জননী শচী দেবীর ‘‘নীলাচলে নবদ্বীপে যেন দুই ঘর।/ লোক গতাগতি বার্তা পাব নিরন্তর।।’’৯ পরামর্শ মেনে স্বভূমি ত্যাগ করে তিনি শ্রীক্ষেত্রে স্থায়ীভাবে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। তৎকালীন সময়ে বঙ্গের নবদ্বীপ, সপ্তগ্রাম, অগ্ৰদ্বীপ প্রভৃতি বৈষ্ণব অধ্যুষিত জনপদ থেকে বহু মানুষ পুরীধামে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। শিবানন্দ সেন পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের দলে দলে একাধিকবার পুরীতীর্থে নিয়ে গিয়েছিলেন। নবদ্বীপের মানুষের পুরীতীর্থে নিয়মিত যাতায়াত থাকায় চৈতন্যদেবের সংবাদ সহজেই শচী দেবী পাবেন এই আশা রেখেছিলেন।
চৈতন্যদেব পদব্রজে ছত্রভোগ হয়ে উৎকলে প্রবেশ করেছিলেন। পথে তাঁর সঙ্গে রামচন্দ্র খাঁর সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেই সময় উৎকল ও বঙ্গের প্রশাসকদের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের সংঘর্ষ চলছিল। রামচন্দ্র খাঁ চৈতন্যদেবকে এই বিষয়ে অগ্রীম সতর্ক করে দিয়েছিলেন।১০ চৈতন্যদেব সমকালের রাজনৈতিক পরিস্থিতির জটিলতা সম্পর্কে সচেতন হলেও জগন্নাথদর্শনের অধীর আকাঙ্ক্ষা ও শ্রীক্ষেত্রের প্রতি তাঁর আকর্ষণ সমসাময়িক রাজনৈতিক জটিলতা তাঁর মনে বিশেষ একটা দাগ ফেলতে দিতে পারেনি। পুরীধামে পৌঁছে প্রথমবার দারুব্রহ্ম পুরুষোত্তম জগন্নাথের দর্শন করেই তিনি বাহ্যচেতনা হারিয়ে আত্মস্থ হয়ে পড়েছিলেন।১১ এই সময় চৈতন্যদেব যেন জগন্নাথের মধ্যে আত্মদর্শন করেছিলেন।
পুরীধামে প্রথমবার অবস্থানের শুরুতেই নবীন সন্ন্যাসী চৈতন্যদেবের সঙ্গে পণ্ডিত বাসুদেব সার্বভৌমের পরিচয় হয়েছিল। বাসুদেব সার্বভৌমের সঙ্গে উৎকলের গজপতি মহারাজা প্রতাপরুদ্র দেবের নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। বাসুদেব সার্বভৌমের কাছে কিছুদিন অবস্থান করার পরে চৈতন্যদেব দাক্ষিণাত্যে পরিব্রজ্যায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।১২ দাক্ষিণাত্যে পরিব্রাজক অবস্থায় চৈতন্যদেব একাধিক তীর্থদর্শন করেছিলেন। দাক্ষিণাত্যে পরিব্রজ্যাকালে চৈতন্যদেব শ্রীরঙ্গমে দীর্ঘ সময় অবস্থান করতে মনস্থির করেছিলেন। এই সময়ে তাঁর সঙ্গে রামানুজপন্থী ব্রাহ্মণ বেঙ্কট ভট্টের পরিচয় হয়েছিল। চৈতন্যদেব বেঙ্কট ভট্টের অনুরোধে তাঁর গৃহে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন।১৩ তবে এই বিষয়ে মতানৈক্য রয়েছে যে, চৈতন্যদেব বেঙ্কট ভট্টের পরিবারে নয়, ত্রিমল্ল ভট্টের পরিবারে আতিথ্য নিয়েছিলেন। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের প্রত্যক্ষ প্রভাবে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজপন্থা থেকে বেঙ্কট ভট্ট ও তাঁর পরিবার গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের ভক্তিবাদে স্থিত হয়েছিলেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের একাংশের মতে এই বেঙ্কট ভট্টের পুত্রই গোপাল ভট্ট।১৪ প্রাচীন বৈষ্ণব মহাজনের মধ্যে নরহরি চক্রবর্তী, জগদ্বন্ধু ভদ্র ও রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন সহ প্রমুখ গোপাল ভট্টকে বেঙ্কটাত্মজ বললেও এর বিপক্ষে মুরারি গুপ্ত ও মনোহর দাসের মতো বৈষ্ণব মহাজন তাঁকে ত্রিমল্ল ভট্টের পুত্র বলেছেন। তবে অধিকাংশ গৌড়ীয় বৈষ্ণব মহাজন গোপাল ভট্টকে নরহরি চক্রবর্তীর ‘ভক্তিরত্নাকর’-এর সূত্র ধরে বেঙ্কটাত্মজ বলেই বন্দনাগান বা স্তব করেন। তিনি পরবর্তী সময়ে চৈতন্যদেবের প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে বৈরাগ্য গ্ৰহণ করে বৃন্দাবনে এসে চৈতন্যের অন্যতম অন্তরঙ্গ পরিকর রূপ গোস্বামী ও সনাতন গোস্বামীর সঙ্গে মিলিত হয়েছিলেন। আরও পরবর্তীতে গোপাল ভট্ট বৃন্দাবনের ষড়্গোস্বামীর অন্যতম গোস্বামী হয়ে উঠেছিলেন। দুর্ভাগ্যবশত ষড়্গোস্বামীর মধ্যে গোপাল ভট্ট গোস্বামীর সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামী সহ কোনো প্রাচীন মহাজন বৈষ্ণবই দিতে পারেননি। ভক্তিরত্নাকরের প্রথম তরঙ্গ থেকে আভাস পাওয়া যায়, খুব সম্ভবত এই বিষয়ে গোপাল ভট্টের অসম্মতি ছিল :
কৃষ্ণদাস কবিরাজ মহাহৃষ্ট হইয়া।
বর্ণিলেন গ্ৰন্থ অনেকের আজ্ঞা লইয়া।।
শ্রীগোপাল ভট্ট হৃষ্ট হইয়া আজ্ঞা দিল।
গ্ৰন্থে নিজ প্রসঙ্গ বর্ণিতে নিষেধিল।।১৫
কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীর ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’-এ রয়েছে, দাক্ষিণাত্যে মহাপ্রভু বেঙ্কট ভট্টের পরিবারে অবস্থানকালে চাতুর্মাস্য ব্রত পালন করেছিলেন।১৬ পুরীতে প্রথমবার জগন্নাথদর্শনেই জগন্নাথের প্রতি মহাপ্রভুর যে দিব্যপ্রেমের সঞ্চার হয়েছিল জগন্নাথের প্রতি সেই প্রেম তিনি পরিব্রাজক অবস্থাতেও হৃদয়ে বহন করে এনেছিলেন। জগন্নাথের থেকে কায়িক দূরত্ব বাহ্যভাব অবস্থায় তাঁর মনে বিরহ জাগিয়ে তুলতে শুরু করেছিল। জগন্নাথের বিরহতাপ থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য চৈতন্যদেব মাটি দিয়ে নিজে হাতে জগন্নাথের বিগ্রহ তৈরি করে বেঙ্কট ভট্টের পরিবারে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।১৭ চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রতিষ্ঠিত এই জগন্নাথ বিগ্রহের মুখমণ্ডলে বাংলার মাটির জগন্নাথের মতো চোখ, নাক, ঠোঁট, কান, গলা নিখুঁতভাবে রয়েছে। এই মন্দিরের জগন্নাথ বিগ্ৰহের বসার ভঙ্গিমাতে বঙ্গীয় মৃৎবিগ্ৰহের নিজস্ব শৈলী প্রতিফলিত হয়েছে। এছাড়া জগন্নাথ বিগ্ৰহের পরিধানে বঙ্গীয় বস্ত্ররীতির ছাপ রয়েছে। তবে পার্থক্য রয়েছে জগন্নাথ বিগ্ৰহের মাথার চূড়া বা মুকুটের অংশে। দাক্ষিণাত্যের দেববিগ্রহের মুকুট ও অন্য অলংকারের গড়ন বঙ্গের নিজস্ব অলংকারের শৈলী থেকে অনেকটা আলাদা। চৈতন্যদেব প্রতিষ্ঠিত এই জগন্নাথ বিগ্রহের মাথায় যে মুকুটের মতো অংশটি রয়েছে তাতে দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পরীতিতে তৈরি অলংকারের আভাস রয়েছে। অনুমিত হয়, জগন্নাথের এই মৃৎবিগ্রহ তৈরির সময় বঙ্গীয় মৃৎশিল্পের প্রকরণ চৈতন্য মহাপ্রভু গ্ৰহণ করার পাশাপাশি জগন্নাথের অলংকার বিন্যাসে দক্ষিণ ভারতীয় প্রকরণের ব্যবহার করে উভয় ধারার সংস্কৃতির প্রতিই সম্মান জ্ঞাপন করেছিলেন।

চৈতন্যদেব শ্রীরঙ্গমে বসবাসের সময় শ্রীরঙ্গনাথ স্বামীর নিত্যসেবা দেখতেন।১৮ মহাপ্রভুর অবস্থানভূমির থেকে শ্রীরঙ্গম মন্দিরের দূরত্ব বেশি ছিল না। বঙ্গের কৃষ্ণ, উৎকলের জগন্নাথ, দক্ষিণের শ্রীরঙ্গনাথ স্বামী চৈতন্য মহাপ্রভুর দৃষ্টিতে আলাদা ছিলেন না। হয়তো তাই চৈতন্যদেবের হাতে গড়া মাটির তৈরি এই জগন্নাথ বিগ্রহে এমন একটি মিশ্র ভাব দেখা যায়। আবার এমন ঘটাও খুব অস্বাভাবিক নয় যে, বেঙ্কট ভট্টের পরিবারের জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরির সময় চৈতন্যদেব তত্ত্বাবধান করেছিলেন এবং তিনি মূর্তি নির্মাণের সময় তাঁর সহযোগী কোনো দক্ষিণ ভারতীয় শিল্পীকে জগন্নাথের অলংকার বিন্যাসের সময় যথেষ্ট স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। ফলে জগন্নাথ বিগ্রহে বঙ্গীয় ও দক্ষিণ ভারতীয় উভয় ধারার শিল্পরীতির সরাসরি প্রভাব পড়েছে। চৈতন্যদেব প্রতিষ্ঠিত এই সপার্ষদ জগন্নাথ বিগ্রহের জগন্নাথের প্রায় উচ্চতায় একই ভঙ্গিতে রয়েছে বলভদ্রদেবের বিগ্রহ এবং জগন্নাথ-বলভদ্রের মধ্যে অবস্থিত সুভদ্রা দেবীর বিগ্রহ জগন্নাথ-বলরামের থেকে সামান্য একটু ছোট উচ্চতার। তবে সুভদ্রা দেবীর মাথায় দক্ষিণ ভারতীয় দেবীবিগ্রহের রীতিতে একদিকে হেলানো চুলের খোঁপা রয়েছে। বাংলার অনেক জগন্নাথ মন্দিরেই সুভদ্রা দেবীর মাথায় চুলের বিন্যাস দেখা যায়, তবে এই রীতিটি ওড়িশায় নেই। জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে আবশ্যিকভাবে সুদর্শন বিগ্রহের আয়োজন ওড়িশায় রয়েছে, এই রীতিটি দীর্ঘদিন ধরে বঙ্গে ও অন্যত্র অপ্রচলিত ছিল। এমনকি হুগলির মাহেশের জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গেও দণ্ডবৎ কোনো সুদর্শন বিগ্রহ দেখা যায় না। মাহেশের জগন্নাথ চৈতন্য-পূর্ববর্তী সময়ের দারুবিগ্রহ।১৯
চৈতন্য পূর্ববর্তী সময়ের বঙ্গের জগন্নাথ বিগ্রহের মধ্যে একমাত্র মাহেশের জগন্নাথের বিগ্রহই কোনোদিন নবকলেবর না হওয়ায় এখনও পর্যন্ত সম্পূর্ণ অবিকৃত রয়েছে। চৈতন্য মহাপ্রভু প্রতিষ্ঠিত বেঙ্কট ভট্টের পরিবারের জগন্নাথ বিগ্রহের রঙ নীল। নীল রঙের জগন্নাথ ওড়িশায় দেখা যায় না। ওড়িশায় জগন্নাথ মাত্রেই ঘন কালো। তবে বহু নীল জগন্নাথ সারা পূর্ববঙ্গে এখনও বিভিন্ন মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত রয়েছেন। পূর্ববঙ্গের অন্যতম প্রাচীন নীল জগন্নাথ রয়েছেন হাণ্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দিরে।২০ কথিত হাণ্ডিয়ালের জগন্নাথ মন্দিরের দারুনির্মিত জগন্নাথ বিগ্রহ চৈতন্যদেবের সমসাময়িক। তবে এই বিষয়ে বহুজনের দ্বিমত রয়েছে। হাণ্ডিয়ালের জগন্নাথ যদি বাস্তবিকই চৈতন্যদেবের সমসাময়িক হয়ে থাকে, তবে স্বসংস্কৃতি-সচেতন মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের কাছে হাণ্ডিয়ালের জগন্নাথ বিগ্রহের কথা অজানা ছিল বলে মনে হয় না। বেঙ্কট ভট্টের পরিবারে চৈতন্য মহাপ্রভুর জগন্নাথ প্রতিষ্ঠার সময় থেকেই তাই জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের রঙ নীল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। মহাপ্রভু প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথের এই মৃৎবিগ্রহ এত বছরে ধরে বহুবার অঙ্গরাগ করা হলেও তাঁর নীল রঙটি পূর্ব ঐতিহ্য স্মরণে রেখে বদল করা হয়নি।
মহাপ্রভু চৈতন্যদেব বাঙালির ধর্ম-কর্ম-কৃষ্টি-সংস্কৃতির স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন। অখণ্ড বঙ্গদেশের নিজস্ব মৃৎশিল্প ও মাটি দিয়ে প্রতিমা নির্মাণের পরম্পরার সঙ্গে তাঁর পরিচয়ও নিশ্চয়ই ছিল। বঙ্গদেশের প্রাচীন মন্দিরে পাথরের তৈরি বিগ্রহের সংখ্যা খুবই কম। পাথরের বিগ্রহ নির্মাণ করার জন্য উপযুক্ত পাথর গাঙ্গেয় বদ্বীপে তথা বঙ্গে পাওয়া যেত না। পাশ্ববর্তী প্রদেশ থেকে তা নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হতো। অন্যপ্রদেশ থেকে ওজনদার বড় পাথর আনানোর ব্যয়ও ছিল যথেষ্ট। হিন্দুবৌদ্ধ যুগ পর্যন্ত বাংলার শাসকরা এই বিপুল ব্যয় সানন্দে বহন করেছেন। কিন্তু তুর্কি আক্রমণের পরে এই পট পরিবর্তন হয়ে যায়। বঙ্গদেশের নতুন শাসকের চোখে অন্য ধর্মের আরাধ্য দেবতার মূর্তি নির্মাণ ও মূর্তিপূজা হয়ে ওঠে দোষের। ফলে বঙ্গের শাসকের পক্ষ থেকে নতুন করে পাথরের দেববিগ্রহ তৈরি করার আর অবসরও অবশিষ্ট ছিল না। অথচ এই কঠিন সময়েও বঙ্গদেশের মৃৎশিল্পের ধারাটি লোকসমাজে বজায় ছিল। কিন্তু মৃৎবিগ্রহ অপেক্ষাকৃত অনেক বেশি ক্ষণভঙ্গুর হওয়ায় পাথরের দীর্ঘস্থায়ী মূর্তি নির্মাণের বিকল্প পথ হয়ে ওঠে দারুবিগ্রহ নির্মাণ। এর ফলে মূলত পরিণত চন্দন, আম, কাঁঠাল ও নিম গাছের কাঠ দিয়ে দেববিগ্রহ তৈরির প্রবণতা তৈরি হয়েছিল এই পর্ব থেকে।
অখণ্ড বঙ্গপ্রদেশের প্রাচীন দারুবিগ্রহের মধ্যে বিশেষ করে যশমাধবের দারুবিগ্রহ এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য। বাংলার আর্দ্র জলবাতাস দারুবিগ্রহের দীর্ঘস্থায়ীত্বের উপযোগী নয়। ফলে বহু ব্যয় করে তৈরি করা দারুবিগ্রহ কয়েক দশকের মধ্যে ফেটে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে। বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, অসম, ত্রিপুরা ও বাংলাদেশের একাধিক সরকারি সংগ্রহশালায় এমন কয়েকটি প্রাচীন দারুবিগ্রহ সংগ্রহ করা হয়েছে। হয়তো এরই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ প্রতিফলনে বৃহত্তর বঙ্গদেশে ক্ষণস্থায়ী মৃৎবিগ্রহ ও দীর্ঘস্থায়ী ধাতুবিগ্ৰহের ব্যবহার বৃদ্ধি পেতে শুরু করেছিল। নদীমাতৃক বঙ্গভূমিতে পবিত্র গঙ্গা নদীর মাটি দেববিগ্রহ তৈরির প্রধান উপকরণ হয়ে উঠেছিল। সেই ধারা এখনও চলছে। প্রাচীন সময় থেকেই বঙ্গের নদিয়া অঞ্চলে মৃৎশিল্পের রমরমা ছিল। চৈতন্য পরবর্তী যুগে নদিয়ার কৃষ্ণনগর অঞ্চল মৃৎশিল্প চর্চার পীঠস্থান হয়ে উঠেছিল। নদিয়া জেলার মৃৎশিল্পের সেই সুনাম ও যশ আজও পর্যন্ত সমান রয়েছে। বঙ্গদেশে চৈতন্য-পূর্ববর্তী ও চৈতন্য সমসাময়িক সময়ের বিভিন্ন মন্দিরের আরাধ্য দেবতার দারুবিগ্রহগুলি দেখলেই বোঝা যায় বঙ্গীয় মৃৎশিল্পের আঙ্গিনায় তৈরি হওয়া দেবদেবীর মৃৎপ্রতিমার অনুকরণে বাংলার প্রথম পর্বের দারুমূর্তিগুলি গড়ে উঠতে শুরু করেছিল।
মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের সমকালে অখণ্ড বঙ্গদেশে দারুবিগ্রহের অসামান্য প্রসার যে ঘটেছিল তার অন্যতম সাক্ষী হয়ে রয়েছেন সাক্ষাৎ ধামেশ্বর মহাপ্রভু। অনিন্দ্যসুন্দর দীর্ঘদেহী আয়তনয়ন আজানুলম্বিত এই চৈতন্য-বিগ্ৰহ শাস্ত্রীয় মূর্তিশিল্পের নির্দেশ মতো তৈরি করা হয়েছিল। চৈতন্য মহাপ্রভুর এমন অনন্য দারুবিগ্ৰহ সমগ্র বঙ্গময় খুব কমই রয়েছে বলে মনে হয়। সংস্কৃত শাস্ত্রভাণ্ডারের মধ্যে বিশেষ করে বিষ্ণুপুরাণ, গরুড়পুরাণ, অগ্নিপুরাণ, ভাগবতপুরাণ, বৃহৎ সংহিতা, শুক্রনীতিসার, হরিভক্তিবিলাস প্রভৃতিতে দেবদেবীর প্রতিমা বা দেবতার মূর্তির বেশ কিছু লক্ষ্মণ নির্দিষ্ট করা হয়েছে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় দেবদেবীর বিগ্রহ নির্মাণে প্রধান সাত রকমের বাহ্য উপাদানের স্বীকৃতি রয়েছে। এই উপাদানগুলি হলো শিলা (পাথর), দারু (কাঠ), মৃত্তিকা (মূলত নদীজাত), ধাতু (সোনা-রূপা-তামাদি অষ্টধাতু), সৈকতী (বালি), মণি ও পট (চিত্র)। এর মধ্যে প্রথম ছয়টি উপাদান সরাসরি দেবদেবীর বিগ্রহ তৈরির সময় কাজে লাগে। শেষ উপাদানে তৈরি হয় বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্রপট। এছাড়া ‘মনোময়ী’ দেববিগ্রহ নির্মাণের আর একটি শাস্ত্রীয় নির্দেশ রয়েছে। এই ধরনের দেববিগ্রহ ভক্তের মনে তৈরি হওয়া মানসবিগ্ৰহ। শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণের এগারোতম স্কন্ধের সাতাশ নম্বর অধ্যায়ের বারো সংখ্যক শ্লোকে দেববিগ্রহের বাহ্য ও মানস উপাদান সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ বর্ণিত রয়েছে। দেববিগ্রহের অঙ্গবিন্যাস, আসনবিন্যাস, পা ও হাতের মুদ্রাবিন্যাস, অস্ত্রবিন্যাস ও বাহনবিন্যাসের বহু নির্দিষ্ট শাস্ত্রীয় পদ্ধতি থাকলেও দারুব্রহ্ম জগন্নাথ এই সব নিয়মকানুন নিজে হাতে ভেঙে বসে আছেন। জগন্নাথ নিজের নিয়মে নিজে চলেন। জগন্নাথ শাস্ত্রোত্তীর্ণ দেবতা। প্রচলিত দেববিগ্রহের সমস্ত নিয়ম জগন্নাথদেবের বিগ্রহে দেখা যায় না।
চৈতন্য মহাপ্রভু পুরীর জগন্নাথের দারুবিগ্রহের সমস্ত ইতিবৃত্ত জানতেন। নিয়মোত্তীর্ণ জগন্নাথকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব পুরীর নির্দিষ্ট নিয়মের বাইরে নিয়ে গিয়েছিলেন। চৈতন্য মহাপ্রভু সজ্ঞানে দেববিগ্রহ নির্মাণের শাস্ত্রীয় বিধানকে মান্যতা দিয়ে ও উৎকলের রীতিতে জগন্নাথের দারুবিগ্রহ তৈরি না করে সহজলভ্য মৃত্তিকা দিয়ে বেঙ্কট ভট্টের বাড়িতে সপার্ষদ জগন্নাথের বিগ্রহ তৈরি করেছিলেন। খুব সম্ভবত সারা ভারতে এই প্রথম নিয়মিত পূজার জন্য জগন্নাথের বিগ্রহ প্রচলিত নিমদারুর বদলে মৃত্তিকা দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে দেখা হলে, জগন্নাথের প্রথম মৃৎপ্রতিমা নির্মাণের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন একজন বাঙালি যুগপুরুষ। মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের প্রতিটি কাজই তাঁর অনুগামী গৌড়ীয় বৈষ্ণবরা অনুসরণ করেছিলেন। চৈতন্যদেবের অনুসরণে বঙ্গদেশে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ তৈরির প্রথা গড়ে ওঠাটা তাই খুব বেশি অস্বাভাবিক নয়। তাছাড়া নিমদারুর বিগ্রহ অপেক্ষা মৃৎবিগ্রহ ছিল সহজলভ্য ও কম ব্যয়বহুল। বঙ্গদেশে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ যে ধীরে ধীরে বৃহত্তর জনতার কাছে জগন্নাথ-আহ্লাদনের প্রিয় উপকরণ হয়ে উঠেছিল তার প্রথম পোক্ত প্রমাণ পাওয়া যায় কালীপ্রসন্ন সিংহের ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা’য়। হুতোম প্যাঁচা ওরফে কালীপ্রসন্ন সিংহ লিখেছেন : “…সহরে রথ পার্ব্বণে বড় একটা ঘটা নাই; কিন্তু কলিকাতায় কিছুই ফাঁক যাবার নয়; রথের দিন চিৎপুর রোড লোকারণ্য হয়ে উঠ্লো,… মাটির জগন্নাথ, কাঁঠাল, তালপাতার ভেঁপু, পাখা ও সোলার পাখি বেধড়ক বিক্রি হচ্চে…।”২১ কালীপ্রসন্ন সিংহের এই বর্ণনা থেকে প্রমাণিত হয়, খোদ ঊনবিংশ শতাব্দীর কলকাতাতে এই ধরনের ছোট ছোট আকারের জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ সাধারণ মানুষের ঘরে প্রবেশ করতে শুরু করেছিল। প্রাগুক্ত ‘বেধড়ক’ বিক্রি হওয়ার কথা থেকে আরও বোঝা যায় যে, ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যেই বাংলার মৃৎবিগ্রহ উপাসনার বৃহত্তর বলয়ে সপার্ষদ জগন্নাথও প্রবেশ করে গিয়েছিলেন।
অখণ্ড বৃহৎ বঙ্গময় কাঁচামাটির মৃৎবিগ্রহ উপাসনার রীতি প্রচলিত থাকলেও পোড়ামাটির কোনো দেববিগ্রহ পূজা করার সাধারণ রীতি ছিল না। একমাত্র পূর্ববঙ্গে লক্ষ্মীর সরাচিত্র ছাড়া পূজার জন্য অন্য কোনোভাবে পোড়া মাটির বিগ্রহ সাধারণত সমগ্র বঙ্গদেশে তৈরি হতো না। যদিও লক্ষ্মীসরাকে চিত্রপটের মধ্যে গণনা করাই সমীচীন। কারণ লক্ষ্মীসরার সঙ্গে প্রচলিত বিগ্রহের ধারণার স্বরূপগত বৈসাদৃশ্য রয়েছে। ভাগীরথী গঙ্গার পশ্চিম পারে বৃহত্তর রাঢ়বঙ্গ ও তৎসংলগ্ন অঞ্চল অর্থাৎ বাঁকুড়া, অবিভক্ত বর্ধমান, হুগলি, অবিভক্ত মেদিনীপুর ও মুর্শিদাবাদ জেলায় টেরাকোটা বা পোড়া মাটির শিল্পসমৃদ্ধ মন্দিরের বাইরের দিকের দেওয়ালের বিভিন্ন অংশ অলঙ্করণের জন্য নানা মাপের দেবমূর্তি ও নক্শা মূলত মাটি দিয়ে গোল বা চৌকো আকৃতির ব্লগের আকারে তৈরি করে তা আগুনে নির্দিষ্ট তাপে লালচে করে পুড়িয়ে নেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল। মাটি দিয়ে তৈরি করা এই ধরনের টেরাকোটার শিল্পগুলি সংরক্ষণ ও দীর্ঘস্থায়ী করতে আগুনে পুড়িয়ে নেওয়া হতো। সমগ্র বঙ্গময় সাধারণত বিভিন্ন ধাতুবিগ্রহ, প্রস্তরবিগ্ৰহ ও দারুবিগ্রহে সমৃদ্ধ গৃহস্থ পরিবারে গৃহদেবতার দৈনন্দিন উপাসনা প্রচলিত ছিল। কাঁচা মাটি দিয়ে তৈরি বিগ্রহ সাধারণত পূজা করা হতো দেবদেবীর বার্ষিক উপাসনার সময়। যেমন— স্মার্ত রঘুনন্দনের স্মৃতিশাস্ত্রে শরৎকালীন দুর্গোৎসব বিধানের অংশে ভগবতী দেবী দুর্গার মৃৎপ্রতিমা তৈরি ও সজ্জার দীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায়।২২ স্মার্ত রঘুনন্দন ছিলেন চৈতন্যদেবের থেকে আনুমানিক এক প্রজন্ম পরবর্তী সময়ের মানুষ। এছাড়া ‘বৃহৎতন্ত্রসার’-এর রচয়িতা তথা বাংলার অন্যতম সিদ্ধ মাতৃ-উপাসক তন্ত্রাচার্য কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশের তৈরি করা দেবী দক্ষিণাকালীর বিগ্রহের কথা এখন তো প্রায় কিংবদন্তিসম হয়ে উঠেছে।২৩
আরও পরবর্তী সময়ে শান্তিপুর অঞ্চলের বৈষ্ণব-রাসের অনুকরণে রাজা কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদারের (রায়) আমলে কৃষ্ণনগর অঞ্চলে শাক্তরাস উপলক্ষে বিভিন্ন দেবদেবীর বড় বড় মৃৎমূর্তি তৈরি করে বার্ষিক পূজার রীতি প্রচলিত হয়েছিল।২৪ হাওড়ার রামরাজাতলা অঞ্চলে সপার্ষদ রামচন্দ্রের মৃৎবিগ্রহ তৈরি করে বার্ষিক পূজার প্রাচীন রীতিনীতি এখনও প্রচলিত রয়েছে। এছাড়া যে সমস্ত দেবদেবীর মৃৎবিগ্রহ বঙ্গদেশের বিভিন্ন প্রাচীন মন্দিরে সারা বছর ধরে সংরক্ষণ করে পূজা করার নিয়ম রয়েছে সেই বিগ্ৰহগুলিরও নির্দিষ্ট সময়ের পর নবকলেবর করার রীতি রয়েছে।২৫ এই ধারায় রয়েছেন বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের মল্লেশ্বরী মৃন্ময়ী দেবী,২৬ হুগলির রাজবলহাটের রাজবল্লভী দেবী প্রমুখ।২৭ মৃৎবিগ্রহ বিসর্জন ও নবকলেবর নির্মাণের রীতি প্রচলিত থাকার ফলে মৃৎবিগ্রহ সংরক্ষণের রীতি বঙ্গদেশে সেভাবে আর তৈরি হয়ে উঠতে পারেনি। বঙ্গদেশে জগন্নাথ-সংস্কৃতির বিকাশের প্রথম পর্বে যদি কোনো মন্দিরে বা পরিবারে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করে পূজা প্রচলিত হয়েও থাকে তবে তা পরবর্তী সময়ে পরিবর্তিত হয়ে গেছে বঙ্গদেশে জগন্নাথের দারুবিগ্রহ সহজলভ্য হয়ে ওঠার পর থেকে। বঙ্গের অধিকাংশ জগন্নাথ উপাসক পরিবারের জগন্নাথের দারুবিগ্রহ ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীতে সরাসরি ওড়িশা থেকে এসেছে। আবার বাংলার একাধিক মন্দির ও পরিবারের পক্ষ থেকে বঙ্গের শিল্পীদের দিয়েই বঙ্গীয় পদ্ধতিতে জগন্নাথের দারুবিগ্রহ তৈরি করানো হয়েছে। তবে বাংলার শিল্পী ও কারিগরদের তৈরি করা জগন্নাথ বিগ্রহগুলি পুরীর জগন্নাথদেবের অবয়বের থেকে অনেকটাই আলাদা এবং তাঁদের মুখাবয়ব মাটির জগন্নাথ বিগ্রহের অনেক কাছাকাছি। বাংলাদেশের ঢাকা, যশোর, দিনাজপুর প্রভৃতি অঞ্চলে এখনও কয়েকজন এমন জগন্নাথ রয়েছেন। বৃহৎ বঙ্গ বিভাজনের সময় পূর্ববঙ্গের বহু পরিবারের সঙ্গে তাদের আরাধ্য দেবতা জগন্নাথও পশ্চিমবঙ্গ, অসম ও ত্রিপুরায় চলে এসেছেন। এছাড়া মৃৎবিগ্রহ বিসর্জনের প্রথা ও বৎসরান্তে বৃক্ষতলে স্থাপনের সাধারণ রীতি প্রচলিত থাকার জন্য দুর্ভাগ্যবশত জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ আলাদা করে সংরক্ষণের আয়োজন হয়নি। অবশ্য গত শতাব্দীর শেষ কয়েক দশক জুড়ে কড়ি বা চিনেমাটির বিভিন্ন দেববিগ্রহ তৈরির রেওয়াজ শুরু হলে সেই সময় একই পদ্ধতিতে সপার্ষদ জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি হয়েছে। অবশ্য একথাও ঠিক যে, বিশ্বায়নের ধাক্কায় বর্তমান সময়ে চিনেমাটির জগন্নাথ প্রায় অপ্রচলিত হয়ে গেছে।
চৈতন্য পরবর্তী সময়ে সপ্তদশ শতাব্দীর বঙ্গদেশে জগন্নাথের জনপ্রিয়তা বজায় ছিল। বাংলা ভাষায় মহাভারতকার কবি কাশীরাম দাসের কনিষ্ঠ ভ্রাতা কবি গদাধর দাস পুরীর জগন্নাথদেবের জায়গান করে লিখেছিলেন ‘পুরুষোত্তমমাহাত্ম্য’ তথা ‘জগৎমঙ্গল’ কাব্য। এরপরই বঙ্গদেশে বঙ্গভাষায় জগন্নাথচর্চার উৎসমুখ সূচিত হয়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্ধে কবি বিশ্বম্ভর দাস ‘জগন্নাথমঙ্গল’ রচনা করে বাঙালির জগন্নাথ-মননের পথ চূড়ান্ত প্রসারিত করতে সক্ষম হন। বাংলা সাহিত্যে জগন্নাথের এই ব্যাপ্তি বাঙালির ঘরে ঘরে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের প্রবেশ ও প্রতিষ্ঠায় অনেকখানি সাহায্য করেছিল। ওড়িশার জগন্নাথের দারুবিগ্রহের সংশ্রব ছাড়াই বাংলার লোকায়ত মৃৎশিল্পীরা নিজস্ব মননে-ধ্যানে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ তৈরি করতে শুরু করেছিলেন। একারণেই ঊনবিংশ শতাব্দীর সাহিত্যে মাটির জগন্নাথের ‘বেধড়ক’ বিক্রির উল্লেখ রয়েছে।২৮ তারপর মাটির জগন্নাথ তৈরি ও বিক্রির সেই রীতি এখনও অক্ষুণ্ন রয়েছে। বর্তমান সময়ে আন্তর্জাল বাণিজ্যের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে পুরীর ঘরাণায় তৈরি হওয়া জগন্নাথের দারুবিগ্রহ পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকে সংগ্রহ করা যায়। কিন্তু তারপরও বাংলার জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের জনপ্রিয়তা কোনো অংশে কমেনি। আষাঢ় মাসের রথযাত্রার কাছাকাছি সময়ে পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সহ অন্যান্য জেলায় কাঠের তৈরি ছোট ছোট রথ বিক্রি হতে দেখা যায়। সাধারণত শিশু ও কিশোর বয়সী ছেলেমেয়েরা এই ধরনের ছোট ছোট রথ টেনে রথোৎসব পালন করে। রথযাত্রা ও উল্টোরথের তিথিতে কাঠের তৈরি রথগুলিকে রঙিন কাপড়, পতাকা, ফুল, লতা, মালা দিয়ে সাজানো হয়। এই ধরনের ছোট ছোট রথের উপযোগী মাটি বা কাঠের তৈরি ছোট উচ্চতার জগন্নাথ বিগ্রহ রথের ভেতরে স্থাপন করে রথযাত্রার সূচনা করা হয়। ছোট ছোট রঙিন রথে জগন্নাথকে বসিয়ে রথযাত্রা উদ্যাপন বাঙালির কাছে কেমন আনন্দোৎসব হয়ে উঠেছিল তার একটি নাতিদীর্ঘ বর্ণনা পাওয়া যায় শ্রীম-কথিত ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-কথামৃত’-এর রথযাত্রার বর্ণনায় : “অপরাহ্ন হইয়াছে। ইতিমধ্যে বারান্দায় শ্রীশ্রীজগন্নাথদেবের সেই ছোট রথখানি ধ্বজা পতাকা দিয়া সুসজ্জিত করিয়া আনা হইয়াছে। শ্রীশ্রীজগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম চন্দনচর্চিত ও বসন-ভূষণ ও পুষ্পমালা দ্বারা সুশোভিত হইয়াছেন।”২৯বাংলার জেলায় জেলায় জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের বৈচিত্র্য রয়েছে। জগন্নাথের ছোট মৃৎবিগ্রহগুলি সাধারণত ছাঁচে ফেলে তৈরি করা হয়। এক এক শিল্পীর তৈরি করা এক এক রকমের ছাঁচে স্বভাবতই জগন্নাথের অলংকার ও বস্ত্রের শৈলীতে ছোট-বড় রকমের পার্থক্য ধরা পড়ে। মাটির তৈরি জগন্নাথের রঙ, মুখ, চোখ, নাক, ঠোঁট, হাত, পোশাক, তিলক, বসার ভঙ্গি, যানবাহন, বিগ্রহের আসন, পার্শ্বদেবতা ও সহায়ক-দেবতা, কৃষ্ণানুসঙ্গ, চৈতন্যানুসূত্র ইত্যাদি বৈচিত্র্যের নিরিখে বর্তমান সময়ে প্রাপ্ত জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহগুলির একটি নাতিদীর্ঘ পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে।
