Stories of Md Shohidullah
Diary of Bangla Galpo | Read Online Collection of Stories
রোদে মেঘে আনাগোনা
বাঁশের বেড়ার ফুটো দিয়ে কতো কীইতো দেখা সম্ভব হয়। রাত দশটায় ঝগড়াঝাঁটি, সকাল দশটায় ঝগড়াঝাঁটি, বিকেল পাঁচটায় ঝগড়াঝাঁটি। এখন সতী-সাহাব পরিবারের কমন বিষয়। সতী আর সাহাব। কচি পাতার মতো নতুন সংসার। পালিয়ে আসা। মুরুব্বীরা চান তাঁদের কথামতোই অনুগত ছেলেমেয়েরা সংসারের আবেদন করবে।মুরুব্বিরা মনে করিয়ে দেবেন।পাত্র অনুসন্ধান হবে। দেখাদেখি হবে।ঘাটাঘাটি হবে।খুনসুটি হবে।যাচাই-বাছাই হবে।পছন্দ অপছন্দ তো আছেই। যদিও কতিপয় ক্ষেত্রে উল্টোটিও ঘটে। এরা আবার কয়েক কাঠি উপরে। ঝাঁপিয়ে প্রেমের রোগ হবে।চুটিয়ে সবার নাকের ডগায় প্রেম করে যাবে। তারপর লেখাপড়া, চাকরি, ব্যবসা, সব হিসেব কড়ায়গণ্ডায় আমলে নিয়ে সংসারে টুপ করে ঢুকে পড়বে।মুরুব্বিরা সেটা মানতে নারাজ। কেউ কেউ এটাকে সঠিক মনে করেন। তাই সতী-সাহাব জুটি পালিয়ে যাওয়ার চ্যালেঞ্জ নেয়, দেরী করে না। চল পলায়ে যাই— গানটা এদের কাছে ভালো লাগে স্কুল জীবন থেকেই।
বুলির বাবা তাদের বাড়িওয়ালা। বাসা ভাড়া এদের কাছে দেবেন না, একদম সাফসুতরো আলাপ। কিন্তু দূতিয়ালি করে নিশানের বৌ সাকসেসফুল। আজকেই বিয়ে হলো, জিনিসপত্র কেনা হলো, রাতেই হালকা ডিনার হবে। ফ্রেণ্ডসার্কেলের কয়েকজন, একদম নাছোড়বান্দা টাইপের যারা তাদের জন্য জাস্ট সিম্পল একটা ট্রীট। সমবয়েসি দূর সম্পর্কের মামা, আর দারোয়ান লোকমান ভাই। তাদের সকল জোড়াতালির বিরাট হোতা। কারোরই রান্নার প্রশিক্ষণ নেই। বিয়ের আগে অনেকে ছোটবেলায় মা-চাচীদের যৌথ প্রয়াসে ডুবে থেকে শিখে ফেলে। সতী আদুরে এবং বাবার একমাত্র মেয়ে। ছোটবেলাটা অভিজ্ঞতাহীন ছিলো। তাই এখন সংসার নামক বাসটি স্টপেজে এসেছে। তাই সদ্য মাস্টার্স করা সতী মায়ের কিচেনে এটা ওটা করার চেষ্টা করতে গিয়ে প্রশ্নের খপ্পরে পড়তে যাচ্ছিলো।
— আচ্ছা মা,ডাল রান্নায় পেঁয়াজের সাথে কি রসুন দিতে হয়?
— কেনরে রে?
— না,এমনি। জাস্ট জানতে চাইলাম।
তারপর লুকিয়ে পড়া সতী হঠাৎই বেরিয়ে গেলো। আরেকদিন সতীর জিজ্ঞাসা, মা দেড় মাসের বাচ্চার গায়ে কি লোশন মাখা যায়? এবার মায়ের চোখ রসূনের মতো সাদা এবং বড় হয়ে গেলো।
— তোর কী হয়েছে, বলতো!
আবারও নিজেকে লুকিয়ে ফেললো সতী। বিষয়টা মা গিয়ে বাবাকে বললেন, ওগো শুনছো—। বাবার এসব শোনার টাইম কম। ওদিকে সাহাবকেও প্রশ্নটা করে। সাহাব একটু অবাকই হলো, তোমার মুখে হঠাৎ করে এমন প্রশ্ন?
— না, আমরা আফটার অল সংসারটা শুরু করতে যাচ্ছি তো, তারই কতিপয় আগাম প্রস্তুতি।
— আচ্ছা, বুঝেছি। কিন্তু তাতে এতো আগাম প্রস্তুতির কী দেখলে?
— কেন নয়? এগুলো কী অবান্তর? অভিজ্ঞতা নিতে হবে না?
— অবশ্যই। কেউ কী তোমার মতো এরকম বিসিএস এর মতো স্টাডি করে সংসার শুরু করে? সংসার শুরু করে দেয়। তারপর ঠোক্কর খেয়ে খেয়ে আগায়। অভিজ্ঞতা পরে হয়।
তারপর যুক্তি, পাল্টা যুক্তির সংযোজন বিযোজন, প্লাস-মাইনাস। শেষে যখন দুপক্ষের মুরুব্বীরা আত্মীয়, অনাত্মীয়ের মধ্যে সার্কুলার দিয়ে ফেলেছেন, আর কড়া মার্কিংয়ে রাখতে শুরু করেছেন, শ্যেনচক্ষু হানা শুরু করেছেন, তখনই সতী, সাহাব জীবনের কঠিন ক্যালকুলাসটার ফাইনাল রেজাল্ট বের করে ফেলে।
নাহ,চ্যালেঞ্জ নিতেই হবে।
বাসা ভাড়া নেয়া হলো। সাহাবের এক আত্মীয় এ-বাসার দারোয়ান। তার সহযোগিতা একশতে একশ। শর্ত প্রযোজ্য, ভরপেট কাচ্চি, আর বিশ টাকা দামের পানের খিলি। সংসারের বিউগল বাজিয়ে দিলো বন্ধুরা। সাহাবের মা কোমল-প্রাণ। ছেলে এত বড় বেইমানী করবে মানতেই পারেন না। কিন্তু সন্ধ্যায় একদম রাখঢাক না করে ঘটনাটা বলে ফেলার পরে মা এভাবে স্ট্রোক করে ফেলবেন ভাবতেই পারেনি সাহাব। হাসপাতালে আইসিইউতে চার-পাঁচ দিনের জেল খেটে বেরুনোর পর শিয়রের দাঁড়ানো সতীকে দেখে জিগ্যেস করেন, মেয়েটা ভারি মিষ্টি। কে রে? মার সামনে গুটিয়ে যাচ্ছিল সাহাব। সতী পায়ে ধরে সালাম করার পরই মোটামুটি বুঝেই ফেললেন, বললেন, শোন্, তোরা লেখাপড়া করেছিস, নিজেদের জীবন নিজেরা গড়ে নে। ভালোমন্দ নিজেরা হিসেব করে নে। মাকে জড়িয়ে ধরে সতী, সাহাব। কিন্তু সতীর বাবা-মা, আমার বাবাকে কী করে ম্যানেজ করব—? ওটা ম্যানেজ করা যাবে।