ক. — একক জগন্নাথ : মাটির তৈরি একক জগন্নাথ খুব কমই পাওয়া যায়। বঙ্গের একাধিক প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরে একক জগন্নাথ উপাসনার রীতি রয়েছে। অনুমিত হয় প্রথমদিকে বঙ্গদেশে একক জগন্নাথের উপাসনা শুরু হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে জগন্নাথেরই অনুসঙ্গে সুভদ্রা ও বলরামের পূজা প্রচলিত হয়েছে। তবে সুভদ্রা ও বলরামের প্রবেশ ঘটলেও বাংলার মৃৎশিল্পের বলয়ে সুদর্শন বিগ্রহের প্রবেশ এখনও বৃহত্তর পরিসরে ঘটতে পারেনি। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর ও মজিলপুর, নদিয়া জেলার শান্তিপুর অঞ্চলে একক জগন্নাথ উপাসনার রীতি এখনও বজায় আছে। এই ধরনের জগন্নাথ সাধারণত কালো রঙের হলেও সবুজ ও নীল রঙের জগন্নাথ তৈরির রেওয়াজ রয়েছে। বিশেষত নদিয়ার শান্তিপুর অঞ্চলে বড় গোস্বামীর শ্রীপাটের রঘুনাথজীর অনুসঙ্গে একক সবুজ জগন্নাথ তৈরি করা হয়। তবে খোদ শান্তিপুরেই ধীরে ধীরে সবুজ জগন্নাথ তৈরি, বিক্রি ও পূজার প্রচলন কমে আসছে। নীল জগন্নাথের বিস্তার রয়েছে ওপার বাংলার বরিশাল, ফরিদপুর, পাবনা সহ কয়েকটি জেলায়। ২০১৮-১৯ খ্রিস্টাব্দে ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় উত্তরবঙ্গের শিলিগুড়ির শহর অঞ্চলে সাদা রঙের কয়েকটি অপ্রচলিত ধারার মাটির তৈরি জগন্নাথের দেখা পাওয়া গিয়েছিল।
খ. — সপার্ষদ জগন্নাথ : বাংলায় একক জগন্নাথ উপাসনার রীতি ক্ষয়ীষ্ণু হয়ে এলেও সপার্ষদ জগন্নাথ উপাসনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। মাটির তৈরি সপার্ষদ জগন্নাথ বিগ্রহ মূলত দুই ধরনের। প্রথমটি একই ছাঁচ থেকে পৃথকভাবে তিনবারে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ তোলা হয়। রঙ দেওয়ার আগে পর্যন্ত পৃথকভাবে তিন বিগ্রহ চেনার কোনো বিশেষ উপায় নেই। তিনজনের তিনটি পৃথক বিগ্রহ মিলে একটি সেট তৈরি করা হয়। তবে একই ছাঁচ থেকে তিনজনের বিগ্রহ তৈরি করা হয় বলে জগন্নাথ বা বলভদ্রের মতো সুভদ্রার বিগ্রহেও সামান্য একটু হাত দেখা যায়। সাধারণত জগন্নাথ কালো রঙে, সুভদ্রা হলুদ রঙে ও বলভদ্র সাদা রঙে রাঙানো হয়। রঙের পার্থক্য ছাড়া তিন বিগ্রহে আর কোনো বিশেষ অবয়বগত পার্থক্য দেখা যায় না। এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার বিগ্রহ এখনও উত্তর কলকাতার বেলঘরিয়ার অঞ্চলের কয়েকটি প্রাচীন রথে ব্যবহার করা হয়। রথের পর সপার্ষদ জগন্নাথ বিগ্রহ স্থানীয় মন্দিরে এক বছরের জন্য সংরক্ষণ করা হয়। আর দ্বিতীয়টি, একই ছাঁচ থেকে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামের মৃৎবিগ্রহের একবারে একসঙ্গে ছাপ তোলা হয়। তিনজনের বিগ্রহ একে অন্যের সঙ্গে পাশাপাশি অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পূর্ণ জুড়ে থাকে। এক্ষেত্রেও জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা—তিনজনের মূর্তি প্রায় সমান মাপের তৈরি করা হয়। তবে বর্তমানে অবশ্য জগন্নাথ ও বলরামের মাঝে থাকা সুভদ্রার বিগ্রহ সামান্য একটু কম উচ্চতার তৈরি করার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। এই দুই রকমের জগন্নাথ বিগ্রহেরই বিভিন্ন নতুন নতুন শৈলী সারা বঙ্গময় ছড়িয়ে রয়েছে এবং মানুষের নিত্যনতুন চমক দেওয়া বিগ্রহের চাহিদা মতো উত্তরোত্তর একটানা বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথ মূর্তির ব্যবহার বিশেষত দক্ষিণ কলকাতায় একটু বেশি।
গ. কৃষ্ণমুখ জগন্নাথ : চৈতন্য প্রভাবিত বঙ্গদেশে বাঙালির চেতনায় জগন্নাথ ও কৃষ্ণ এক হয়ে গেছেন। উৎকলী জগন্নাথের মুখাবয়ব বিশিষ্ট জগন্নাথের দারুবিগ্রহ চৈতন্য পূর্ববর্তী সময় থেকেই বঙ্গদেশে যথেষ্ট রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণমুখ জগন্নাথ বাংলার স্বতন্ত্র আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞা থেকে জন্ম নিয়েছে। গৌড়ীয় ঘরানার বালগোপাল বা কৃষ্ণের বিগ্রহের মুখাবয়বের প্রায় অনুরূপ বাঁশ পাতার মতো টানা টানা চোখ, টিকালো নাক, স্ফিত ওষ্ঠাধর ও চিবুক বিশিষ্ট জগন্নাথ বঙ্গেই সুলভ। বঙ্গদেশে এই রীতিতে শুধুমাত্র জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহই তৈরি হয়েছে এমন নয়, দারুবিগ্রহও যথেষ্ট তৈরি হয়েছে। কলকাতার উত্তরভাগের কেষ্টপুর অঞ্চলের বিখ্যাত নীল জগন্নাথের দারুবিগ্রহের মুখাবয়ব বাংলার কৃষ্ণমুখ জগন্নাথের মতো। উত্তর কলকাতার মানিকতলার পালপাড়া ও দক্ষিণদাড়ির পটুয়াপল্লীতে স্নানযাত্রার সময় থেকে এই ধরনের কৃষ্ণমুখ জগন্নাথ তৈরি করা হয় ব্যবসার জন্য। মূলত এই অঞ্চল থেকেই মাটির মূর্তির বিক্রেতারা জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ সংগ্রহ করে ছোট ছোট কাঠের রথের সঙ্গে সারা কলকাতায় বিক্রি করেন কৃষ্ণমুখ জগন্নাথ সাধারণত মাটির অলংকারে বিশেষ কয়েকটিভাবে সজ্জিত থাকে। মাথার মুকুট, কানের দুল, গলার অলংকার, বুকের ওপর বুকপাটা ও নাভির ওপর থেকে কোমরবদ্ধ দিয়ে জগন্নাথকে সাজানো হয়। জগন্নাথের ছাঁচ থেকে একই পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় বলভদ্র ও সুভদ্রার বিগ্রহ। তাই তাঁদের বিগ্ৰহও গঠনের দিক থেকে সম্পূর্ণ এক রকমের। শুধুমাত্র রঙের পার্থক্যেই তিনজনের বিগ্রহ আলাদা করে চেনা যায়।
ঘ. — ঊর্ধ্ববাহু জগন্নাথ : বাঙালির আধ্যাত্মিক মননে চৈতন্য মহাপ্রভু সাক্ষাৎ সচল জগন্নাথ। ষোড়শ শতাব্দী থেকে চৈতন্যদেবের প্রচারিত হরিনাম সংকীর্তন বাঙালির ধর্মচিন্তা ও চর্চার অঙ্গ হয়ে গেছে। সমবেত সংকীর্তনের মধ্যে দিয়ে বিধর্মীর ফতেয়া উপেক্ষা করে বাঙালির ধর্মযাপনের অধিকার ফিরিয়ে এনেছিলেন চৈতন্যদেব। বাঙালি হিন্দুসমাজ চৈতন্যদেবের সংকীর্তনরত বৈপ্লবিক অভিযাত্রাকে কোনোদিন ভুলতে পারবে না। ফলে সংকীর্তনরত চৈতন্যদেবের ভাব এসে যুক্ত হয়ে গেছে বাংলার ঊর্ধ্ববাহু জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে। বিংশ শতাব্দীর শেষ দশকেও নবদ্বীপ অঞ্চলে কাঠের তৈরি খুব সাদামাটা গড়নের নিমাই-নিতাই বিগ্রহ তৈরি করে বিক্রি করা হতো। বাংলার ঊর্ধ্ববাহু জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে সেই ছাপ ধরা রয়েছে। এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথ দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার বারুইপুর ও কলকাতার দক্ষিণে মুকুন্দপুর অঞ্চলে বিক্রি হতে দেখা গেছে। কলকাতার মুকুন্দপুর অঞ্চলের জগন্নাথ মন্দিরের জগন্নাথ ও বলরামের দারুবিগ্রহ ঊর্ধ্ববাহু। এই জগন্নাথের প্রভাবে স্থানীয় কোনো মৃৎশিল্পী ঊর্ধ্ববাহু জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ তৈরি করে থাকতে পারেন। কিন্তু দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার জয়নগর অঞ্চলের ঊর্ধ্ববাহু জগন্নাথের সূত্রের কোনো সঠিক ইতিহাস জানা যায় না। হয়তো শিল্পীর শিল্পসত্তাই এই ধরনের জগন্নাথের রূপকল্প তৈরি করেছে। তবে এতে যে চৈতন্যানুসঙ্গ রয়েছে তা জগন্নাথের হাতের মুদ্রাবিন্যাস থেকে বেশ বোঝা যায়।
ঙ. — মোগল-রাজপুত বস্ত্ররীতিতে সজ্জিত জগন্নাথ : বাংলার সব ধরনের দেবদেবীর বিগ্রহে বস্ত্ররীতির আয়োজন দেখা যায় না। দেবতার অঙ্গের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সজ্জিত পরিমিত বস্ত্র ও পূর্ণাঙ্গ বস্ত্র— উভয় ধারার বস্ত্রশিল্পরীতিরই দেখা যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব মহাজনদের দারুবিগ্রহ বা কষ্টিপাথরের কৃষ্ণবিগ্রহে দেবতার বিশেষ কিছু অঙ্গ কৌপিনের মতো সামান্য বস্ত্রখণ্ড সদৃশ আকৃতিতে ঢাকা থাকে। বাংলার জগন্নাথের কোনো শ্রীবিগ্রহেই এই রীতিটি দেখা যায় না। জগন্নাথের দারুবিগ্রহ, প্রস্তরবিগ্রহ, ধাতুবিগ্রহ ও মৃৎবিগ্রহ সমস্ত রকমের বিগ্রহেই দেবতার কমপক্ষে কোমর থেকে নিচ পর্যন্ত সম্পূর্ণ নিম্নাঙ্গ ঢাকা থাকে। বাংলার জগন্নাথের দারুবিগ্রহ, প্রস্তরবিগ্রহ, ধাতুবিগ্রহে দেবতার উন্মুক্ত বুক দেখা গেলেও মৃৎবিগ্রহে তা দেখা যায় না। জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে তাঁর গলার নিচ থেকে পা পর্যন্ত সম্পূর্ণ ঢাকা থাকে। বস্ত্রের বাইরে শুধুমাত্র তাঁর হাত দুটি দেখা যায়। বাংলার জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে সাধারণত প্রাগাধুনিক সময়ে বহুল প্রচলিত মোগল-রাজপুত ঘরানার জনপ্রিয় বস্ত্ররীতির ব্যবহার দেখা যায়। এই রীতির পোশাক সমাজে অপ্রচলিত হয়ে গেলেও যে কোনো কারণেই হোক এখনও পর্যন্ত মৃৎশিল্পের পরিসরে নিজের যশ বজায় রেখে চলেছে। আরও আশ্চর্য এই যে বাংলার মাটির জগন্নাথ বাঙালির অন্যান্য পুরুষ দেবতার মতো কোচানো ধুতি আর উত্তরীয় পরেন না। জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে দেখা যায় দেবতার পোশাকে মূলত দুটি অংশ রয়েছে। পোশাকের একটি অংশ গলা থেকে নেমে কোমর পর্যন্ত ধীরে ধীরে অপেক্ষাকৃত সরু হয়ে এসেছে এবং কোমর থেকে আবার ধীরে ধীরে স্ফিত হয়ে পায়ের কাছে একটা সুন্দর ঘের তৈরি করেছে। জগন্নাথের কোমরে প্রায় আবশ্যিকভাবে একটি কোমরবদ্ধ থাকায় জগন্নাথের পোশাকের এই দুটি অংশ স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বিভিন্ন জেলার ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় বিভিন্ন উচ্চতার প্রায় ষাটোর্ধ্ব শিল্পীর হাতে গড়া প্রায় চল্লিশোর্ধ রকমের জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ দেখেছি। কিন্তু কোনো জগন্নাথের মৃৎবিগ্ৰহেই দেবতার বস্ত্ররীতিতে এর থেকে সম্পূর্ণ অন্যরকমের কোনো বস্ত্ররীতি দেখিনি। যেন কোনো অজ্ঞাত কারণে জগন্নাথের বস্ত্র-বিন্যাসে একটি প্রাচীন বস্ত্রনীতি অপরিবর্তনীয় রয়ে গেছে। এই ধরনের বস্ত্ররীতি কীভাবে বাংলার মৃৎশিল্পের বলয়ে প্রবেশ করেছিল তার নির্ণয় করা এখন দুঃসাধ্য। কলকাতা ও নদীয়া জেলার প্রবীণ মৃৎশিল্পীদের কাছেও এর কোনো কারণ জানা যায়নি। তাঁরা পিতা ও পিতামহের কাছে যেভাবে ছাঁচে ফেলে জগন্নাথ বানাতে শিখেছেন সেভাবেই এক ধারা বহন করে চলেছেন। সময়ের সঙ্গে কখনও পুরোনো ছাঁচ ভেঙে গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে আগের শৈলীই নতুন মূর্তিতে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের শিল্পীরা। এতে যেটুকু পার্থক্য এসেছে তা জগন্নাথের অলংকারে। সেখানেই শিল্পী নিজের শিল্পীসত্তার নিজস্বতা রাখতে চেয়েছেন। তবে শিল্পীদের হাতে সজ্ঞানে ঘরানার মূল স্বরূপ কখনও বদলে যায়নি। শুধু এবঙ্গের শিল্পীদের ক্ষেত্রেই এমন ঘটেছে তা নয়, দেশভাগের সময় যেসব হিন্দু কুমোর বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে নতুন করে বসবাস শুরু করেছিলেন তাদের শিল্প-পরম্পরাতেও একই মনোভাব রয়েছে।
চ. — পুরীর মতো রথমধ্যে জগন্নাথ : ওড়িশার মানুষের লোকবিশ্বাস রয়েছে জগন্নাথকে রথের মধ্যে বসা অবস্থায় দর্শন করলে জন্মজন্মান্তরের সমস্ত দোষ নষ্ট হয়ে যায় এবং জীবের আর পুনর্জন্ম নিতে হয় না। বদ্ধজীব মুক্ত হয়ে যায়। ওড়িশার এই গণভাবনা বঙ্গদেশেও সংক্রমিত হয়েছে। বঙ্গের বহু ভক্তিপ্রিয় মানুষ রথযাত্রার দিনে একবার রথারূঢ় জগন্নাথকে দেখার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠেন। তাছাড়া গজপতি মহারাজা অনঙ্গভীমদেবের সময় থেকে সমগ্র উৎকলের রাষ্ট্রদেবতা জগন্নাথ। উৎকলের সবকিছুর কেন্দ্রে রয়েছেন জগন্নাথ। ওড়িশায় জগন্নাথকে ঘিরেই বারো মাসের দ্বাদশযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু সেই জগন্নাথই বঙ্গের বারো মাসের তেরো পার্বণের মধ্যে শুধু রথযাত্রার দিনে একাধিপত্য বহন করেন। তাই বঙ্গে যেন জগন্নাথ ও জগন্নাথের রথ প্রায় সমার্থক বা পারস্পরিক সমান অনুসঙ্গবাহী হয়ে উঠেছে। হয়তো বাঙালির এই জগন্নাথ-ভাবনার পোষণে শান্তিপুর ও কৃষ্ণনগর অঞ্চলে ছাঁচের তৈরি মাটির রথের ভেতরে একক জগন্নাথের ছোট্ট একটি বিগ্রহ দেখা যায়। এমন জগন্নাথ ও জগন্নাথের রথ তুলনামূলক অনেক আধুনিক সময়ে তৈরি হয়েছে। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহ ছোট ছোট কাঠের রথে স্থাপনের জন্য তৈরি করা হয় না। বিগ্ৰহগুলির উচ্চতা ও দামও অপেক্ষাকৃত একটু বেশি। এই রকম জগন্নাথ পৃথকভাবে ঘরে বা গৃহমন্দিরে সজ্জিত করা হয়। এই ধরনের রথগুলি আকৃতিতে রথের মতো হলেও প্রকৃত রথের মতো চাকার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে না। মাটির রথের নিচের অংশটি সমান থাকে এবং কমপক্ষে চারটি চাকা রথের গায়ে একেবারে নিচের দিকে খোদিত থাকে। ওড়িশার কোনারকের মন্দিরের চাকাগুলো যেভাবে সজ্জিত রয়েছে প্রায় সেভাবে এই ধরনের রথের চাকাগুলি সজ্জিত থাকে। তবে চাকাগুলির গড়ন খুবই সাদামাটা। পুরীর জগন্নাথদেবের রথের অনুসঙ্গ বজায় রাখতে এই ধরনের মাটির রথের ওপরের অংশ মূলত হলুদ ও লাল রঙে সাজিয়ে তোলা হয়। অবশ্য এই রীতিও খুব যে একটা সর্বব্যাপী, তা নয়। বহু মাটির রথেই শুধু সাধারণ লাল বা কাঠের মতো খয়েরি রঙের ব্যবহার করা হয়। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের যথেষ্ট চাহিদা তৈরি হয়েছে।
ছ. — পুরীর শ্রীমন্দির ও জগন্নাথ : বঙ্গবাসীর যদি সবচেয়ে জনপ্রিয় শক্তিতীর্থ কালীঘাট হয় তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিষ্ণুতীর্থ পুরীধাম। একেবারে প্রথম পর্বে ওড়িশা প্রবাসী জনমণ্ডলীর মাধ্যমে অখণ্ড বঙ্গের তুঙ্গভূমের বাঙালিজীবনে জগন্নাথের প্রসার ঘটেছিল।৩০ তবে বাঙালি সমাজে জগন্নাথ কিছুটা বঙ্গীয় ভাবনায় সিক্ত হয়ে প্রবেশ করেছিলেন। চৈতন্যপূর্ব সময় থেকে বাঙালি জাতি উৎকলের জগন্নাথের সঙ্গে আত্মীয়তা পাতালেও চৈতন্যদেবের পর থেকে তারা জগন্নাথকে নিজের মতো করে গ্ৰহণ করেছে। ওড়িশার জগন্নাথের মূল বিগ্ৰহের অনুরূপ জগন্নাথ বিগ্ৰহ প্রাচীন সময় থেকে বঙ্গদেশেও তৈরি হয়েছে। তার সবচেয়ে প্রাচীন প্রমাণ মাহেশের জগন্নাথ মন্দিরের শ্রীবিগ্রহ। কিন্তু বাঙালি দীর্ঘদিন ওড়িশার মন্দিরশৈলীকে গ্ৰহণ করেনি। এর ফলে মাহেশ শ্রীপাট সহ জগন্নাথের কোনো প্রাচীন মন্দিরেই ওড়িশার মন্দিরের শিল্পরীতি প্রভাব ফেলেনি। মাহেশ শ্রীপাটের মন্দির ও বিশেষ করে মন্দিরের চূড়ার গড়ন অনেক শাক্ত মন্দিরের অনুরূপ। ওড়িশার পুরীর শ্রীমন্দিরের মতো জগন্নাথের মন্দির তৈরি করার প্রবণতা খুব বেশি হলে বিগত তিন দশকে তৈরি হয়েছে। খড়গপুর, খিদিরপুরের জগন্নাথ মন্দিরে পুরীর শ্রীমন্দিরের নান্দনিক আদল সচেতনভাবে তুলে ধরা হয়েছে। দীঘায় নির্মিয়মান জগন্নাথ মন্দিরও পুরীর শ্রীমন্দিরের অনুকরণে তৈরি করা হচ্ছে। এই সমস্ত কিছুর প্রভাব বাংলার মৃৎশিল্পের বলয়েও এসে পড়েছে। আধুনিক সময়ে তৈরি হতে শুরু করেছে শ্রীমন্দির সংযুক্ত জগন্নাথ। এই ধরনের মৃৎবিগ্রহে পুরীর শ্রীমন্দিরের প্রধান তিন স্তরের চূড়ার সামনে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামকে দেখা যায়। তবে এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের আদলে একটু পার্থক্য দেখা যায়। বাংলার অধিকাংশ জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের মুখ গোলাকৃতি হলেও এই বিশেষ ধরনের জগন্নাথের মুখের আদল সচেতনভাবে পুরীর ঘরানার জগন্নাথের মতো করার চেষ্টা দেখা যায়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির নিজস্ব জগন্নাথ-ভাবনায় ওড়িশার জগন্নাথ-সংস্কৃতি যে ক্রমশ প্রভাব বিস্তার করছে এই ধরনের জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহগুলি তার এক একটি নীরব প্রমাণ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় ক্ষেত্রসমীক্ষা চলাকালে কুমোরটুলি, শ্রীরামপুর, শান্তিপুর ও কৃষ্ণনগরের মতো জনপ্রিয় মৃৎশিল্প অঞ্চলের শিল্পীদের মুখোমুখি হয়ে জেনেছি, নতুনত্বের চাহিদা থাকায় ওড়িশার জগন্নাথের আদলে জগন্নাথ তৈরি করা হলে মানুষের কাছে তার গ্ৰহণযোগ্যতা তৈরি হচ্ছে। তবে এই ধরনের জগন্নাথ প্রচলিত বঙ্গীয় মূর্তিশিল্প-ঐতিহ্যের দরবারে এখনও কিছুটা ব্রাত্য। অনেক শিল্পীই বিগ্ৰহের কলাকৌশলের আধুনিক রীতি বা ওড়িশার রীতি আনতে কিছুটা নিমরাজি।
জ. — আয়তনয়ন জগন্নাথ : জগন্নাথ বিগ্রহের প্রধান আকর্ষণ তাঁর দুটি চোখে। অনিন্দ্যসুন্দর সেই মোহনীয় চোখ যেন সব ভক্তের দৃষ্টি নিমেষের মধ্যে এক জায়গায় এনে স্থির করে দেয়। বাংলার মৃৎশিল্পে জগন্নাথের গোলাকৃতি চোখ বহু প্রচলিত হলেও বাংলার দেবীপ্রতিমার মতো আয়তনয়নের চোখের জগন্নাথ বিগ্রহ দক্ষিণদাড়ি, মানিকতলা, ফলতা, লক্ষ্মীকান্তপুর, কুমোরটুলির পটুয়াপল্লীতে অনেক দেখা যায়। টানা টানা চোখের জগন্নাথের বিগ্রহে অনেক সূক্ষ্ম কারুকার্য থাকে। সূক্ষ্ম অলঙ্করণের বিশেষত্বের জন্য এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথের চাহিদাও ধীরে ধীরে বাড়ছে। কালীঘাটের পট ও যামিনী রায়ের আঁকা জগন্নাথের পটচিত্রে জগন্নাথের আয়তনয়ন বা পটলচেরা চোখ দেখা যায়। এর থেকে বোঝা যায় জগন্নাথের আয়তনয়নের পরিকল্পনা বঙ্গবলয়ে ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর মধ্যেই যথেষ্ট তৈরি হয়ে গিয়েছিল। বর্তমান সময়ে মৃৎশিল্পে জগন্নাথের এই আয়তনয়ন তাই নতুন কিছু নয়। বাংলার দেবদেবীর মাটির প্রতিমার মুখের আদলের সঙ্গে জগন্নাথের এই ধরনের মৃৎবিগ্রহের মুখের গঠনগত মিল থাকায় এই ধরনের জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ দেখতেও খুব সুন্দর লাগে। সম্প্রতি কলকাতার কালীঘাট ও চেতলা অঞ্চলের পটুয়াপল্লীতে রথযাত্রার কিছুদিন আগে এই ধরনের আয়তনয়নের জগন্নাথের খোঁজ পেয়ে সেখানকার মৃৎশিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কালীঘাটের কালীর চোখ শিল্পীদের কাছে এক্ষেত্রে আদর্শ। তবে তাই আয়তন বা টানা চোখের প্রতি তাদের একটি সহজাত আকর্ষণ রয়েছে। এভাবে হয়তো দেবীতীর্থের প্রভাব মৃৎশিল্পে পরোক্ষে এসে পড়েছে। পরাশক্তি কালী মিশে গেছেন পরমব্রহ্ম জগন্নাথে। এভাবে হয়তো শিল্পীদের স্পর্শে শাক্ত ও বৈষ্ণবের তথাকথিত বিবাদও ম্লান হয়ে গেছে। মহাসম্বন্বয়ের ভূমি এই বঙ্গে উচ্চারিত হয়েছে, “যেই কালী সেই কৃষ্ণ নাম ভেদ এক মূলে।”৩১ রথের সময়ে উত্তর কলকাতার হাতিবাগান সংলগ্ন রথের মার্কেটে এই ধরনের আয়তনয়নের জগন্নাথের দেখা পেলেও বিক্রেতারা এই বিষয়ে বিশেষ আলোকপাত করতে পারেননি। তারা জগন্নাথের মূর্তিগুলি মানিকতলার খালপাড়ের কুমোরবাড়ি থেকে সংগ্রহ করেছেন এটুকুই যা জানা গিয়েছে। আয়তনয়নের জগন্নাথের আরও একটি সূত্রসন্ধান পাওয়া গেছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার নামখানা অঞ্চলে। এই অঞ্চলে আয়তনয়নের জগন্নাথ বহু সংখ্যক পাওয়া গেলেও স্থানীয় শিল্পীদের থেকে জানা গেছে, কলকাতার মৃৎশিল্পের প্রভাবেই এখানে জগন্নাথের আয়তনয়নের ধারাটি প্রচলিত হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেক মূর্তিশিল্পী (যাদের নিজস্ব বড় মূর্তিশিল্পালয় বা স্টুডিও নেই) কলকাতায় এসে কুমোরটুলির মতো বড় শিল্প-অঞ্চলে দুর্গাপূজার আগে থেকে প্রতিমা গড়ার নানা পর্বের নানা কাজ করেন তারা উৎসবের পর্ব মিটিয়ে নিজভূমে ফিরে অনেক সময়ই স্থানীয় কোনো প্রতিষ্ঠিত শিল্পীর মূর্তিশিল্পালয়ে কাজও করেন। তখন অনেক সময় ছাঁচে মাটির প্রতিমার ছাপ তোলা হয়, নতুন ছাঁচ তৈরির জন্য নতুন শিল্পসৃষ্টির চর্চা চলে। অবসর শিল্পীর শিল্পসত্তার বিকাশের পথে সাহায্য করে।
ঝ. — পূর্ণহস্ত জগন্নাথ : জগন্নাথের বহুল প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নর নির্দেশ পেয়ে দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা ছদ্মবেশে জগন্নাথের আদি বিগ্রহ তৈরি করার সময় রাজাকে শর্ত দিয়েছিলেন দেববিগ্রহ তৈরির সময় তিনি একান্তে কাজ করবেন। এই কাজের সময় যদি কেউ তাঁর শর্ত লঙ্ঘন করে কাজে বিঘ্ন তৈরি করে তবে তিনি কাজ অসমাপ্ত রেখে চলে যাবেন। কিছুদিন সব কিছু স্বাভাবিক চলার পর রানি গুণ্ডিচার কৌতুহলে বিশ্বকর্মার শর্তটি ভেঙে যায়। দেবশিল্পী বিশ্বকর্মা জগন্নাথের বিগ্ৰহ অসমাপ্ত রেখে হঠাৎ অন্তর্ধান করেন। সেই অসমাপ্ত বিগ্রহই দৈবাজ্ঞা পেয়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই থেকে জগন্নাথের হস্ত দুটি অসমাপ্ত। পশ্চিমবঙ্গের শান্তিপুর, গুপ্তিপাড়ায় পূর্ণহস্ত জগন্নাথের বিগ্রহ রয়েছে। পূর্ববঙ্গের পাবনার কয়েকটি প্রাচীন মন্দিরেও পূর্ণহস্ত জগন্নাথ রয়েছেন। বলাবাহুল্য দুই বঙ্গেই এই ধারাটি ব্যতিক্রমী। বাংলার মৃৎশিল্পে জগন্নাথের অসমাপ্ত হস্তই সাধারণত দেখা যায়। তবে স্থান বিশেষে পূর্ণহস্ত জগন্নাথও বেশ কিছু অঞ্চলে আঞ্চলিক ঐতিহ্য বহন করে তৈরি করা হয়। বিশেষ করে সংকীর্তনের মতো প্রসারিত ঊর্ধ্ববাহু জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ ছাড়াও পদ্মাসনে বসে আশীর্বাদের ভঙ্গিমাতে দুই হাত সামনে দিকে রাখা অবস্থায় বেশ কয়েকটি ধরনের জগন্নাথের বিগ্রহ দেখা যায়। এছাড়াও বালগোপালের মতো ভঙ্গিতে এক হাত সামনের দিকে এগিয়ে রেখে বসে থাকা অবস্থায় জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ তৈরি করা হয়। তবে এই রকমের শিশু জগন্নাথের মাটির বিগ্রহ সাধারণত ঝুলন পূর্ণিমার জন্য তৈরি করা হয়। এই ধরনের বিগ্রহগুলি দেখে মনে হয় যেন আদতে প্রচলিত গোপালের বিগ্ৰহই রঙের পার্থক্য ও চোখের আকৃতির পার্থক্যে জগন্নাথ বিগ্রহে রূপান্তরিত করা হয়েছে।
ঞ. — ঘোড়ায় টানা উন্মুক্ত রথারূঢ় জগন্নাথ : বঙ্গদেশে প্রচলিত জগন্নাথের প্রাচীন রথগুলির গঠনশৈলী পুরীর রথের চেয়ে আলাদা। পুরীর রথ এক চূড়ার হলেও বাংলার রথ বাংলার মন্দিরের মতো এক চূড়া বা পাঁচ চূড়া অথবা নয় চূড়া কিম্বা তেরো চূড়া নতুবা সতেরো চূড়া অথবা একুশ চূড়া বা পঁচিশ চূড়ার হয়। রথের প্রধান চূড়া হয় একটি, প্রধান চূড়াকে ঘিরে এক একটি তলে কমপক্ষে চারটি ও সর্বোচ্চ বারো চূড়া থাকে। এই ধরনের বাংলার রথারূঢ় জগন্নাথের বেশ কয়েকটি প্রাচীন পটচিত্র পাওয়া যায়। বঙ্গভূমির এই নিজস্ব রথশৈলী বাংলার চিত্রশিল্পে সরাসরি প্রভাব ফেললেও মৃৎশিল্পে সেভাবে খুব বেশি প্রভাব রাখতে পারেনি। পুরীর রথের আদলে তৈরি রথে মধ্যে বসে থাকা জগন্নাথের ছাঁচের তৈরি বিগ্রহ বঙ্গের শান্তিপুর অঞ্চলে প্রচলিত থাকলেও বাংলার রথ বঙ্গীয় মৃৎশিল্পীদের কাছে সেভাবে আগ্ৰহের বিষয় হয়ে উঠতে পারেনি। বরং পুরাণ-মহাকাব্যে যুদ্ধের সময় ঘোড়ায় টানা যে ধরনের রথের উল্লেখ রয়েছে সেই রকমের রথের আয়োজন বাংলার মৃৎশিল্পের বলয়ে দেখা গেছে। বিশেষ করে কৃষ্ণনগর, কুমোরটুলি ও দক্ষিণদাড়ি অঞ্চলে ঝুলনের সময় এক ছাঁচে গড়া কৃষ্ণ ও অর্জুনের যে ধরনের রথসহ মূর্তি পাওয়া যায় সেই ধরনের রথে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামকে বসে থাকতে দেখা যায়। রথের ওপরের দিকে একটা রাজছত্র থাকে। কোনো কোনো মৃৎবিগ্রহে দেখা যায় ছাঁচে ফেলা এই ধরনের গোলাকৃতি রাজছত্রটি মূল বিগ্রহের মাথার চূড়ার অংশে বা রথের একেবারে মাথার দিকে সরু অথচ শক্ত লোহার তার দিয়ে গাঁথা থাকে। এভাবে গাঁথা থাকায় রাজছত্রটি একটু নাড়া লাগলে আগে-পিছে সামান্য নড়ে ওঠে। রাজছত্রটি যাতে আগেপিছে সহজেই নড়তে পারে তার জন্য অনেক মৃৎশিল্পী সরু লোহার তারের বদলে লোহার স্প্রিং দেওয়া হয়। এই ধরনের মৃৎবিগ্রহে রাজছত্রের ওপরে কখনও কখনও মাটির ধ্বজা দেখা যায়। সোনালী রঙে উজ্জ্বল হয়ে থাকা এই রকমের রথের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া থাকে একাধিক মাটির ঘোড়া। সাধারণত এই ঘোড়াগুলিকে সাদা রঙে আঁকা হয়। এই ধরনের রথারূঢ় জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে আরও একটু বৈচিত্র্য আনার জন্য ঘোড়ার বদলে দুধসাদা রাজহাঁসের ব্যবহার দেখা যায়। এই ধরনের রথের অলংকরণে বৈচিত্র্য থাকে। জগন্নাথের রথটি সাধারণত সোনালী রঙে রাঙানো হয়। বাচ্চাদের জন্য তৈরি হওয়া ছোট ছোট কাঠের রথের কথা স্মরণে রেখে এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি করা হয়। এই ধরনের জগন্নাথের রথ শান্তিপুর ঘরানার জগন্নাথের রথের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা।