ম্যানেজ করার আগেই তেজকুনি পাড়ার নীল কালারের বাসার চার তলায় একটি ইউনিটে ব্যাংকার সাহাব, হাইস্কুল টিচার সতীর জন্য টুনি বাল্বের হাজারো বাতি ঝলসে উঠলো। দুয়েক দিন গেলো বিয়ের নানান পর্ব। শরীরেও বিয়ের ঘ্রাণ, রঙ লেগে আছে।তারপর ব্যস্ত পৃথিবীর সবাই নিজ নিজ কাজে সরতে শুরু করে। আগের তুলনায় দ্রুতই গড়াচ্ছিল মনে হয় পৃথিবীটা। কিচেনে আরো কিছুদিন ডাল, আলুভর্তা, ডিম পোঁচ খেতে হবে। এর চাইতে বেশি কিছু অভিজ্ঞতা নেই। ভাগ্যিস পাঁচতলার দিনটা আন্টি পেঁয়াজ কাটার নিয়ম দেখিয়ে দিয়েছেন। মাছটাতে সাহস হয় না। তাছাড়া ওটার আঁশটে গন্ধে পেটের ভেতর থেকে সব ওয়াক আউট করার হুমকি দেয়। মাংসের সাথে মশল্লা, তেলের হিসেব-নিকেশটা দ্বিঘাত সমীকরণের মতো জটিলতর লাগে। চেষ্টা করতে গিয়ে হাফ লিটার তেলের বোতলটা চুলোর ওপর পড়ে গেলো, আর যত বিপত্তি। পোড়া হাত নিয়ে কিছুদিন সতী বিছানায় শুয়ে শুয়ে সাহাবকে বলে দেয়। আর সাহাব ভুলভাল মিশিয়ে রান্না করে। দুপুরের পরে ডাইনিং টেবিলের ওপরে অনভিজ্ঞ বালক-বালিকা সহজ সরল খাদ্য খায়, আর বলে ওফপপ্ ফাইন, ঝাক্কাস, অসাম, সেইইইই স্বাদ — এরকম ফেসবুকীয় শব্দের ভেতরে তৃপ্তি খুঁজতে থাকে। সাহাব এবার বিচলিত। কেন না, সতীর ভেতর থেকে তার বিবমিষার লক্ষ্মণটা প্রকাশ করে। মকবুলের গলির মোড়ে ডাক্তার আংকেল প্রেসার মাপেন। ইউরিন টেস্ট স্ট্রিপ কিনতে বলেন। স্ট্রিপের গায়ে দুটো লাল দাগ দেখে ডাক্তার আংকেল একটু মোলায়েম হাসি হাসলেন। সাহাব একটু ইতস্তত করে, আংকেল, কোনো প্রবলেম? প্রবলেম তো আছেই। আপনারা কেন আমার জন্য মিষ্টির অর্ডার করছেন না?
সত্যি সত্যি সাহাব ডাক্তার আংকেলকে দুই কেজি বালিশমিষ্টি দিয়ে আসে। তিন মাস পর সতীর অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। কেন না, স্কুলটা গ্রামে। কখনো ভ্যান, কখনো পায়ে হেঁটে যাওয়া। রাস্তায় পিচ ছিল। ছাল ওঠা অর্জুন গাছের মতো অবস্থা। দাউদের মতো ছোপ তার গতরে। ভাঙ্গা রাস্তা বলে অটো, সিএনজি চলে না। শহরের সাফসুতরা মানুষেরা আসে, জরিপ করে, মাপজোখ করে। তারপর চলে যায়। রাস্তার জায়গায় রাস্তা পড়ে থাকে। বরাদ্দ আসে।বরাদ্দ হাওয়া। আবারও প্রজেক্ট আসে।কিন্তু রাস্তায় আলকাতরা পড়ে না। পড়ে তিন নাম্বার ইটের খোয়া। বুলডোজার আসে।আপাতত রাস্তা সমতল চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে। আবার বর্ষার সাথে সাথে সুরকী উঠে যায়। এটাই যেন নিয়তির বিধান।
মিসক্যারেজ! সতীর জন্য বিশাল একটা ফর্দ ধরিয়ে দেন ডাক্তার। হিউম্যান ডিজিটাল ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে আল্ট্রা করাতে হবে। সঙ্গে লিপিড প্রোফাইল। রিপোর্ট অনুযায়ী ব্লাড ভরার পর বেড রেস্ট। বাসায় ফিরে অগ্রিম বানানো ছোট ছোট কাঁথা গুলো দেখে ভেতরটা পাড়ভাঙ্গা নদীর মতো তোলপাড় করে।
স্বর্ণলতা
হারাধনের আজ অপারেশন।ছেলেদের কেউ বেঁচে নেই। নানান সমস্যায় ওরা পৃথিবী ছেড়েছ। একটাই মেয়ে, নবীনা। হারাধনের অবলম্বন। ভার্সিটি লাইফ শেষ।এখানে ওখানে টুকটাক ইন্টারভিউ চলছে।বেশ কবার বিভিন্ন ক্যাটাগরি পাত্রপক্ষ দেখে গেছে। বাড়িতে গিয়ে পাত্ররা ডিটেইলস জানাবে। জানায়নি। এখন সব কিছু ললাটের লিখন বলে মেনে নিতে হচ্ছে। হারাধনের হাঁড়ির খবর সবাই জানে। তাই পাত্ররা দলবল নিয়ে আসে।ভুঁড়ি ভোজন করে। তারপর পানের থালায় হাজার টাকা সালামী রেখে সেই যে যায়। মাস্টার্স, সুন্দরী, পাঁচ ফুট চার উচ্চতা, স্বাস্থ্য ভালো হওয়া স্বত্বেও পাত্রদের অরুচি। ডিমান্ড নিয়েই ঘাপলা। বাবাকে ডাক্তার দেখানো, পরীক্ষা করানো, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ভাড়া করা — সব কাজ নবীনাকে একাই সামলাতে হচ্ছে। স্ত্রী নিজেও চিররোগী। কবিরাজ, তাবিজ, তুম্বা, আরক, শরবতের ওপর তার আস্থা। হারাধনের চেষ্টার ত্রুটি ছিলো না। এপথে তার অনেক টাকার শ্রাদ্ধ হয়েছে। আজকে নিরুপায়।
ডাক্তার সিগনাল দিলেন, ভেতরে লিভার ফেইলিউর হতে দেরি নাই। ইনফেকটেড হতে চলেছে। সকালেই খালিপেট থাকতে হবে। ন’টার পরে থেকে মুখে খাবার খেতে বারণ করে গেছে নার্স। এগারোটার দিকে বয় এসে বললো, আপনারা বাইরে যান। রোগীর শেইভ হবে। হারাধন টয়লেটে ঢুকে গেঞ্জি খুলে দিলো। বয় একটা বলপেনে সুপার ম্যাক্স ব্লেড কীভাবে যেন আটকে দিয়ে রেজারের কাজটা সুন্দর করে ফিনিশিং দিলো। তারপর বললো, নেন দাদা, আপনার কাজ শেষ। এইবার একশ টাকা লন।
— একশ টাকা! আরে মিয়া, এটুক কাজে একশ টাকা। এটা তো আমিই পারতাম।
— দ্যাহেন, কাজ করছি। ট্যাকা লন। আরে এইসব তো —– ল ফালানির টাকা।
— কী আর করা, এসেই যখন পড়া, খেলামই যখন ধরা — একশ টাকা তো আজকাল পানি-ভাত।
অবশ্য হারাধনের বেলা এটি প্রযোজ্য। অনেকের কাছে এ-ই টাকা, টাকাই না।
দেয়ালে টানানো ইস্তিরি বিহীন পাঞ্জাবির পকেট হাতড়াচ্ছে হারাধন। বয় কিছুক্ষণ আগেইতো ঢুকলো। সে একশ টাকা নিয়ে গেল। মাথার ওপর ফ্যানের দুটো ব্লেড ঘুরছে। সভ্যতার চরম বাস্তবতা, একটা ব্লেড কেউ যত্ন করে নিজের বাড়িতে নিয়ে গেছে হয়তো। একটা ব্লেড দিয়ে কী এমন লাভ? যার যা বুঝ। কিন্তু কর্তৃপক্ষ এ-ই সমস্যা ঝুলিয়ে নিয়েই কাজ চালাচ্ছে। মোটা দাগে রোগী জবাই করে টাকা নিচ্ছে। আবার শেভ করানোর টাকাও আলাদা নিচ্ছে।
স্যালাইন পুশ করার জন্য কয়েকজন দেবতার চেহারা নিয়ে আবির্ভূত হলেন। ওনারা টিসটুস, কসমস, শব্দ করে একের পরে এক ইনজেকশন পুশ করছেন। স্যালাইন সেট রেডি করলেন। রোগীর ফাইলে খচাখচ লিখে রাখা ডাক্তারি বিধি নিষেধ অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করে চললেন। এরই মধ্যে কয়েকজন আয়া ঝগড়াঝাঁটি করতে করতে এ-ই রুমে এসেছে। বেডের নীচে ডিশ,ফ্লোরের যাবতীয় ময়লা সরাচ্ছে, নাক ছিটকাচ্ছে।কাজ শেষে ‘মামা’ সম্বোধন করে বকশিস চাইছে। এদেরকেও হাসিমুখ টিকিয়ে রেখেই বকশিস প্রথা চালু আছে। এ-ই কাজের জন্য বেতন, বোনাস পেলেও রোগীর জীবন-মরণ সন্ধিক্ষণে এদের কঠোর অবস্থান এখন সর্বজনগৃহীত। স্বাভাবিক নিয়ম।আসলে অনিয়মের চর্চা করতে করতে অনিয়মই এক সময় নিয়ম বলে জয়যুক্ত হয়। আরো তিনজন মহিলাকে এনাসথেশিয়া বিশেষজ্ঞ এসে ক্লোরোফরম দিয়ে গেছে। আগের একজন মহিলা রোগীদের একজন চলে গেছে নাচতে নাচতে। কারণ তার হাই-প্রেসার। ডাক্তার বললেন, নাচতে নাচতে চলে গেলে লাভ নেই। খুব শীঘ্র আবারও আসবেন। গলব্লাডারে পাথরকে জিইয়ে রেখে নিজেরই ক্ষতি। ওটা চুপচাপ আপনার ভেতরে বড় হবে। আরো বড় ক্ষতির কারণ হবে। টু-ডে অর টুমরো, ওটাকে টেনে হিঁচড়ে বের করতেই হবে।
সন্ধ্যার পর হারাধনের অপারেশন হবে। পাশে দাঁড়ানো তার মেয়েটা। চিররোগী বৌটা আসার চেষ্টা করেছিল। মেয়ে মানা করেছে। কারণ হার্ট উইক মা, যিনি মাছ, মুরগী খান না মোটেই। ওগুলো কাটার পর রক্ত দেখে শিউরে ওঠেন। কাজেই হাসপাতালে নতুনভাবে কোনো সমস্যা তৈরি হোক এটার সুযোগই দেয়া যাবে না। ও.টিতে ঢুকিয়ে দেয়া হোলো হারাধনের নটনড়নচড়ন শরীর। বাইরে মেয়েটা চুপচাপ।মনটা খারাপ।এ-ই সক্ষম বাবাটা যে পরিমাণে সাপোর্ট দিয়ে গেছে, তার হিসেব করা যাবেনা।স্কুলের মাস্টারি, টিউশনি, সামাজিকতা সবকিছুই এতদিন বাবাকে ষাট বছরেও যুবক বানিয়ে রেখেছিল। এখন অপারেশন পরবর্তী ঝক্কিও কম না। কতসব উটকো ঝামেলা এসে ভীড় করবে। ভেতরেই একটা ঔষধের দোকান। ওটার পাশে কিছু চেয়ার। ওখানে বসে ব্যাগের ভেতর থেকে জলটা বের করে। এক প্যাকেট লেক্সাস চিবিয়ে জল ঢালে মুখে। পাশের একজন মহিলাকে দেখা গেলো বকবকানিতে — সে নাকি এণ্ডোসকপি করতে ভয় পায় না। একটু গর্বান্ধ হয়ে টানটান উত্তেজনা নিয়ে এণ্ডোসকপি করতে ঢুকেছে। আর বের হবার সময় সে কী — বীভৎস রকমের অবস্থা! — চোখ দুটো যেন ট্যারা হয়ে গেছে। মুখ দিয়ে লালা বের হচ্ছে। তা গড়িয়ে পড়ছে চিবুক বরাবর। আরো কয়েক ঢোগ জল খেতেই বাইরে কোথাও একটা সম্মিলিত চিৎকার। সমবেত আর্তনাদ বলা যায়।সেই সাথে ফায়ার সার্ভিস, এম্বুলেন্সের যৌথ সাইরেন, আর মানুষের আতঙ্কিত দৌড় শুরু হলো। এক নিমিষেই জনারণ্য। নবীনা সব কিছু রেখে এক দৌড়ে চিৎকারগুলোকে টার্গেট করে। অস্থিতিশীল নিজের মনটাকে বেঁধে রাখতে পারে না। মুহূর্তেই মানুষের চিৎকার, আগুনের দাপাদাপি, যুদ্ধের সাইরেনের মতো বেল বাজিয়ে আসছে এম্বুলেন্স। এই–এই– সরো– দেখি একটু সাইড। ইমার্জেন্সিতে দৌড়ুচ্ছে সবাই। বার্ণ ইউনিটের বেড,কেবিন, বারান্দায় সংকুলান হচ্ছে না।অন্য আরেক হাসপাতালের সন্ধানে বেরিয়ে যাচ্ছে এম্বুলেন্স। ভয়াবহ পোড়া গন্ধ, বীভৎস রকমের অবস্থা, নির্মমতার স্বাক্ষরিত এক একটা পাঠ যেন হাজির হচ্ছে। অপেক্ষাকৃত দুর্বল হার্টের লোকজন চোখ ঢেকে ঘটনাস্থল এড়িয়ে চলছে। রক্তের ডোনারদের ভীড়, স্বেচ্ছাসেবকদের ভীড়, সামরিক, বেসামরিক বাহিনীর ভীড়। কেবল ভীড় নয়, মানবজট। এটা নিয়ন্ত্রণে ট্রাফিক ব্যর্থ।