ট. — কদমতলীতে জগন্নাথ : বৈষ্ণব পদাবলীর সূত্রে কৃষ্ণের অনুসঙ্গবাহী সবচেয়ে বেশি দুটি গাছ হলো কদম ও তমাল। কদমফুল বঙ্গদেশে বর্ষাকালে কৃষ্ণ ও জগন্নাথের সাজ-শৃঙ্গারের অন্যতম সেরা উপকরণের মর্যাদা পায়। কদম গাছের সঙ্গে সরাসরি কৃষ্ণানুসঙ্গ যুক্ত থাকায় মানিকতলা ও শ্রীরামপুর অঞ্চলে বাংলার মাটির জগন্নাথের অবস্থানভূমির প্রেক্ষাপটের অলঙ্করণে কদমতলীর আয়োজন দেখা গেছে। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহে দেখা যায় কদম গাছের সবুজ পাতার মাঝে মাঝে একটি করে সাদা বা হলুদ রঙের কদমফুল ফুটেছে। এমন অজস্র গোল গোল কদমফুল ধরে থাকা একটি কদম গাছের নিচে জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম সুন্দর একটি বেদী বা আসনে সমাসীন রয়েছেন। কদমগাছের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জগন্নাথের আসনের নিচের অংশে ঘন নীল রঙের প্রলেপের ওপর সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম সাদা দাগে যমুনার জলের ঢেউয়ের অনুসঙ্গ তৈরি করেন অনেকে শিল্পী। এই সামগ্রিক প্রয়াসটি দেখে মনে হয় বৃন্দাবনে যমুনা নদীর তীরে কদমগাছের তলে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা অবসর যাপন করছেন। একই ছাঁচে গড়া জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে রঙের পার্থক্যে যমুনা নদীর পরিবর্তে এই অংশটি সবুজ রঙে রাঙিয়ে তৃণভূমির রূপও দেওয়া হয়। এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথের বিগ্রহও ছোট ছোট কাঠের তৈরি রথে বসানো হয়।
ঠ. — চৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গী জগন্নাথ : বাঙালির প্রাণের প্রিয়ধন চৈতন্য মহাপ্রভু। বাঙালির হৃদয়ে মহাপ্রভু জগন্নাথের প্রতি এত প্রেম চৈতন্য মহাপ্রভুই তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। সেই ঐতিহাসিক ও আধ্যাত্মিক পরম্পরায় এখনও বাংলার জগন্নাথ-সংস্কৃতিতে চৈতন্যদেবের অবাধ গতাগতি রয়েছে। বাংলার মৃৎনির্মিত জগন্নাথের বিগ্রহ পরিকল্পনার বৈচিত্র্যে চৈতন্য মহাপ্রভুর আসন পাতা হয়েছে পরম শ্রদ্ধায়। দক্ষিণদাড়ির পটুয়াপল্লীতে সন্ন্যাসী গৌরসুন্দর চৈতন্যদেবের কোলে স্থাপিত বাংলার জগন্নাথকে দেখা যায়। এছাড়া আর এক ধরনের বিগ্রহসজ্জায় দেখা যায় সপার্ষদ জগন্নাথদেব রত্নসিংহাসনে বিরাজিত ও জগন্নাথের বামভাগ থেকে মহাপ্রভু চৈতন্যদেব প্রেমভাবে তাঁকে আলিঙ্গন করে চলেছেন। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্ৰহ যেন চৈতন্যদেবের জগন্নাথময় শ্রীক্ষেত্রবাসের স্মারক। এছাড়া কৃষ্ণনগরের ঘূর্ণি এলাকায় চৈতন্য মহাপ্রভুর যে সব বিগ্রহ তৈরি করা হয় তাতে এক ধরনের চৈতন্য বিগ্রহ রয়েছে, যেখানে গৈরিক উজ্জ্বল বসনে সজ্জিত চৈতন্যদেবের কোলে ছোট একটি একক জগন্নাথ দেখা যায়। তবে এই জগন্নাথ অনেকটাই পুরীর জগন্নাথদেবের আদলে তৈরি করা হয়। এই ধরনের বিগ্রহে চৈতন্যদেবের শরীরে রঙিন কাপড়ের কাজ থাকলেও ছোট জগন্নাথ বিগ্রহে শুধুমাত্র মাটির অলংকৃত কাজই থাকে।
ড. — কৃষ্ণ-চৈতন্য ও জগন্নাথ : বাংলার বৈষ্ণব সংস্কৃতিতে কৃষ্ণ, জগন্নাথ ও চৈতন্যদেব একই ঈশ্বরতত্ত্বের তিন ভিন্ন ভিন্ন প্রকাশ। বাসুদেব ঘোষের পদাবলীতে রয়েছে, “যেই গৌর সেই কৃষ্ণ সেই জগন্নাথ রে।”৩২ নদিয়ার শান্তিপুর অঞ্চল চৈতন্যলীলার অন্যতম পীঠস্থান। সন্ন্যাস গ্রহণের পর এই শান্তিপুর থেকেই মহাপ্রভু চৈতন্যদেবের জীবনে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছিল। এখানেই যেন নির্ধারিত হয়েছিল গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের অভিযাত্রাকে নেতৃত্ব দেবেন মহাপ্রভু চৈতন্যদেব। শান্তিপুর সহ সমগ্র নদীয়াময় বিভিন্ন বৈষ্ণব শ্রীপাটে জগন্নাথের দারুনির্মিত বিগ্রহ রয়েছে। বিশেষত শান্তিপুর মানুষের চোখে মহাপ্রভু চৈতন্যদেবই সাক্ষাৎ জগন্নাথ, তিনিই সাক্ষাৎ কৃষ্ণ। তাঁদের বিশ্বাসে এঁরা তিনে এক, একেই তিন। শান্তিপুরের মানুষের এই গণবিশ্বাস আঞ্চলিক মৃৎশিল্পে প্রভাব ফেলেছে। শান্তিপুরে এক ধরনের সপার্ষদ জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি করা হয় যেখানে রত্নসিংহাসনে বিরাজিত জগন্নাথের ওপরের অংশে খানিকটা পশ্চাৎপটের মতো করে কৃষ্ণ ও চৈতন্যের প্রেমালিঙ্গন দেখানো হয়। এই ধরনের বিগ্রহের পুরোটাই এক ছাঁচে গড়া হয়। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের আদলে কালীঘাটের চেতলা অঞ্চলেও জগন্নাথ তৈরি করা হয়। তবে সূক্ষ্ম শিল্পনৈপুণ্য ও রকমারি রঙের সুসম ব্যবহারে শান্তিপুরের শিল্পীদের কাজ অনেক বেশি মনোগ্রাহী। শান্তিপুরের রথোৎসবে এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহগুলি ছাড়াও আর এক ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের পশ্চাৎপটে কৃষ্ণ ও চৈতন্যদেবকে একই অঙ্গে মিলিত অবস্থায় দেখা যায়। সেই সম্মিলিত বিগ্রহের একই দেহের অর্ধেক অংশে থাকেন কৃষ্ণ, অর্ধেক অংশে থাকেন চৈতন্যদেব। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহে সূক্ষ্ম কারুকার্য অনেক বেশি দেখা যায়। রঙের ক্ষেত্রেও শিল্পীর সচেতনতা লক্ষ্য করা যায়। তবে এই ধরনের জগন্নাথের বিগ্রহ অপেক্ষাকৃত অনেক আধুনিক সময়ের ফসল।
ঢ. — পদ্মাসন ও রত্নসিংহাসনে বিরাজিত জগন্নাথ : বাংলার জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের সম্ভারে জগন্নাথের বসার আসনের বৈচিত্র্য নেহাত কম নয়। আধুনিক সময়ে নতুনত্বের নামে অযথা অনেক বিজাতীয় বস্তু বা অনুসঙ্গ দিয়ে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ সাজানোর রীতি প্রচলিত হলেও জগন্নাথের বসার ঐতিহ্যবাহী আসন হিসেবে পদ্মাসন ও রত্নসিংহাসনের ব্যবহার অনেক বেশি প্রচলিত। বাংলার মৃৎশিল্পের পরিসরে বিশেষ করে ছাঁচের তৈরি প্রায় সমস্ত দেবতার বিগ্রহের বসার অন্যতম প্রধান আসন প্রস্ফুটিত পদ্মফুল। বিশেষ করে পদ্মাসনা লক্ষ্মী, গণেশ ও সরস্বতীর ছাঁচের বিগ্রহ বাংলার প্রায় সর্বত্রই দেখা যায়। সেই আদলেই পদ্মের ওপর সপার্ষদ জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি করা হয়। এছাড়া বেশ কিছু ছাঁচের বিগ্রহে জগন্নাথের বসার জন্য সবুজ ও লাল রঙের বিন্দু দিয়ে রত্নের অনুকল্পে সাজানো রাজসিংহাসনের আয়োজনও যথেষ্ট দেখা যায়। অনেক ছাঁচের সজ্জায় রত্নখচিত সিংহাসনের ওপরের অংশে গোলাকৃতি রাজছত্র ও আসনের মধ্যে দুই পাশে রঙিন পাশবালিশের আয়োজন থাকে। বাংলার মৃৎশিল্পীরা এই ধরনের বসার আসনকে মূলত রত্নসিংহাসন বা সোনার আসন বলেন। এখানে আর একটি কথা বলাবাহুল্য হয়ে ওঠে, এই ধরনের রত্নসিংহাসনের সঙ্গে ওড়িশার জগন্নাথ-সংস্কৃতিতে যে রত্নসিংহাসনের ধারণা রয়েছে তার নামসাদৃশ্য ছাড়া আর কোনো মিল নেই। বাংলার মাটির জগন্নাথের ছাঁচের বিগ্রহে এক ধরনের বেদীর আয়োজন রয়েছে, তবে সেখানেও পুরীর জগন্নাথদেবের বিখ্যাত রত্নসিংহাসনের প্রাথমিক ডমরুসদৃশ আকৃতিটুকুরও মিল পাওয়া যায় না। বাংলার জগন্নাথের বেদীর নক্শা বা অলঙ্করণ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। এমনকি কোনো নক্শা ছাড়া অবস্থায় শুধু আকাশি বা ঘন নীল রঙের বেদীর ওপর সপার্ষদ জগন্নাথকে বসে থাকতে দেখা যায়।
ণ. — পাগড়ি পরা জগন্নাথ : উত্তর ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ সারা বছর একটি বিশেষ পদ্ধতিতে পাগড়ি পরেন। শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরা ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন প্রান্তের বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও সম্প্রদায়ের মানুষ বিশেষ বিশেষ পার্বণে পাগড়ি ব্যবহার করেন। বিবাহ সহ বিভিন্ন সামাজিক আনন্দানুষ্ঠানে স্বতন্ত্র স্বতন্ত্র ধরনের ও রঙের পাগড়ি ব্যবহার করা হয় ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার, ঝাড়খণ্ড, রাজস্থান, গুজরাট, অন্ধ্রপ্রদেশে, মধ্যপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র রাজ্যে। তবে বঙ্গদেশে এই প্রথা বাঙালি হিন্দুদের মধ্যে নেই বললেই চলে। বঙ্গে উত্তরীয় বা উষ্ণীষকে পাগড়িসদৃশ মাথায় দেওয়ার কিছু রীতি রয়েছে। তবে সর্বভারতীয় পরিচয় রয়েছে পাগড়ির। পাগড়ির বিভিন্ন ধরনের বিন্যাসের সঙ্গে যুক্ত সৌন্দর্যের জন্য বিভিন্ন পুরুষ দেবতার বিগ্রহকে ভারতের বিভিন্ন মন্দিরে পাগড়ি পরানো হয়। কিন্তু পুরীর শ্রীমন্দিরে জগন্নাথদেবকে কখনও পাগড়ি পরানো হয় না। অথচ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম থেকে উত্তর ঔপনিবেশিক সময়ে তৈরি হওয়া একটি জনপ্রিয় শাখা সম্প্রদায় তাদের সঙ্ঘের বিভিন্ন মন্দিরে জগন্নাথকে উত্তর ভারতীয় পদ্ধতিতে রঙিন পাগড়ি পরায়। উক্ত সম্প্রদায় নানা উপকরণ দিয়ে বিগ্ৰহসজ্জায় সিদ্ধহস্ত। ফলে পাগড়ি পরা জগন্নাথের ভাবনা বঙ্গদেশেও ধীরে ধীরে প্রসারিত হয়েছে। সম্প্রতি কলকাতার মৃৎশিল্পে পাগড়ি পরা জগন্নাথের প্রকাশ ঘটেছে। মোগল-রাজপুত ঘরানার পোশাকে সজ্জিত জগন্নাথের মাথায় প্রচলিত মুকুটের বদলে পাগড়ির আয়োজন দেখা যায়। জগন্নাথের মাথায় প্রধান দ্বিবিভক্ত পাগড়ির একাধিক সূক্ষ্ম খাঁজের ওপর ঠিক মধ্যখানে বাংলার তালপাতার হাতপাখার মতো একাধিক খাঁজে পাগড়ির কুচি বানানো হয়। এই ধরনের পাগড়ির সঙ্গে বাংলার রাজাদের ব্যবহৃত পাগড়িরও কোনো মিল নেই।
ত. — গৌড়ীয় তিলক ও বধূসজ্জা নক্শায় সজ্জিত জগন্নাথ : গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তিলকরীতি ভারতের অন্য প্রধান বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের থেকে আলাদা। চৈতন্য মহাপ্রভুর প্রভাবে গৌড়ীয় বৈষ্ণবদের তিলকরীতিতে বাংলার অধিকাংশ জগন্নাথ, কৃষ্ণ, রামচন্দ্র ও নারায়ণ সজ্জিত হন। পুরীর জগন্নাথদেবের শ্রীমন্দিরের অভ্যন্তরে রামানুজপন্থার বিশেষ আধিপত্য থাকায় শ্রীমন্দিরের শীর্ষদেশেও রামানুজী তিলক শোভা পায়। তবে পুরীর জগন্নাথদেবের কপালে রামানুজী বা গৌড়ীয় বৈষ্ণব তিলকের কোনোটিই দেখা যায় না। জগন্নাথের তিলকরীতি স্বতন্ত্র। তবে বাংলার মৃৎশিল্পে জগন্নাথের কপালে প্রথাগতভাবে গৌড়ীয় তিলকই শুধু আঁকা হয়। সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে মাটির তৈরি জগন্নাথের বিগ্রহে অন্য অনেক পরিবর্তন এলেও গৌড়ীয় তিলক অপরিবর্তিত থাকার একটি বড় কারণ মৃৎশিল্পীদের একটি বড় অংশ বহু প্রজন্ম ধরে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের অনুসারী। গণধর্মের দেবতা চৈতন্যদেবের প্রভাবে অখণ্ড বঙ্গদেশের নিম্নবিত্ত ও নিম্নবর্গের মানুষেরা বৈষ্ণব ধর্মের আশ্রয় পেয়েছিল। চৈতন্য প্রবর্তিত বৈষ্ণবমত বিভিন্ন শাখা উপশাখায় নানা বিবর্তন পেয়ে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। বাঙালি ঘরানার সাধারণ মৃৎশিল্পীদের মধ্যে শাস্ত্রীয় মূর্তিশিল্পের চর্চা সেভাবে ছিল না। তদুপরি আর্টের খাতিরে অনেক সময়েই মূর্তিশিল্পীরা শাস্ত্রীয় বর্ণনার বাইরে গিয়ে মূর্তি গড়েছেন। ফলে পুরীর জগন্নাথদেবের তিলকরীতির অনুসরণ বঙ্গে ঘটতে পারেনি। প্রচলিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব রীতিই সেই জায়গায় প্রবেশ করে পাদপূরণ করেছে। দেববিগ্রহের সৌন্দর্যায়নে বাঙালি মৃৎশিল্পীরা আরও একটু এগিয়ে গিয়েছেন। বাংলার বধূসজ্জায় যেভাবে কপাল থেকে গাল পর্যন্ত মুখের দুই দিকে প্রায় অর্ধেক চন্দ্রের আকৃতিতে বিভিন্ন কলকা তিলকের ব্যবহার করা প্রায় সেভাবে সাজিয়ে তোলা হয় জগন্নাথকে। এই ধরনের সাজে সাজানোর কাজে শান্তিপুরের শিল্পীরা সিদ্ধহস্ত। তুলির টানে বিভিন্ন রঙের তিলকের অলঙ্করণে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার মুখমণ্ডল আরও সুন্দর ও চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। এমন একটি ধারা কলকাতায় কুমোরটুলি, দক্ষিণদাড়ি, চেতলা এলাকায় প্রচলিত হলেও শান্তিপুরের শিল্পীদের মতো এমন সূক্ষ্ম কারুকার্য দেখা যায় না। বরং মাত্র একটি রঙের রেখার অলঙ্করণ গৌড়ীয় বৈষ্ণব তিলকের পাশ থেকে শুরু করে গালে এসে শেষ হয়। এই তিলক আঁকা হয় তুলিতে। কখনও বিন্দু বিন্দু, কখনও একটানা তিলক আঁকা হয়। তিলক অলঙ্করণের সময় সাধারণত জগন্নাথের জন্য সাদা, সুভদ্রার জন্য লাল ও বলরামের জন্য আকাশি রঙের ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও তিলক সজ্জার জন্য হলুদ ও সবুজ রঙের ব্যবহার দেখা গেলেও শিল্পীরা সচেতনভাবে কালো রঙের ব্যবহার করেন না। শান্তিপুর অঞ্চলের বলরাম, সুভদ্রা ও জগন্নাথের এই ধরনের মাটির বিগ্ৰহের কপালে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম অজস্র নক্শা আঁকেন শিল্পীরা। সূক্ষ্ম নক্শার এমন পারিপাট্য কলকাতায় তৈরি হওয়া জগন্নাথের বিগ্ৰহে সচরাচর খুব একটা দেখা যায় না। তা সে জগন্নাথের তিলকসজ্জার মাত্রাফের যেমনই হোক না কেন তিলকহীন জগন্নাথ দেখা যায় না।