সে-মুহূর্তে চারপাশের বিভেদের দেয়াল আজকে ভেঙে গেছে। সরে গেছে জাত, পাত, রঙ কিংবা ব্যক্তিগত বিষয়গুলো। এক একটা দুর্ঘটনায় মানুষের মধ্যে ঐক্য সৃষ্টি করে। মানবিকতার আবেদন দ্রুতই বাড়ে।উদারনৈতিক মনোভাব বাড়ে। অবশ্য কৌতূহলী জনতা, উৎসুক জনতা বলে একটা কথা থেকেই যায় — এরা নিরাপদ দূরত্বে থেকে তামাশা দেখে, ঘটনাস্থলে আগুন না নিভিয়ে তাকে ঘিরে ভিডিও তৈরি করে। সেলফি তুলতে ব্যস্ত। কেউ কেউ হরিলুটের জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। আগুনের লেলিহান শিখার সামনে আর্ত নরনারীর কান্নার অসহায় দৃশ্য আগুনকে নির্বাপিত করেনা।সহস্র মানবের কান্নার রোনাজারি,পোড়া ধোঁয়া আকাশ পর্যন্ত পৌঁছালেও আগুন তার পোড়াবার লেলিহান লালসা থেকে নিবৃত হয় না। জায়গাটা জমজমাট ছিল। কয়েকটা কেমিক্যালস এবং ঔষধের কারখানাও ছিল।আগুনের আজকে তীব্র ক্ষুধা। বস্তি, মানুষ, দোকান, মালামাল পুড়িয়ে আগুন আজ তৃপ্ত। লাগার কারণ যাই হোক আজকের উত্তপ্ততর শিখার সামনে বিশ-পঁচিশ ইউনিট ফায়ার সার্ভিসের সামর্থ্য বড্ড অসহায়। চেষ্টা করা মানুষগুলো কেবলই সাহায্য চেয়ে চিৎকার করছিল। ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা অসুস্থ হয়ে পড়ছিলো। নবীনা এদিক ওদিক বিকল্পের সব দরোজা বন্ধ দেখেও হতাশ ছিলো না। নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী নেমে পড়লো। হতাশ জনতার কতটা জনবান্ধব, সেটাই নিরপেক্ষভাবে বলা সম্ভব নয়। কারণ এদের ভীড় ঠেলে এম্বুলেন্সগুলো আগুনের মূল জায়গার কাছে যেতে পারছে না। পানির কোনো উৎস মিলছে না।
একটু আহতদের উঠে বসতে, বসা রোগীকে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে শোয়ানো, ঔষধ গুলো এনে দেয়ার কাজগুলো করতে পেরেছে। স্কুল লাইফে এরকম কাজ স্কাউটিংএ করেছে অনেক। হঠাৎ মনে হলো, বাবাকে অপারেশন থিয়েটারে রেখে এসেছে। মাথাটাকে সে-মুহূর্তে সামাল দেয়া যাচ্ছে না। অবসন্নতা ঘিরে ধরেছে। বাবার অসহায় মুখটা চোখের সামনে ভালো। পুনরায় ফিরে চললো ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। ওকে দেখে কেউ কেউ কটু মন্তব্য করছিল —
— তামাশা দেখতে গেছিলো আরকি। নিজের বাপকে কেউ ও.টিতে রেখে ভাগে?…. আরো অনেক তেঁতো কথা।
আয়া জানালো — দিদি আপনের রোগী কেবিনে বেডে নিয়া গেছে অনেকক্ষণ হৈলো। দৌড়ে কেবিনে ঢুকলো নবীনা। বাবা চুপচাপ চোখ বুজে শুয়ে। অপরাধীর মতো নবীনা বাবার পাশে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করলো, স্যালাইন চলছে। ওনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই বাবা চোখ বুজেই জিগ্যেস করলেন — কীভাবে আগুন লাগলো? অনেক মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হলো, তাই না?
— হ্যাঁ, বাবা। কিন্তু তোমাকে এ-ই সংবাদ কে দিলো বাবা?
— এই তো ডাক্তার, নার্স ওনারা। অবশ্য মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লাম। চোখ মেলে দেখলাম আমি বেডে।
আবেগে নবীনার চোখ ভিজে যাচ্ছে — বাবা!তোমাকে এ-ই কঠিন অবস্থায় রেখে আমার চলে যাওয়াটা ঠিক হয়নি। আমি ক্ষমা চাইছি বাবা !আর কক্ষনো এমন ভুল হবে না।
আরে, ধূরর্। তুই তো মানবিকতার খাতিরে সবাইকে সাহায্য করতে গিয়েছিলি। এমনটি সবাই পারে? সার্জন সাহেব তোর অনেক প্রশংসা করলেন। আর তোর অনুপস্থিতিতে সবাই আমাকে বেশ সহযোগিতা করলো। এনাসথেশিয়ার আগে সার্জনের সাথে অনেক কথা হলো। তিনি তার অপারেশন চার্জ নেবেন না বললেন। আরো বললেন, এমন মেয়ের বাবা হিসেবে আমারও জীবন সার্থক। উনার ছেলের বৌ হিসেবে তোকে সিলেক্ট করেছেন। আমি হ্যাঁ, না কিছু বলিনি। তোর মতামত কী?
— বাবা! তুমি ঘুমাও তো। বেশি কথা বলা ঠিক হবে না।
অন্যান্য রাতগুলোর মতোই আজকের রাত প্রকৃতির নিয়মে জারি হলো। জানালা গলিয়ে ঝিঁঝিঁর শব্দ আসছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর নেতিয়ে পড়ছিল। সারাদিন আগুনপোড়া মানুষের জন্য একটু শ্রম, রাতে বাবার সাকসেসফুল অপারেশনের পর বেডে আসার খবরটি, আর সার্জনের মুখে নবীনার শুভ পরিণয়ের আগ্রহের খবরটা ক্লান্তিকর রাতকে ফুরফুরে মেজাজে পরিণত করছে। মোবাইলে ইউটিউবে সার্চ দিচ্ছে। কোন গানটা শুনবে?—- ধূররও, মাথাটা সারাদিনে একদম গেছে।
যাবতীয় জমাট মেঘ
১
আবেদালী পিয়নের দু-চোখকে পাশ কাটাতে পারলো না অর্জন। ওর আজকাল ম্যুড টলে যায় একটুতেই। ওপরের চাপ। ফাইল-পত্তর সচল থাকে।আগে পৌরসভার ডাস্টবিনের মতো অবস্থা হতো। আবেদালী এখন অর্জনের কাছের মানুষ। সূর্যটা গড়িয়ে গড়িয়ে মাথার ওপরে উঠে আসাতে পেটের ভেতরে অবরোধ, হরতালের আবহ সারা গায়ে টের পাচ্ছিল সবাই। যে যেদিকে পারে ছোটে। আবেদালীর ব্যাগে রেশন, ও, এম, ওস এর অবদান — পেঁয়াজ, তেল, ডাল, চিনিতে সংসার। টিফিনবাক্সে ডাল, আলুভাজি কিংবা ভর্তা, কমন। বাইরের খাবার কম খেলেই ভালো। বাইরের ভাজি ভর্তা স্বাস্থ্য-বান্ধব নয়। প্রেসার, কোলেস্টেরল, ডায়াবেটিসের বাড়াবাড়ি, আরও ডাক্তারের চশমা। ওপর দিয়ে তাকানোর নিখুঁত ভঙ্গিমা ডাক্তারের। এটা খাবেন না। ওভাবে হাঁটবেন। একদিন অসুস্থতা, একদিন ছুটি, আরও এটা কাটা, সেটা কাটা। দায়িত্বে অবহেলার শত শত অভিযোগ।
মোটা, পেটিদের বেলা রাখঢাক কম। ফাস্টফুড, রসমালাই, ফুচকা, চটপটি, কাবাবের চেহারা মনে হলো মানেই ওগুলোতে হামলে পড়া।বিয়ে,আকিকা, জন্মদিনের বারবিকিউ, ডিশ রসনায় তৃপ্তির ঢেকুর তুলছে।ঘন ঘন হাসপাতাল, প্রেসক্রিপশন, ডায়েট, টেস্ট-ফেস্ট — নিত্যকার বিষয়গুলো বিব্রতকর। আর এসব জায়গা যেন আগে থেকেই সব জানে।
আবেদালীর হাতে একশো টাকার নোট দিয়ে অর্জন বলল, তোমার বাচ্চা মুগডাল ভাজা পছন্দ করে। কিনে দিও।
— কিন্তু স্যার আজ সকালেও একশো টাকা দিছেন।
— তাই নাকি?
স্যারের এরকম অবস্থা প্রায়ই হচ্ছে, এটা আবেদালীর চোখে পড়ে। ক্যালেণ্ডারেও আজ বুধবার। অথচ আজ কি তাহলে বৃহস্পতিবার ভেবে বসে আছেন?
বৃহস্পতিবার বাড়ি যাবার তাড়া থাকে সবারই। শুক্র, শনির গ্যাপিং-এ কত রকমের রিল্যাক্স — ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া, রিইউনিয়ন, কালচারাল্ কর্মসূচি। বাসজার্নির চাইতে ট্রেনটা চয়েস। ঝাঁকুনি নেই। আয়েসের ঘুম ঘুমিয়ে নেয়া যায়। বাথরুম প্রব্লেম নেই। মুশকিল হলো, ট্রেনের টাইমটেবিল মাঝেমধ্যে ঝামেলা পাকায়। কখনো সময় মেইনটেইন হয় না। কোনো সময় সেই যে স্টেশনে দাঁড়াবে, আছে তো আছেই। ছাড়ার নাম নেই। এগারোটা, বারোটা, একটা, জোহরের আজান। রেললাইনের রেখা ধরে দূরে বহুদূরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখ ব্যথা করে যাত্রীদের। যেন লম্বা ইনিংসের ক্রিকেট টুর্নামেন্ট।এদিককার ট্রেন থামিয়ে পর পর দুটো ট্রেন ক্রসিং হলো। মানুষের জীবনে সময়ের কি কোনো মূল্যই নেই!
স্যার সিএনজিতে যাবেন — এটা শুনে আবেদালী একটু ইতস্তত করে। এগুলো আজকাল আজরাইল। চালকের ড্রাইভিং কাগজপত্র নেই, মাদকাসক্ত, চলতি পথে মোবাইলে কানে কাঁধ চেপে যখন খুশি কথা বলছে, অতিরিক্ত গতি, রাখঢাক নেই। যখন খুশি স্পিড বাড়ায়, সাইড ক্রস করে, ওভারটেক করে, টার্ন নেয়। যাত্রী যদি মহিলা হয় তাতে তার “পাঠ মারা” একটু বেড়ে যায়। কিন্তু সিএনজি কী দোষ করলো, এক্সিডেন্ট তো বাকিগুলাও করে।
স্যার, এইটা একটু পাগলা ঘোড়ার মতন। এ-ই বিষয়টি অর্জনের মাথায় স্যালাইন বানানোর মতো ঘুঁটা দিয়ে গেলো। আজকের বুধবারে স্যার বাড়ি যাবার জন্য কেন সিএনজি ডেকে দিতে বলবেন? স্যার তো সবসময় বিকেলের ট্রেনের কথা বলেন। তারপরও ওনার সাথে সম্পর্কটা এমন জায়গায় আছে, এরকম প্রশ্ন করার পরিস্থিতি অনুকূল ছিলো। স্যার, আজকে কি সিএনজিতে যাবেন? — বাড়ি যাবেন? নাকি অন্য কোথাও —-।
ফিরতি জবাবটাও দিয়েও আবেদালীর ওপর অফিসার থেকে চেয়ার-টেবিল পর্যন্ত সবার আন্তরিক শুভেচ্ছা পেতে থাকে। এ-ই দিনে অর্জন স্যার আবেদালীকে দিয়ে কোকোলা ন্যুডলস, বলগাম, টুথপেস্ট, ডিমের বাস্কেট, বেডশিট, কনডেন্স মিল্ক, বেডশিট কিনিয়ে নেয়। ওগুলো স্যারের ব্যাগে ভরার সময় হঠাৎ এতসব জিনিসের ভেতর থেকে একটা প্যাকেট পড়ে যায় আবেদালীর পকেট থেকে। আবেদালী গালভরা হাসি— হাসিতে জবাবদিহিতা–
— স্যার, এইগুলা আপনের বৌমার ব্লাউজের হুক।
স্যার এবার চাপা ক্ষোভ সম্বরণ করে নিজ পকেটে আবারো হাত দিয়ে একটা কিছু বের করেন। এবারও টাকা। তিনশো।
— ধরো, বৌটার জন্য ব্লাউজ কিনে নিও। মিয়া, বৌ মানুষের খোঁজ খবর নিও। নাম্বার জানো তো?
আবেদালী কৌশলে নিজেকে গোপন করতে চায়। ব্যাগের ভেতর থেকে এবার বেরুলো কঁচি শুকনো বেলের টুকরো।
— কার ডিসেন্ট্রি আবার?