থ. — চকা আঁখি ও আকর্ণ ঠোঁটর জগন্নাথ : ওড়িশায় খুব ভালোবেসে জগন্নাথকে সম্বোধন করা হয় ‘আহে চকা আঁখি’ বলে। পুরীর জগন্নাথদেবের চোখ দুটির প্রান্তভাগ আকর্ণ ব্যাপ্ত আরক্তিম, তার ভেতরে বৃত্তাকারে শোভা পায় সাদা রঙের আঁখিগোলক এবং তার ঠিক মাঝখানে থাকে নয়নমণি। পুরীর জগন্নাথদেবের মতো তিন স্তরের গোলাকার দুচোখ বৃহত্তর বঙ্গের প্রায় কোনো প্রাচীন জগন্নাথের বিগ্রহে দেখা যায় না। বাংলার মৃৎশিল্পে জগন্নাথের চোখ সাধারণত গোলাকৃতির হলেও তা পুরীর জগন্নাথদেবের চোখের মতো নয়। জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে তাঁর চোখ আঁকা হয় সাধারণত সাদা রঙের দুটি ভরাট বিন্দু দিয়ে। পুরী অঞ্চলে তৈরি জগন্নাথের দারুবিগ্রহের ঠোঁটেরও পার্থক্য রয়েছে। ওড়িশার সমস্ত জগন্নাথের বিগ্রহেই দেখা যায় জগন্নাথের ঠোঁট অখণ্ড আকর্ণ ব্যাপ্ত ও বেশ কিছুটা চওড়া। বাংলায় কিন্তু এই রীতিটি প্রায় অপ্রচলিত। বাংলার দারুদেহী জগন্নাথের ঠোঁট সাধারণত ওপরে-নিচে দুভাগে বিভক্ত। হুগলি জেলার মাহেশের জগন্নাথের বিগ্রহের ঠোঁটের আকৃতিও একই রকমের। মাটির তৈরি জগন্নাথের বিগ্রহেও এর থেকে খুব বেশি ব্যতিক্রম নেই। বাংলার জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে ঠোঁট ও বাংলার কৃষ্ণের মৃৎবিগ্রহের ঠোঁটের গঠন প্রায় একই রকমের। তবে এই রীতির বাইরে গিয়ে বর্তমান সময়ে পুরীর জগন্নাথদেবের দারুবিগ্রহের মতোই মাটির জগন্নাথ বিগ্রহে চোখ ও ঠোঁট আঁকার রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। কালীঘাট ও চেতলা অঞ্চলের মৃৎশিল্পীদের মতে মানুষের চাহিদা বদলের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার নিজস্ব মৃৎশিল্পেও ওড়িশার শিল্পরীতির দাগ ধরছে। পুরীর ঘরাণার জগন্নাথের মুখমণ্ডল সাধারণ জনতার কাছে বেশি নান্দনিক হয়ে ওঠায় এই ধরনের মুখাকৃতির জগন্নাথ বিগ্রহের বেশ চাহিদা তৈরি হচ্ছে রথের সময়। পুরানো রীতি ও এর পাশাপাশি নতুন শৈলী দুটিই সমানভাবে চলছে। তবে নবীন প্রজন্মের মৃৎশিল্পীরা মাটির জগন্নাথের বিগ্ৰহে পুরীর জগন্নাথদেবের আদল দেওয়ায় বেশি আগ্ৰহী। তুলনামূলক বিচার করলে দেখা যায় প্রবীণ শিল্পীরা তাঁদের পিতা-পিতামহের রীতি ভাঙতে অনাগ্ৰহী।
দ. — হনুমান ও গরুড় সহ জগন্নাথ : বাংলায় ঝুলনযাত্রার সময় বিক্রি হওয়া মাটির তৈরি নানা পুতুল ও বিগ্রহের মধ্যে সবুজ রঙা রামচন্দ্রের রাজবেশ ও হালকা নীল রঙের কৃষ্ণের রাজবেশের মৃৎবিগ্রহ দেখা যায়। বহু অঞ্চলেই রাম ও কৃষ্ণের রাজবেশের একক বিগ্রহের পাশাপাশি তাঁদের সপার্ষদ রাজসজ্জায় সজ্জিত রাজদরবার বা বৃন্দাবনবাসের বিশেষত রাসবেশ বিগ্রহ তৈরি করা হয়। দুর্গাপূজার সময় ব্যবহৃত দুর্গাচালাতে এই ধরনের চিত্রপট দেখা যায়। বাংলা বা ওড়িশায় জগন্নাথের রাজদরবারের পরিকল্পনা সেভাবে না থাকলেও আধুনিক সময়ে নিত্যনতুনত্বের ভাবনা থেকে হনুমান ও গরুড় সহ জগন্নাথের একচালা বিগ্রহের পরিকল্পনা করা হয়েছে। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের কেন্দ্রে থাকেন জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম। তাঁদের আসনকে ঘিরে পেছনে থাকে একটি চালা। এই চালার দুই প্রান্তের দ্বার দুটি রক্ষা করেন হনুমান ও গরুড়। পুরীতে একটি জনবিশ্বাস রয়েছে, গরুড় ও হনুমান জগন্নাথের নিত্যভক্ত। শ্রীমন্দিরে তাঁরা দুজন জগন্নাথের সেবায় নিত্যনিয়োজিত। ওড়িশার এই ভাবনা হয়তো সঞ্চারিত হয়েছে বঙ্গেও। বাংলার জগন্নাথের এই ধরনের মৃৎবিগ্রহগুলি সাধারণত ছোট ছোট রথের ভেতরে ব্যবহৃত হয় না। জগন্নাথের এই ধরনের বিগ্রহের সঙ্গেও রাজছত্রের আয়োজন থাকে। এক চালার নিচের অংশে বেদী তৈরি করা হয়। তবে জগন্নাথ বিগ্রহের গড়নে বাংলার নিজস্ব শৈলীই বজায় থাকে। পারিপাট্য ও সূক্ষ্ম নক্শার বিন্যাস এই ধরনের বিগ্ৰহের শ্রীবৃদ্ধি করে। এই ধরনের সুন্দর কারুকার্য খচিত মাটির বিগ্রহ বহু মানুষ নিজস্ব গৃহসজ্জায় ব্যবহার করেন।
ধ. — বাংলার অলংকারে সজ্জিত জগন্নাথ : বাংলার জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহে যে ধরনের গয়না বা অলংকার ব্যবহার করা হয় তা সাধারণত বেশিরভাগ পুরুষ দেবতারই সাজসজ্জায় ব্যবহৃত হয়। জগন্নাথের মাথায় মুকুট, কানে কুণ্ডল (কখনও মকর), গলায় রত্নহার ও মালা, কোমরে কোমরবদ্ধ এই চারটি অলংকারেই সাধারণত জগন্নাথের শৃঙ্গার সম্পূর্ণ হয়ে যায়। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার লক্ষ্মীকান্তপুর ও জয়নগর অঞ্চলে নারী দেবীদের অলংকারের সজ্জায় মাটির জগন্নাথের বিগ্রহ সাজানোর রেওয়াজ রয়েছে। এক্ষেত্রে জগন্নাথের মাথায় দুই স্তরের মুকুট, কানের পাশে দুই স্তরে বিভক্ত কানপাশা ও কুণ্ডল, বুকে ঝোলে কোমর পর্যন্ত লম্বা বুকপাটা ও রত্নহার, কোমরে কোমরবদ্ধ ও হাতের সূচনা অংশে থাকে বাজুবন্ধ। মাটির তৈরি জগন্নাথের বিগ্রহে এত অলংকারের বাহুল্য বাংলার অন্য কোথাও তেমন চোখে পড়ে না। শান্তিপুরে ও কৃষ্ণনগরের মাটির তৈরি জগন্নাথের বিগ্রহগুলি শিল্পনৈপুণ্যের দিক থেকে অসাধারণ। বিশেষ করে শান্তিপুর অঞ্চলের জগন্নাথের মুকুটে খুব সুন্দর অলংকরণ থাকলেও এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের বুকে বুকপাটা দেখা যায় না। শান্তিপুরের জগন্নাথের বুক সম্পূর্ণ উন্মুক্ত থাকে। শান্তিপুর অঞ্চলে এখনও বৈষ্ণব ও ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রভাব থাকায় জগন্নাথের উন্মুক্ত বুকে সাদা রঙের রেখায় যজ্ঞোপবীত বা পৈতা আঁকা হয়। এই রেওয়াজ শান্তিপুর ছাড়া অন্যত্র দেখা যায় না।
ন. — দারুবিগ্রহের অনুরূপ মৃৎ-জগন্নাথ : ১৯৯১ খ্রিস্টাব্দে গ্যাট চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারত এবং সেই সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বায়নের দরজা খুলে যায়। বিশ্বায়নের পরবর্তী সময়ে প্রথম দফায় মুক্ত বাণিজ্যের বৃহত্তর প্রসার ঘটায় ও দ্বিতীয় দফায় ২০১০ খ্রিস্টাব্দের থেকে ধীরে ধীরে আন্তর্জালিক পদ্ধতিতে বিভিন্ন গণম্যাধ্যমে বিশ্ববাণিজ্যের পথ প্রসারিত হওয়ার পর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সহজেই ওড়িশার লোকশিল্পের সম্ভার বা পণ্য ঘরে বসে সংগ্রহ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। এভাবে শুধু পশ্চিমবঙ্গ থেকে কেন পৃথিবীর যে কোনো প্রান্ত থেকেই কাঙ্ক্ষিত নির্দিষ্ট উপকরণ সহজে সংগ্রহ করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। ওড়িশার কাঠের তৈরি জগন্নাথের বিগ্রহ এই সব কারণে এখন সারা বিশ্বেই ছড়িয়ে পড়েছে। তাছাড়া বিশ্বায়নের যুগে এখন পৃথিবীময় লোকশিল্পের অনেকগুলি ধারাই অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার লোকশিল্পের স্বাভাবিক সহজসরল নান্দনিক ভাবকে ছাপিয়ে ভীষণভাবে জটিল ও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম শিল্পের দিকে মানুষের ঝোঁক বাড়ছে। লোকায়ত শিল্পকলার চেহারা অনেক বদলে গেছে। যেমন দেখা গেছে বাংলার প্রথাগত আলপনার ধারণা থেকে সরে গিয়ে স্বতন্ত্র হওয়া গৃহকোণের ছাপা নতুন আলপনায়। এমনকি শান্তিনিকেতন ঘরানার রঙিন আলপনায় এসেছে অনেক পরিবর্তন। বাংলার লোকশিল্পের অন্তর্ভুক্ত জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের ক্ষেত্রেও গত কয়েক দশকে নীরবে এই ঘটনা ঘটে গেছে।
পশ্চিমবঙ্গে ওড়িশার দারুবিগ্রহের অনুরূপ জগন্নাথ তৈরি হয়েছে মাটি দিয়ে। আট, দশ ও বারো ইঞ্চির এই ধরনের মাটির জগন্নাথ সম্প্রতি কলকাতার কুমোরটুলি অঞ্চলে রথের কিছুদিন আগে থেকে বিক্রির জন্য তৈরি হচ্ছে। এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথের মুখের আদল সচেতনভাবে ওড়িশার রীতিতে তৈরি করার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই ধরনের মৃৎবিগ্রহগুলিও তৈরি করা হচ্ছে ছাঁচে। জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামকে নিয়ে তৈরি হচ্ছে একটি ‘সেট’। তিনজনের বিগ্ৰহের জন্য পৃথক তিন রকমের ছাঁচ ব্যবহার করা হচ্ছে। তবে কাঠের তৈরি বিগ্রহের মতো সামনের দিকে এগিয়ে থাকা লম্বা হাত ছাঁচের বিগ্রহে দেখা যায় না। হয়তো এক ছাঁচে তা তৈরি করার ক্ষেত্রে অসুবিধা রয়েছে বলেই এই ব্যবস্থা। কলকাতার মৃৎশিল্পের বাজারে এই ধরনের মাটির জগন্নাথ বিগ্রহের দাম তুলনামূলক অন্যরীতিতে তৈরি মাটির জগন্নাথের চেয়ে বেশি। এই ধরনের বিগ্রহের দাম ওড়িশার সাধারণ আম কাঠের তৈরি জগন্নাথের প্রায় কাছাকাছি। মাটির চেয়ে কাঠের বিগ্রহ দীর্ঘস্থায়ী হয়। স্বাভাবিকভাবেই এর ফলে এই ধরনের মৃৎনির্মিত জগন্নাথের ভবিষ্যতের বাণিজ্যিক সাফল্যের বিষয়ে বেশ কয়েকজন মৃৎশিল্পী কিছুটা হলেও সন্দিহান। বলাবাহুল্য তাদের ভাবনা নেহাত অমূলক নয়। তবে নমনীয় মাটি দিয়ে অবিকল কাঠের বিগ্রহের অনুরূপ জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরিতে বাঙালি শিল্পীদের দক্ষতা সত্যিই প্রশংসনীয়। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহগুলি পুরীর জগন্নাথদেবের রূপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে রঙ করা হয়। এছাড়া কিছু জগন্নাথ বিগ্রহ শুধুমাত্র কাঠের খয়েরি রঙ ও বিগ্ৰহের বিশেষ বিশেষ অংশ সোনালী রঙে রাঙানো হয়। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহ মূলত পুরীর জগন্নাথের আদলে তৈরি হলেও তাতে মাটির দিয়ে বঙ্গীয় রীতিতে অলংকার ও বস্ত্রবিন্যাস করা হয়। এমনকি জগন্নাথের মাথায় যে মুকুট থাকে তাতেও মাটির ছাঁচে গড়া ময়ূরের পালক বসানো হয়। এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহের মধ্যে কাঠের মতো এক রঙা জগন্নাথের চেয়ে বহু রঙে রঙিন জগন্নাথ বেশি তৈরি করা হয়।