স্যারের এ-ই প্রশ্নটাও এড়িয়ে চলার চেষ্টা চলে কিছুক্ষণ। আবেদালী বললো, স্যার বাড়িতে আমার প্রতিবেশী নিপুন ভাই। গ্যাসের সমস্যা। বেলগুলো পানিতে সিদ্ধ করে খায়।মফস্বলের বাজারেএগুলা নাই।
— এনেছো যখন কয়েকটা টুকরা রেখে দাও আমার জন্য।
স্যার কিছু চাইলে আবেদালীর ভালো লাগে। সে অনেকগুলো টুকরো স্যারের হাতে দিয়ে নিজে বেরিয়ে এসেছে।
২
মৌরীদের বাড়িতে আজ-কাল গানের আসর বসে না। বসাতে দেয়না কেউ হয়তো। হারমোনিয়াম, তবলার জোড়া নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। এবার ফাটতে শুরু করেছে। হারমোনিয়ামোর রিডগুলো বেসুরো হতে শুরু করেছে। ভেতরে ঘুণ পোকা বংশের নবায়ন চলছে। অথচ মৌরীদের বাড়ি মানেই গানের প্র্যাকটিস, বাদ্যযন্ত্রের টুংটাং একটা সময়ের পারফেক্ট ছবি। এ বাড়ির সুবোধ মেধাবী ছেলেটা থাইল্যান্ড গেলো। টাকা দিয়ে বাড়ি সাজালো। আর মাধব,মোহন্তরা ব্যাংকার হলো।কেউ কলেজে শিক্ষক। ওসব বাদ্য-টাদ্য দিয়ে কী হবে?
ব্যস। হারমোনিয়াম, তবলা, গিটার, পিয়ানো, পেটড্রাম, সব এখন আড়াঙ্গীতে ঘুমাচ্ছে অঘোরে। ওগুলো এখন স্যাম্পল মাত্র।
এবাড়ির প্রাণবন্ত সঙ্গীতশিল্পী তমালিকার সিজারিয়ান বেবি। বড় হয়ে এখন কলেজে। কমার্সে পড়ে। সাইন্স পড়ে পড়ে বুড়ো হলে লাভ নেই। কবে যে বিসিএস ক্যাডার হবে, তার নাই ঠিক। কপালে না থাকলে টিউটরী নিয়ে সারাজীবন। তারচে বরং বিবিএ, এমবিএ পড়ে ব্যাংকে কপাল লাগাও। লেখাপড়া মোটামুটি পারলে আর্মিতে। আর্মিতে ভালো পর্যায়ে ভালো সবই। মান-মর্যাদা, স্টেটাস। জনগণও রাস্তায় হিসেব করে কথা বলে। মনে হচ্ছে সকলেই এইরকম একটা ধারণার আবর্তে ঘুরপাক খাচ্ছে। মৌরীও তাই চাকরিতে। কিন্তু সঙ্গীতের সুর তাকে মোহাবিষ্ট রাখে। আটকে থাকে হারমোনিয়াম, তবলার সুর, তালে। মনটা দোয়েল পাখির মতো নাচে, মাছরাঙার মতো শীতল জলে ঝাঁপিয়ে পড়ে বেলায় অবেলায়। একটু গানের টিউশনিও করে অফিস থেকে ফেরার পথে।
শিষ্যটির মা নেই। বাবা আছেন। বিকেলের হলুদ মুছে আকাশে কমলা ছাপিয়ে কালি পড়ে। সন্ধ্যা পেরিয়ে যায়।গান তো ত্রিশ মিনিট।রাত আটটায় বাবা ফিরে আসা অব্দি গল্প আর গল্প। মৌরীর মুখে গল্প শুনে শুনে ছেলেটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে। শুধুই আবদার, ম্যাম গল্প বলেন, ম্যাম আর পড়বো না। গল্প একটা—–।
আটটায় শিষ্যটির বাবা বাড়ির গেইটে নক করে। মৌরী দরজা খুলে দেয়। ওনার হাতে ছেলেটাকে বুঝিয়ে দিয়ে ছুটি। বাসায় ফিরতে না ফিরতে শাশুড়ির ডাক।একটু আগেই শাশুড়ি আর ছেলেতে ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেছে। মৌরী চাকরি করে, আবার টিউশনি কেন। তাও আবার গানের। ওসব গান-ফানের কোনো ভবিষ্যৎ আছে? সারাদিন অফিসে পড়ে থাকে, কোথায় বাড়ি ফিরে স্বামী, শাশুড়ির খেদমত করবে, তা–না। আবার গানে মজে গেছে! ‘মজে যাওয়া’ শব্দের কারণে ঝগড়ার পালে বাতাস লাগে। শেষ হলো বৃষ্টি দিয়ে। রুমে ঢুকে মৌরী দরজা বন্ধ করে।
বাসায় অর্জন ঢোকার পরে আরও এক দফা ধূলিঝড়। আর ঝড়ো সংলাপের পাঁয়তারা। পরদিন যথারীতি যে যার মতো বাথরুম, শাওয়ার, ডাইনিং। তারপর বাস। সিএনজি। ট্রেন। নানান চিন্তালব্ধ জাল একটা গেরোতে ছিলো। তারপর আবার ছিটকে পড়া। ঠিক একোয়ারিয়ামের ভয় পাওয়া মাছের মতো। তবে আজকে অর্জনের একটু পূর্বাভাস — টিউশনিতে সময় কমিয়ে দাও। চাকরিই তো এনাফ। তুমিও করছো আমিও করছি। কোনো অর্থনৈতিক সংকট তো নেই। কিছুই বললো না মৌরী। শিষ্যের টানা টানা চোখ, শিশুসুলভ কথাবার্তা, ওর অমায়িক বাবার গোছানো আলাপ বেশ।কেবল শুনতেই ইচ্ছে করে।
৩
অর্জনকে ডেকে পাঠালেন বস। আবেদালী খবরটা দিয়ে গেলো। ডেকে পাঠানোর কারণটা আবেদালী বলতে পারেনি। ওনার রুমে গিয়ে একটু হোঁচটই খেলো সে।
— মৌরী এখানে!
— অবাক হবার কিছু নেই।
— এর আগেও তোমার অফিসে আমি এসেছি কয়েকবার।
— তাতো বটেই।
— কিন্তু আজকে মনে হলো ভূত দেখেছো —? কোনো প্রবলেম?