প. — মাটির সরায় জগন্নাথ : পশ্চিমবঙ্গে পোড়া মাটির সরায় দেবদেবীর পটচিত্র এঁকে পূজা করার রীতি ছিল না। এই রীতিটি পশ্চিমবঙ্গে প্রচলিত হয়েছে স্বাধীনতার দাম দিতে পূর্ববঙ্গ থেকে বাস্তুহারা হয়ে আসা অজস্র বাঙালি হিন্দুর হাত ধরে। উদ্বাস্তু মানুষেরা পূর্ববঙ্গ থেকে তাদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতিকে পশ্চিমবঙ্গে বহন করে এনেছিলেন। মূলত তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ধরেই পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা এত জনপ্রিয় হয়েছিল। পূর্ববঙ্গের বিশেষত বরিশাল ও ঢাকা অঞ্চলে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজায় লক্ষ্মীসরায় দেবীর পূজার রীতি রয়েছে। লক্ষ্মীসরার জনপ্রিয়তার প্রভাব এসে পড়েছে বাংলার জগন্নাথ সংস্কৃতিতে। লক্ষ্মীর সরায় সাধারণত সরার ওপর খড়িমাটির প্রলেপ দিয়ে তার ওপর বেলের বা তেঁতুল বীজের আঠা দিয়ে বিভিন্ন রঙ গুলে তা দিয়ে পটচিত্র আঁকা হয়। মাটির তৈরি লক্ষ্মীসরার আর একটি ধারায় মাটির সরার ওপর ছাঁচের ছাপ ফেলে লক্ষ্মীর অবয়ব তৈরি করে রঙ দেওয়ার রীতি রয়েছে। মূলত কালীঘাট ও পানিহাটি অঞ্চলে এই ধরনের লক্ষ্মীপট তৈরি করা হয়। লক্ষ্মীসরার এই দুই ধারার অনুসরণে জগন্নাথের সরা তৈরির রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। একটি ধারায় সরার ওপর সরাসরি একক বা সপার্ষদ জগন্নাথ আঁকা হয়। দ্বিতীয় ধারায় মূল সরার ওপর মাটির তৈরি জগন্নাথের একক বা সপার্ষদ বিগ্রহ জুড়ে দেওয়া থাকে। ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় লোকশিল্প উৎসবে এই ধরনের সরার সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। লক্ষ্মীসরার মতো জগন্নাথের সরাও পোড়ামাটির তৈরি। লক্ষ্মীসরা যেভাবে লক্ষ্মীপূজার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত সেভাবে জগন্নাথের এই ধরনের সরা জগন্নাথের পূজার সঙ্গে যুক্ত নয়। সরার নান্দনিক সাফল্য রয়েছে বঙ্গে এবং সেই সূত্র ধরেই বাংলার সরাশিল্পে জগন্নাথের গতাগতি শুরু হয়েছে। এছাড়া আর এক ধরনের জগন্নাথের সরায় দুপাশে দুই ময়ূরের মাঝখানে শুধুমাত্র একক জগন্নাথই দেখা যায়। এখানেও জগন্নাথের রঙ মাটির জগন্নাথের ধারার মতোই কালো। তবে জগন্নাথের গয়না ও পশ্চাৎপটে সরায় সরায় বৈচিত্র্য রয়েছে। তবে পুরীর শ্রীমন্দির ও রথের ছবিই জগন্নাথের পটে বেশি দেখা যায়। এছাড়াও শুধুমাত্র ঘন লাল, নীল ও সবুজ পশ্চাৎপটের ওপর সাদা রঙে বাংলার নিজস্ব আলপনার আয়োজনও করা হয়। এপ্রসঙ্গে আর একটি তথ্য পেল করা যেতে পারে, উত্তরবঙ্গে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের এখনও প্রাধান্য থাকায় এই অঞ্চলের অধিকাংশ লক্ষ্মীসরায় রাধা-কৃষ্ণের পটচিত্র আঁকা হয়, রাধা-কৃষ্ণের নিচের প্যানেলে থাকেন লক্ষ্মীদেবী। ক্ষেত্রসমীক্ষার সময় আমরা জানতে পারি মালদহের সামসি অঞ্চল থেকে কর্মসূত্রে কলকাতায় আসা একটি পরিবারের লক্ষ্মীসরায় রাধা-কৃষ্ণের পটের বদলে সপার্ষদ জগন্নাথদেবের উপস্থিতি রয়েছে। সেই পরিবারের কাছে এই ব্যতিক্রমের কারণ জানতে চাওয়ায় এটি তাদের পারিবারিক প্রথা, এর চেয়ে বেশি কিছু জানা যায়নি। লক্ষ্মীসরায় জগন্নাথের পটচিত্র আঁকা হয় না। তাই প্রথমদিকে এই বাড়ির সদস্যরা কুমোরবাড়ি বা পটুয়াদের পাড়ায় কাছে নিজেদের ফরমায়েশ মতো পট আঁকিয়ে নিতেন। এই উপায় না থাকলে এখন পোড়া মাটির সরা বাড়িতে এনে তারা নিজেরাই পটটি এঁকে নেন।
ফ. — চতুর্বাহু জগন্নাথ : ওড়িশা ও বঙ্গের অধিকাংশ প্রাচীন জগন্নাথের বিগ্রহই পুরীর জগন্নাথ বিগ্রহের অনুরূপ দ্বিভুজ বিগ্রহ। পুরীতে জগন্নাথের গজ-উদ্ধারণ বেশের সময় জগন্নাথকে চতুর্বাহুতে সাজানো হয়। জগন্নাথক্ষেত্র বিষ্ণুতীর্থ। জগন্নাথ বিষ্ণুতত্ত্ব। জগন্নাথের বিভিন্ন মন্ত্র, পূজাস্তোত্র ও জগন্নাথের সহস্রনাম স্তোত্রে তাঁকে বারবার চতুর্বাহু বলে স্তুতি ও সম্বোধন করা হয়েছে। স্কন্দপুরাণের বিষ্ণুখণ্ডের অন্তর্গত পুরুষোত্তমমাহাত্ম্য অংশেও তাঁকে চতুর্বাহু বলা হয়েছে।৩৩ পশ্চিমবঙ্গের বাগনান অঞ্চলে রয়েছেন চতুর্বাহু জগন্নাথ। এই পৌরাণিক ও লোকায়ত সূত্রগুলির জন্যে বঙ্গের মৃৎশিল্পের বলয়ে আধুনিক সময়ে চতুর্বাহু জগন্নাথের বিগ্রহ তৈরি হওয়া কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। শুধুমাত্র স্বতন্ত্র শিল্পনৈপুণ্যের তাগিদে কৃষ্ণনগর অঞ্চলের কিছু শিল্পী চতুর্বাহু জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ তৈরি করেন। এই ধরনের কাঁচামাটির বিগ্ৰহ রঙহীন অবস্থায় দেখে বিষ্ণুমূর্তিই মনে হয়। সম্ভবত একই ছাঁচ থেকে চতুর্বাহু জগন্নাথ ও চতুর্বাহু বিষ্ণুর মূর্তির ছাপ তোলা হয়। কাঁচামাটি সূর্যের তাপে শুকিয়ে গেলে মৃৎবিগ্রহগুলি রঙ করার সময় জগন্নাথের ক্ষেত্রে কালো রঙ ও বিষ্ণুর ক্ষেত্রে নীল রঙের প্রাথমিক প্রলেপ দেওয়া হয়। চোখের গড়নে পার্থক্য না থাকলেও বিগ্রহের চোখ আঁকার সময় জগন্নাথ ও বিষ্ণুর চোখ স্বতন্ত্র ভঙ্গি পায়। ঝুলনের সময় শ্রীরামপুর, শান্তিপুর, কুমোরটুলিতে দ্বিভুজ কৃষ্ণের রাজবেশের মৃৎবিগ্রহ পাওয়া যায়। এই ধরনের মৃৎনির্মিত কৃষ্ণের বিগ্ৰহও রঙের নৈপুণ্যে জগন্নাথ বিগ্রহ করে তোলা হয়। এই দুই ক্ষেত্রেই জগন্নাথ পূর্ণদেহে উপস্থিত থাকেন। চৈতন্যোত্তর সময়কালে বাংলার জগন্নাথ রাম, কৃষ্ণ ও নারায়ণের সঙ্গে একতত্ত্ব হয়ে গেছেন। এই ভাবনাটি বঙ্গে এখনও জীবন্ত। তাই বিষ্ণুবিগ্রহ বা কৃষ্ণের বিগ্রহেই জগন্নাথের আবেশ তৈরির মানসিক তাগিদ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবানুরাগী বাঙালি শিল্পীদের অনন্য ধর্মবোধের প্রকাশ করে। আরও একটি কথা এখানে না বললেই নয়, শিল্পীরা ছাঁচের বিগ্রহ বেশিরভাগই চাহিদা অনুযায়ী বিক্রির জন্য তৈরি করেন। বিষ্ণু ও কৃষ্ণের অবয়বের জগন্নাথ বিগ্রহের চাহিদা ও জনপ্রিয়তা সাময়িক সময়ের জন্য হলেও বাঙালি সমাজে তৈরি হয়েছে। নইলে বছরের পর বছর ধরে এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহ রথযাত্রার পর ঝুলনযাত্রার সময়ে মৃৎশিল্পীরা আর তৈরি করতেন না। তবে এই কথাও ঠিক যে, এই ধরনের জগন্নাথ বিগ্রহ আদতে ব্যতিক্রমীই। এমনও হতে পারে যে, ওড়িশার পুরীতে জগন্নাথের অনবসর সেবাকালীন পটচিত্রের অনন্য শিল্পনৈপুণ্যের প্রভাব শিল্পীদের প্রভাবিত করেছে।
ব. — বাংলার আটচালা মন্দিরে বিরাজিত জগন্নাথ : বাঙালি মৃৎশিল্পীদের শিল্পদক্ষতার অনন্য পরিচয় পাওয়া যায় বাংলার আটচালা মন্দিরে বিরাজিত জগন্নাথের বিগ্রহ নির্মাণে। বাংলার প্রাচীন মন্দিরগুলি বাংলার গৌরব, বাঙালির নিজস্ব সম্পদ ও সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের স্মারক। সপ্তদশ শতাব্দী থেকে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত অখণ্ড বঙ্গে তৈরি হওয়া মন্দিরগুলির বিভিন্ন মন্দিরশৈলীর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছিল চারচালা ও আটচালা মন্দিরশৈলী। এমনকি আধুনিক সময়ে মন্দির নির্মাণের পদ্ধতিতে অনেক পরিবর্তন এলেও চারচালা ও আটচালা মন্দিরশৈলীর সৌন্দর্যের জন্য এই জনপ্রিয় রীতিতে এখনও নতুন মন্দির তৈরি করা হয়। বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে মূলত শিবমন্দির হিসেবেই আটচালা মন্দিরে তৈরি করা হতো। মৃৎশিল্পের পরিসরে এই ধরনের আটচালা মন্দিরের অনুকরণে ছোট ছোট আকারের ছাঁচের তৈরি মন্দির বানানোর রেওয়াজ রয়েছে। কিছুকাল আগেও হুগলির তারকেশ্বর অঞ্চলে এই ধরনের মাটির আটচালা মন্দিরের মধ্যে ছোট আকারের মাটির শিবলিঙ্গের মৃৎশিল্প পাওয়া যেত। বর্তমান সময়ে এই ধরনের মন্দির খুব বেশি বিক্রি হতে দেখা যায় না। তবে শান্তিপুর অঞ্চলে এই রীতিটি এখনও সামান্য হলেও বজায় রয়েছ। শান্তিপুর অঞ্চলে যেভাবে মাটির রথমধ্যে জগন্নাথ তৈরি করা হয় সেভাবেই আটচালা মন্দিরের মধ্যে জগন্নাথ সংখ্যায় অল্প হলেও তৈরি করা হয়। তবে এক্ষেত্রেও আটচালা মন্দিরের মধ্যে একক জগন্নাথই তৈরি করা হয়। মাটির মন্দিরগুলি সাধারণত গাঢ় খয়েরি বা লাল রঙে রাঙানো হয়। রাঢ় বাংলার টেরাকোটা মন্দিরের ছায়া এর মধ্যে রয়েছে। এখানেও মন্দিরের মধ্যে বিরাজিত জগন্নাথের গায়ের রঙ কালো।
ভ. — ডাকের সাজের জগন্নাথ : বাংলার ডাকের সাজ সাধারণত দুর্গাপূজায় সাবেকি দুর্গা প্রতিমার অলংকরণে বহুল ব্যবহৃত হয়। বর্তমান সময়ে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের অলংকরণে ডাকের সাজের ব্যবহার প্রচলিত হয়েছে। বিশেষ করে শারদোৎসব ও দীপাবলির সময়ে কুমোরটুলির শিল্পীরা বিভিন্ন মাপের থার্মোকলের বোর্ডের ওপর ছোট মাপের দুর্গা বা কালীর মুখ বসিয়ে অলংকরণ করেন। এই ধরনের শিল্পগুলি সরাসরি দেবদেবীর পূজার সঙ্গে যুক্ত নয়। কিন্তু বিভিন্ন দোকান, বাণিজ্য-মল, অফিস প্রভৃতি প্রতিষ্ঠান ও অনুষ্ঠান-মঞ্চ সাজানোর কাজে এখন বহুল ব্যবহার করা হয়। বঙ্গদেশে রথযাত্রার প্রসার যে হারে বেড়ে চলেছে তাতে দুর্গা বা কালীর মুখপ্রতিমার অনুসরণে বহু প্রতিষ্ঠানেই রথের সময় জগন্নাথের মুখপ্রতিমা সাজানোর রেওয়াজ তৈরি হয়েছে। মাটির তৈরি এই ধরনের জগন্নাথ মুখবিগ্রহের অনুকরণে ডাকের সাজের ব্যবহার করা হচ্ছে। এই ধরনের জগন্নাথের মুখের আদল খাঁটি ওড়িশার জগন্নাথের মতো। ওড়িয়া রীতিতে তৈরি জগন্নাথের কালো মুখমণ্ডলের চারিদিকে সাদা রঙের বাংলার ডাকের সাজ বড়ই চিত্তাকর্ষক হয়ে ওঠে। আগে ডাকের সাজ মূলত শোলা দিয়ে তৈরি করা হতো, এখনও সেই রীতি রয়েছে। কিন্তু এর পাশাপাশি কৃত্রিম শোলা হয়ে উঠেছে থার্মোকল। ডাকের সাজে ব্যবহৃত প্রাকৃতিক শোলার রঙ একটু ফিকে সাদা, কৃত্রিম থার্মোকলের রঙ উজ্জ্বল সাদা। এই ধরনের জগন্নাথকে মাথায় মুকুট, কানের দুই পাশে কানপাশা ও গলায় হার দিয়ে ডাকের সাজে সাজিয়ে তোলা হয়। বঙ্গে দেবী দুর্গার বিগ্রহ সাজিয়ে তুলতে যেমন বহুদিন ধরে শোলার তৈরি ডাকের সাজের ব্যবহার করা হয় তেমনই উৎকলের ঐতিহ্যবাহী পুরীর শ্রীমন্দিরের জগন্নাথের প্রধান বত্রিশ প্রকারের শৃঙ্গারের মধ্যে পদ্মবেশ, গজানন বেশ, নাগার্জুন বেশে শোলা বহুল ব্যবহৃত হয়। এর মধ্যে পদ্মবেশে ব্যবহৃত অনুকল্প পদ্মের প্রধান উপকরণই শোলা।৩৪ যেভাবে ওড়িশায় জগন্নাথের শৃঙ্গারে শোলার তৈরি বিভিন্ন সাজসজ্জার ব্যবহার করা হয় তার থেকে বাংলার দেবীসজ্জায় ব্যবহৃত ডাকের সাজের অলংকারের পার্থক্য অনেক। কিন্তু ঘটনাচক্রে ওড়িশার রাষ্ট্রদেবতা জগন্নাথের মুখবিগ্রহগুলি বাংলার শিল্পীদের কাছে বাঙালির অতি পরিচিত ডাকের সাজেই সজ্জিত হন, ওড়িশার শোলার কাজের প্রভাব এখনও বাঙালি শিল্পীদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। জগন্নাথের এই ধরনের মুখবিগ্রহে হলুদ কাগজের ওপর নক্সা তোলা রঙিন চুমকি ও জরির কাজের অলংকারের ব্যবহারও শুরু হয়েছে। তবে তা বিশেষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠেনি।
ম. — সাধারণ অলংকারের সাজে জগন্নাথ : মাটির তৈরি ছোট মাপের জগন্নাথের সাজসজ্জা তথা অলংকরণ মূলত মাটি দিয়েই তৈরি করা হয়। একটু বড় আকারের মাটির জগন্নাথ কলকাতা ও অন্য অঞ্চলে প্রচলিত সেখানে জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের অলংকরণে হলুদ রঙের কাগজের ওপর রঙিন জরি ও রঙবেরঙের চুমকি দিয়ে বিভিন্ন কলকা তোলা হয়। এই ধরনের কাগজের অলংকারের মধ্যে থাকে মাথার মুকুট, কানের কুণ্ডল, গলার হার, বুকের বুকপাটা ও কোমরের কোমরবদ্ধ। এই ধরনের সাজে সজ্জিত মৃৎনির্মিত জগন্নাথ উত্তর কলকাতার বেলঘরিয়া অঞ্চলে দেখা যায়। এছাড়াও বৃহত্তর সুন্দরবন অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত সন্দেশখালি, পাথরপ্রতিমা, রাক্ষসখালি প্রভৃতি দ্বীপাঞ্চলে মাটির জগন্নাথের বিগ্রহসজ্জায় এমন ধরনের অলংকারের ব্যবহার বহুদিন ধরে প্রচলিত রয়েছে। এই অঞ্চলে এমন বহু মানুষ অনেক পুরুষ ধরে বসবাস করছেন যাদের পূর্ববর্তী বাসস্থান ছিল ওড়িশায়। তাই পশ্চিমবঙ্গের একেবারে প্রান্তজেলায় জগন্নাথের এত বিচিত্র অথচ লোকায়ত গন্ধমাখা প্রসার রয়েছে।
য. — বিবিধ অনুসঙ্গে জগন্নাথ : সময় বদলেছে অনেক। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্রচলিত ছক ভেঙে নতুন শিল্পসৃষ্টির তাগিদ থেকে বাংলার বহু মৃৎশিল্পী জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহ নির্মাণের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য এনেছেন। জগন্নাথের মৃৎবিগ্রহের প্রেক্ষাপট তৈরির ক্ষেত্রে এসেছে অনেকগুলি ছোট-বড় পরিবর্তন। জগন্নাথকে নতুন থেকে নতুনতর করে সাজিয়ে তোলার জন্য ব্যবহার হতে শুরু করেছে মাটির তৈরি ময়ূরের পালক, অশ্বত্থের পাতা, পদ্মবন, তবলা, সাধারণ নৌকা, ময়ূরপঙ্খী নৌকা, নাম পরিচয়হীন গাছ, প্রস্ফুটিত পদ্ম, গোলাপ, অপরাজিতা ও জবা ফুল, বেতের কুলো, গোটা পান, ঝিনুক, শঙ্খ প্রভৃতি।