আমি বলছি–। বস কথাটা কেড়ে নিলেন — উনি মৌরী। শুনেছি ভালো গান করেন। বেশ ভালো ওস্তাদ।আমার বন্ধু তালাত বলেছে। ওনার ছেলেটিকে ওনি শেখান। বাসায় আমার ছেলেটাকেও গান শেখাবে। আবেদালীই আলাপ করিয়ে দিলো। একজন ভালো ওস্তাদকে পেয়ে আমার ছেলেও বেশ খুশি।
আবেদালী দূর থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে। সব কিছু বুঝি ফাঁস। এবার রক্ষা নেই।
— না না। আমি পুষিয়ে দেব।
অর্জনের এ-ই মুহূর্তে এমন জটিলতার সামনে সে নিজে থ-মেরে আছে। গানের টিউশনি এমনকি গানটাও বাদ দিতে হবে, এমনই সিদ্ধান্ত ছিলো সংসারে।
— এমুহূর্তে এটি একটি জটিল ত্রিমুখী মনস্তাত্ত্বিক সমস্যা।
ঠিক আছে আপনি কোনো চিন্তা করবেন না।– বসের কথাটা আরেকটু বিরক্তিকর লাগলো। আপাতত মৌরীর গান বিষয়ক আলোচনার সমাপ্তি টেনে বস বেরিয়ে গেছেন। অর্জন নিজের ভেতরে একটু একটু করে গুমোট আবহাওয়া টের পায়।
বাসায় জলদী এসো, কথা আছে। — মৌরীকে ফোনে এমনটাই বললো অর্জন।
বিকেলে চায়ের টেবিলটা যতটা প্রাণবন্ত লাগছিলো, তারচে বেশি মনের করিডোরে ঘোলাটে নহরে প্লাবিত ছিল। বাতাসের ঝাপটায় বার বার মশালটা নিভে যায়। একদিকে বাসায় গান না করা সংক্রান্ত কম্পাস কাঁটার হিসাব। আরেকদিকে অর্জনে বসের বাসায় ছেলেটাকে গান শেখানো।
রাত হয়ে যায় বাসায় ফিরতে ফিরতে। শ্বশুরের রুটি, ভাজি, শাশুড়ির গরম পানি, বিছানার চাদর, বাথরুমের পরিচর্যা –কাজের শেষ নেই। আটটার মধ্যে ইনস্যুলিন নিয়ে খাওয়াতে হবে। তার আগে ব্লাডসুগার মাপা। যেন সেনাবাহিনীর ট্রেনিং। একটা সময় সব থিতিয়ে যায়। সব রুটিন এলোমেলো হয়ে যায়। কেউ কারো জন্য সময় করতে পারছে না। দুই বৃদ্ধ যুগলের আহাজারি অর্জনের জন্য দুঃসময় দুঃসময় লাগে। ওপর থেকে টিম আসে। অর্জন বদলী হয়ে যায়। সিলেট। মৌরী, ওর বাচ্চা, শ্বশুর, শাশুড়ি নিয়ে থেকে যায়। আবেদালী তাকে নানান দিকে হেল্প করে। বাসার বাজার টাজারও করে দেয়।
ওদিকে বসের ছেলেটাকে নিয়ে মৌরীর জেলাসদরে নিয়ে যেতে হয়। বাড়তি প্রশিক্ষণ, কম্পিটিশন, মাতৃহীন বালকটির জন্য সময় বের করা। স্কুলে নিয়ে যাওয়া। মৌরীদের বাসায় রুমের চেয়ার, টেবিলের গেট আপ বদলে গেছে। সুন্দর একটা টিপটপ রুম হয়েছে। ফার্নিচারগুলোর ডিজাইন নিয়ে অর্জন সিলেট থেকে প্রশংসা করে। গানের বাড়তি টিউশনি’র জন্য শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য কাজের বুয়া রেখে দেয়। ওনাদের আগের যেসব সমস্যা হতো, সব কিছুতেই পরিবর্তন এসেছে। ওনাদের বাড়তি আর অভিযোগ নেই। বসের ছেলেটা জেলা থেকে বিভাগে গিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়ে এসেছে। খবরটা অর্জনকে ব্যাপক আগ্রহ জোগালো। বস মৌরীকে লংড্রাইভ, শহরের বড় বড় হোটেল, ভিজিটিং এরিয়াতে সময় কাটানো, শপিংয়ের প্রপোজাল দেন।
মৌরী অর্জনকে ফোন দেয়। শ্বশুর শাশুড়ির কথা ভাবে। ওনারা দুজনেই বলেন, যাও, এটা তোমার নিজস্ব ব্যাপার। অর্জন বললো, যাও। একটু পরিশ্রমের পাশাপাশি রিক্রিয়েশন দরকার আছে।
— কিন্তু, আমার আসলে ওনার সাথে কক্সবাজার যাওয়াটা কি ঠিক হবে?
— কেন নয়?
মৌরী মনে মনে অনেক কিছুই ভাবে। শেষবারের মতো ফোন করে — আমাকে কি বসের সাথে যেতে বলছো?
— হ্যাঁ। বলছি।
— ঠিক বলছোতো?
— হ্যাঁ।
৪
কক্সবাজার।সী-বীচ। বার্মিজ মার্কেট। মোটেল আর সমুদ্র। বসের ছেলেটাকে নিয়ে ভেজা বালুতে আঁকিবুঁকি, কোমরপানিতে নেমে ফটোসেশান, শৈবাল-শামুক-কড়ি-তারামাছের সাথে তিন-চারটা দিন। বস পানিতে নামেন না। ঠাণ্ডা লাগার প্রবণতা। দূরে বসে ছেলেটার আনন্দের গভীরতার সাথে সমুদ্রের মিল খুঁজে পান। আজকের যৌথ আনন্দের সাথে তার মনে পড়ে ছেলেটার মা, দিয়াকে। আজ থেকে ছ’সাত বছর আগে রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে। সেদিন জন্মদিন ছিল ছেলের। এমনি করে দিয়া’ও এসেছিল সমুদ্রের পাড়ে। ফেরার পথে দিয়াকে থেঁতলে দিয়েছে ঘাতক ট্রাক।
— স্যার,আপনি সমুদ্রে নামবেন না?