চৈতন্য-পূর্ব সময়ে বঙ্গদেশের তুঙ্গভূমে ওড়িশা প্রবাসী মানুষের হাত ধরে বঙ্গভূমিতে প্রথম মহাপ্রভু জগন্নাথদেবের যেদিন প্রতিষ্ঠা ঘটেছিল তারপর থেকে বাংলার ধর্ম, সমাজ, কৃষ্টি ও সংস্কৃতিতে জগন্নাথ মহাপ্রভুর অবাধ গতাগতি রয়েছে। জগন্নাথ যতটা ওড়িশার, ততটাই বঙ্গের এবং ততটা সমগ্র ভারত ও বিশ্বের। বিদেশে অবস্থিত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক হিন্দু সংগঠন প্রতিনিয়ত জগন্নাথ সংস্কৃতির প্রসার ঘটাচ্ছে। যখন সমগ্র বিশ্বময় জগন্নাথ সংস্কৃতির এমন একটি বৃহত্তর প্রসার ঘটেছে তখন জগন্নাথের দ্বিতীয় নীলাচলের (মাহেশকে জগন্নাথের দ্বিতীয় নীলাচল ও নব নীলাচল বলা হয়) বঙ্গদেশে তার অন্যথা হবে কীভাবে? পশ্চিমবঙ্গের মূলধারার সংস্কৃতি ও লোকায়ত সংস্কৃতির উভয় ধারায় জগন্নাথ তাঁর অনন্য যাতায়াত বজায় রেখে চলেছেন। বাংলার মৃৎশিল্পীরা নিজস্ব অধ্যাবসায়ে জগন্নাথকে নিত্যনতুন করে সাজিয়ে তোলার সাধনা চালিয়ে যাচ্ছেন। বাংলার মৃৎনির্মিত জগন্নাথের যে অভিযাত্রা বঙ্গ-তনয় মহাপ্রভু চৈতন্যদেব শ্রীরঙ্গমে বসবাসের সময় সূচনা করেছিলেন সেই ধারা বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে নানাভাবে বিবর্তিত হয়ে, নানা নতুন অনুসঙ্গে সজ্জিত হয়ে আজও ইতিহাসকে জীবন্ত করে রেখেছে। বিশ্বায়নের যুগে বঙ্গদেশে জগন্নাথের দারুবিগ্রহের যথেষ্ট প্রসার ঘটেছে কিন্তু তাতে বাংলার নিজস্ব শৈলীতে নির্মিত মৃৎনির্মিত জগন্নাথের জনপ্রিয়তা কোনো অংশে কমেনি। এ যে বাংলার মৃৎশিল্পের সাধকদের জগন্নাথ-সাধনা। এই সাধনা কখনও কি আর বিফলে যেতে পারে? পারে না, কখনই পারে না। বাংলার মৃৎশিল্পীদের এই সাধনেই জগন্নাথ প্রতি বছর আরও নিত্যনতুন হয়ে আমাদের নয়নপথগামী হয়ে ওঠেন।
তথ্যসূত্র
১. গোস্বামী, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, প্রথম সংস্করণ, গীতা প্রেস, গোরক্ষপুর, ২০২১, পৃ. ১৫৯
২. তদেব, পৃ. ১৫৪
৩. তদেব, পৃ. ১৫৪
৪. তদেব, পৃ. ১৫৪
৫. তদেব, পৃ. ১৫৪ (পাদটীকা দ্রষ্টব্য)
৬. গোস্বামী, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’ (অখণ্ড), প্রথম সংস্করণ, গৌড়ীয় মঠ, বাগবাজার, ৪৭১ চৈতন্যাব্দ, পৃ. ৩০১ (পাদটীকা দ্রষ্টব্য)
৭. সান্যাল, অবন্তীকুমার, ‘বাংলা সাহিত্যের সরল বৃত্তান্ত : পঞ্চদশ-ষোড়শ শতাব্দী’, প্রথম সংস্করণ, দেবেন্দ্র গ্ৰন্থালয়, কলিকাতা, ১৯৭৯, পৃ. ৩২-৩৩
৮. ভট্টাচার্য, জগদীশ (সম্পাদিত), ‘চৈতন্য প্রসঙ্গ’, দ্বিতীয় সংস্করণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলকাতা, ১৪২১ বঙ্গাব্দ, পৃ. ২১২-২১৬
৯. গোস্বামী, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, গীতা প্রেস, পৃ. ১৯৫
১০. গোস্বামী, বৃন্দাবন দাস, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যভাগবত’, প্রথম সংস্করণ, সাহিত্য অকাদেমি, নতুন দিল্লি, ২০১১, পৃ. ২২১
১১. গোস্বামী, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, গীতা প্রেস, পৃ. ১৭৭-১৮০
১২. তদেব, পৃ. ২২৯-২৩০
১৩. তদেব, পৃ. ২৬২-২৬৩
১৪. ভট্টাচার্য, কুমুদরঞ্জন, ‘সংক্ষিপ্ত বৈষ্ণব অভিধান’, প্রথম সংস্করণ, ফার্মা কেএলেম প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৭৮, পৃ. ৫৭
১৫. চক্রবর্তী, নরহরি, ‘ভক্তিরত্নাকর’, দ্বিতীয় সংস্করণ, শ্রীরামদেব মিশ্র প্রকাশিত, মুর্শিদাবাদ, ৪২৬ চৈতন্যাব্দ, পৃ. ১৫
১৬. গোস্বামী, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, গীতা প্রেস, পৃ. ২৬২
১৭. Lord Chaitanya’s Jagannath Deities, Publishing Date : 11-08-2016, Internet archive edition, Visiting Date : 06-08-2023, Time : 01.26 PM, weblink : https://www.bvmlu.org/SCM/deities/index.html
১৮. গোস্বামী, শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ, ‘শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত’, গীতা প্রেস, পৃ. ২৬৩-২৬৫
১৯. রায় ভট্ট, অমূল্যধন, ‘শ্রীশ্রীদ্বাদশ গোপাল বা শ্রীপাটের ইতিবৃত্ত’, প্রথম সংস্করণ, মানসী প্রেস, কলিকাতা, ১৩৩১ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৮৯
২০. মুখোপাধ্যায়, সোমা, ‘বাংলার জগন্নাথ’, প্রথম সংস্করণ, তবুও প্রয়াস, কলকাতা, ২০২২, পৃ. ৭৬-৭৭
২১. বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত দাস (সম্পাদিত), ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা ও অন্যান্য সমাজচিত্র’, প্রথম সংস্করণ (নূতন), বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলিকাতা, ১৩৬৩ বঙ্গাব্দ , পৃ. ১১১
২২. ভট্টাচার্য, মহামহোপাধ্যায় স্মার্ত রঘুনন্দন, ‘স্মৃতিতত্ত্বভাষ্য’ (অখণ্ড), প্রথম সংস্করণ, সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক জীবানন্দ বিদ্যাসাগর কর্তৃক সম্পাদিত, অনূদিত ও প্রকাশিত, কলিকাতা, ১৮৯৫, পৃ. ৬৫৮-৬৬০
২৩. মিত্র, সুধীরকুমার, ‘দেব-দেবীর কথা ও কাহিনী’, প্রথম সংস্করণ, ডি. এম. লাইব্রেরি, কলিকাতা, ১৯৫৮, পৃ. ২৩০
২৪. দাশগুপ্ত, শশীভূষণ, ‘ভারতের শক্তিসাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’, দ্বিতীয় সংস্করণ, সাহিত্য সংসদ, কলিকাতা, ১৯৬০, পৃ. ৭৫
২৫. Chatterjee, Ajoy, Ram in Bengal, Publishing Date : 16-04-2019, Internet archive edition, Visiting Date : 06-08-2023, Time : 12.57 PM, weblink : https://web.archive.org/web/20210730090122/https://www.organiser.org/Encyc/2019/4/16/Ram-in-Bengal.html
২৬. চন্দ্র, মনোরঞ্জন, ‘মল্লভূম বিষ্ণুপুর’, প্রথম সংস্করণ, মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ২০০২, পৃ. ১০৩-১০৪
২৭. সাহা চৌধুরী, গৌতম, ‘দেবী রাজবল্লভী মাতার প্রতিষ্ঠা কাহিনী’, পঞ্চম সংস্করণ, সোনার তরী, রাজবলহাট, ১৪২২ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৯
২৮. বন্দ্যোপাধ্যায়, ব্রজেন্দ্রনাথ ও সজনীকান্ত দাস (সম্পাদিত), ‘হুতোম প্যাঁচার নক্শা ও অন্যান্য সমাজচিত্র’, পৃ. ১১১
২৯. শ্রীম-কথিত, ‘শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত’ (অখণ্ড), প্রথম সংস্করণ, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০০০, পৃ. ৮৬৬
৩০. ভূঞা, ড. কৃষ্ণচন্দ্র, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর কলিকাতারে ওড়িয়া’, প্রথম সংস্করণ, ইন্দিরা আকাদেমি, ভুবনেশ্বর, ২০১০, পৃ. ৩১০
৩১. ‘প্রার্থনা ও সঙ্গীত’, নবম সংস্করণ, বেলুড় মঠ, হাওড়া, ২০০২, পৃ. ৩৫
৩২. ভদ্র, জগবন্ধু (সংকলিত) ও মৃণালকান্তি ঘোষ ভক্তিভূষণ (সম্পাদিত), ‘শ্রীগৌরপদ-তরঙ্গিনী’, দ্বিতীয় সংস্করণ, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, কলিকাতা, ১৩৪১ বঙ্গাব্দ, পৃ. ৩
৩৩. তর্করত্ন, পঞ্চানন, ‘শ্রীমন্মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস বিরচিতম্ স্কন্দপুরাণম্’ (বিষ্ণুখণ্ড), দ্বিতীয় সংস্করণ, নবভারত পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০১৫, পৃ. ৮৪৯
৩৪. পাল, অভিজিৎ, ‘জগন্নাথের শৃঙ্গার : উৎকলের ইতিহাস-কিংবদন্তি-ঐতিহ্য’, প্রথম সংস্করণ, আত্মজা পাবলিশার্স, কলকাতা, ২০২২, পৃ. ১০০
৩৫. ভূঞা, ড. কৃষ্ণচন্দ্র, ‘ঊনবিংশ শতাব্দীর কলিকাতারে ওড়িয়া’, পৃ. ৩১০
দণ্ড মহোৎসব – অভিজিৎ পাল
বঙ্গের জগন্নাথ সংস্কৃতিতে দণ্ড মহোৎসব কোনো সাধারণ ঘটনা নয়। গঙ্গাতীরে পেনেটিতে নিত্যানন্দ প্রভুর মহাকৃপার মধ্যে দিয়ে শুরু হয়েছিল বৃহত্তর গৌড়মণ্ডলে চৈতন্য ভাবধারার প্রসার। এই ধারাতেই উৎকল থেকে আসা জগন্নাথ সংস্কৃতি অচিরে যুক্ত হয়েছিল। শ্রীমৎ মহাপ্রভু চৈতন্যদেব ও নিত্যানন্দের প্রত্যক্ষ পরিকরেরা বৃহত্তর বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে (মূলত গ্ৰামে) প্রবেশ করে গোটা বাঙালি জাতিকে চৈতন্যধর্মের আস্বাদন করিয়েছিলেন। চৈতন্য পরিকর দ্বাদশ গোপালের (মতভেদে পঞ্চদশ গোপালের) শ্রীপাট থেকে বাংলার জগন্নাথ ধর্মের জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল। এই পর্বেই মহাপ্রভুর পরিকর শ্রীল কমলাকর পিপলাই শ্রীপাট মাহেশে স্থিত হয়ে মাহেশের শতাব্দী প্রাচীন জগন্নাথের সেবা প্রভৃতির দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। ততদিনে বাঁকুড়ার তুঙ্গভূমে অবস্থিত বাংলার সবচেয়ে প্রাচীন জগন্নাথ মন্দিরটি তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর রাজনৈতিক অসভ্যতায় লুপ্ত হয়েছে। তুঙ্গভূমের মন্দিরের জগন্নাথ বিগ্ৰহ পর্যন্ত বারবার গুপ্ত হতে হতে পরিচিত বলয়ের গণ্ডি ছাড়িয়ে রক্ষিত বা বিসর্জিত হয়েছে। শ্রীপাট মাহেশের জগন্নাথ ওড়িয়া ও গৌড়ীয়া এই দুই রীতিকে বহন করতে করতে চৈতন্য মহাপ্রভুর পরিকরদের প্রভাবে ক্রমে গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারায় স্থিত হন। কিছু কিছু ওড়িয়া রীতি অবশ্য এখনও রয়েছে। এরই অন্যতম রীতি স্নানপূর্ণিমায় জগন্নাথের মন্দির থেকে বাইরে এসে প্রকাশ্যে মহাস্নান। বাংলার জগন্নাথরা দণ্ড মহোৎসবের পরেই স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে উত্তীর্ণ হন। চৈতন্য মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ প্রভুর প্রভাবে এবং বহু সংখ্যক বাঙালি মহাজন বৈষ্ণবের ঘন ঘন উৎকলবাসের সূত্রে শ্রীক্ষেত্র থেকে জগন্নাথ বিগ্রহ এই বঙ্গে আগমন করেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম শ্রীল জগদীশ পণ্ডিতের সেবিত জগন্নাথদেব। পরবর্তী পঞ্চাশ বছরের মধ্যে অধিকাংশ গৌড়ীয় শ্রীপাটে জগন্নাথ প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। গৌড়ীয় বৈষ্ণব আচার্যদের প্রভাবে সপ্তদশ শতাব্দীময় বহু উচ্চবিত্ত পরিবারের তত্ত্বাবধানে বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে জগন্নাথ বিগ্রহ তৈরি করা হয় বঙ্গীয় রীতিতে। বিশেষ করে নীল রঙের কৃষ্ণমুখ জগন্নাথ তৈরি হয় বৃহত্তর বঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে। এঁদেরই অন্যতম প্রতিনিধি হাণ্ডিয়ালের নীল জগন্নাথ। সপ্তদশ শতাব্দীতে জগন্নাথ সংস্কৃতির বিপুল প্রসার ঘটলে অষ্টাদশ শতাব্দীতে বাংলার নিজস্ব জগন্নাথ সাহিত্যেও জোয়ার আসে।
অভিজিৎ পাল | Avijit Pal
Is Three Mile Island Still Dangerous?
What is the mystery of Sentinel Island | Best Article
Why 15th August chosen as Independence Day? | Probodh Kumar Mridha
Vivekananda and Kabiguru | বিবেকানন্দ ও রবীন্দ্রনাথ | Best Article
English Literature | The Relationship between Literature and Society | Literature and Society | What is the relationship between literature and society? | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya – Journal | The Relationship of Literature and Society | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya pdf | relationship between literature and society pdf | relationship between literature and society essay | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya notes | literature and society notes | literature and society summary | society and literature subject | literature and society definition | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya – Video
Essay – Jagannath in pottery influenced by Chaitanya | Society Lover | Literature Lover | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya – images | Literature and Society: A Reflection | (PDF) Literature and Society | literature is the mirror of society | Bengali Essay – Jagannath in pottery influenced by Chaitanya | Short Article | Best Article | Bengali Article | Definite Article | Article Submission | Trending Article – Jagannath in pottery influenced by Chaitanya | New Subject Article | Article Collection | Article Writer | Creative Writer | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya in English | Jagannath in pottery influenced by Chaitanya