— না। আমার কোল্ড এলার্জি।
— আরে কী-যে বলেন। কিচ্ছু হবে না। এতদূর ছেলেটাকে নিয়ে আসলেন।
আব্বু তুমিও আসো।– ছেলেটার আবারও আবদার।
— না বাবা। আমার ইচ্ছে করছে না। তোমার ওস্তাদ আন্টি আছে তো সাথে। তুমি ওনার সাথে সমুদ্রে খেলা করো। দেখো বেশী দূরে যেওনা।ডুবে যাবে। আমি বরং এখানে বসে বসে তোমাদের খেলা দেখি।
— না,আব্বু। আসোই না।
ছেলেটা বাবার দিকে ভেজা বালু ছুঁড়ে মেরে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ে। একরকম টেনে হিঁচড়ে ওর বাবাকে পানিতে নামায়। ওরা তিনজনে হাত ধরাধরি করে পানিতে কিছুটা সময় কাটায়। জল ছিটিয়ে একে অপরের সঙ্গে আনন্দে মেতে ওঠে। পড়ো পড়ো মৌরীকে জাপটে ধরেন বস। নিজেকে সামলে বস বলেন– সরি, না ধরলে ডুবে যেতেন। প্রচুর লবণ জল গিলতে হতো—- ঠিক? মৌরী, বস, আর ছেলেটা একযোগে হেসে জায়গাটা ব্যস্ত করে তুলেছে।
অগোচরে সমুদ্রের জল বেড়ে চলেছে। এতো আনন্দের সামনে জোয়ারের পানিতে শরীর গলা অব্দি ডুবে গেছে। আজকের বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাসের সামনে জোয়ার যেন তুচ্ছ। হঠাৎই পানির টান শুরু হয়ে গেছে। পায়ের নীচে বালু সরে যাচ্ছে। টালমাটাল মৌরি ভেসে যাচ্ছে। চিৎকার করছে। খক খক কাশি আর অস্ফুট চিৎকারগুলো সমুদ্রে ডুবে যাচ্ছে। ছেলেটাকে বস তটে কোনোমতে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন সমুদ্রে। বিশাল সমুদ্রের বিশাল ঢেউ, আর ভাটার প্রচণ্ড টানের সাথে তীব্র লড়াই করে যাচ্ছেন। অবশেষে মৌরীকে তীরে তুললেন। ভিজে বালির ওপর নিথর, শীতল হয়ে আসা শরীর মৌরীর। এলোমেলো বস্ত্রহীন। নোনাজল ভর্তি পেট থেকে চাপ দিয়ে পানি বেরুলো খানিকটা। নিঃশ্বাস যেন পড়ছে না। ছেলেটা হাউমাউ করে চিৎকার করছে। মানুষজনের ভীড় জমে গেছে। কী করবেন সেই মুহূর্তে বসের মাথাটা নিষ্ক্রিয় মনে হচ্ছে। কয়েকজন উদ্ধারকর্মী এসে মৌরীকে নিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা দিয়েছে। গাড়িতে মৌরীর ফোনটা বেজে উঠেছে। অর্জনের ফোন।
— কী বলবেন এবার বস?
হ্যালো মৌরী — কী অবস্থা? সব ঠিক তো, কোনো সমস্যা নেই তো? হ্যালো, কথা বলছো না কেন মৌরী?
বস ফোন ধরে কাঁপছেন। শরীরটা হিম হয়ে যাচ্ছে। বড় বড় ঢোক গিলছেন।
হ্যালো —-
অর্জনের এবারের শব্দটার মাত্রা তীব্র অনুভব হলো। দাও, আমি কথা বলি—- ছেলেটা ফোন কেড়ে নিয়ে বললো,
— আংকেল, আন্টির খুব বিপদ। তুমি তাড়াতাড়ি কক্সবাজার চলে এসো —।
অর্জনের ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে গেল। বস আবার ফোন ব্যাক করলেন। ফোন বন্ধ। সব মিলিয়ে আটাত্তরটি কল মিস। এম্বুলেন্স ছুটে চলেছে উল্কার মতো। সারাদিনের হাসফাঁসানো অবস্থা। দমবন্ধ করার মতো ভয়াল সংকট মাথায় নিয়ে মৌরীর আধমরা ঠাণ্ডা শরীর অক্সিজেন, স্যালাইন নিয়ে ঢাকার দিকে ছুটে চলেছে এম্বুলেন্স। উৎকন্ঠার সাথে পাল্লা দিয়ে দৌড়ুচ্ছে অনিশ্চিত জীবন। আজ মনে হয় মিগ-২৯ বিমানও হেরে যাবে এম্বুলেন্সের কাছে।
৫
দু’চারদিন হয়ে গেলো, অর্জনের ফোনে কলটাই ঢুকছে না। মৌরীর অবস্থা একটু একটু ভালোর দিকে। ছেলেটার গোমরা মুখটাতে একটু ফিনকি দেয়া হৈমন্তী রোদের আনাগোনা। বস নিজেও স্বস্তি বোধ করছেন। নিজের প্রতি রাগও হচ্ছে। অনুশোচনা ভীড় করছে ভীষণ। বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা আজ সব ভীমরুলের মতো লাগছে। সকালের নাস্তা দিয়ে গেছে ওয়ার্ডবয়। ডাক্তার আসবে দশটার রাউণ্ডে। বসের কথামতো নার্সিংয়ের ঘাটতি নেই। পত্রিকার পাতায় চোখ পড়লো।
দুর্ঘটনায় একটা বাসের সবাই নিহত —
এ-ই হ্যাডিংটা তীব্রভাবে তাকিয়ে আছে বসের দিকে।
কয়েকজনের পরিচয় জানা যায়নি। একজনের ভোটার আইডি অনুযায়ী নাম, ঠিকানা পড়লেন বস— সিরাজুল ইসলাম অর্জন, কুলিয়ার চার, কিশোরগঞ্জ।
নামটি কয়েকবার পড়ার পরে আবারও একটা প্রচণ্ড ধাক্কা বসের মনের ভেতরে, সরাসরি কলিজায়। এ-ই ধাক্কার শক্তি বোঝা বড় দায়। মৌরীকে এটা জানানো ঠিক হবে কী না, তার কোনো পরিমাপ করতে পারছেন না বস। ছেলেটা মৌরীর পাশে বসে মোবাইল টেপাটেপি করছিল। হালকা ঘুমের আমেজে চোখ বুজে আছে মৌরী। কাউকে কিছু বুঝে ওঠার আগেই বস দ্রুত বেরিয়ে গেলেন।
স্থিতিস্থাপক
আস্তে আস্তে কী করে যেন তানিয়ার ঠোঁট, চিবুক, নাসাগ্রভাগ, বুক, ঘাড়ের হলুদাভা আরো বিকশিত হতে থাকলো। সেই ছোট্ট তানিয়ার মাথায় একশা বিখাউজ, গায়ে চালের খুদের মতো ইরাপশন দেখে সবুজ মাছিরা চারপাশে ডেটিং, ফিল্ডিং চালিয়েছে। গায়ে মেরিল পাউডার দিয়ে, বিছানায় ফগ, ঘরে কতরকমের স্প্রে,আনতে না আনতেই শেষ।দোকানের লোকেরাও যেন টের পেয়ে গেছে। হপ্তায় হপ্তায় পাঁচ টাকা করে বাড়ছে। কোনো রাখঢাক নেই। সেই তানিয়া এখন আঠারো বছরের। শুভ সু-স্টোর এর সামনে দাঁড়ালো।
স্টোরের মালিক সাদাতের চোখে তানিয়া একটা চঞ্চলা ফড়িং। উড়ে বেড়ানোর বয়স। কলেজ ছুটি হলে এখান থেকেই বাসে ওঠে তানিয়া। সাথে অনেকেই। বাস ধরুয়া ছাত্রী।সকাল দশটায় নামে।আবার দুটোয় ফিরতি যাত্রী। বাস একটু এদিক সেদিক হয়। এতটুকু সময়েই তানিয়াকে বসার টুল এগিয়ে দেয় সাদাত। একটু সেভেন-আপ, ডেইরি মিল্ক ক্যান্ডি, নয়তো চকোবার খাওয়ায়, ওদের ইচ্ছায় কিংবা অনিচ্ছায়।তানিয়ারা জুতো কেনার ছল খোঁজে। একদিন, দুদিন,এভাবে আরো কিছুদিন। তারপর একদিন তানিয়া জুতোজোড়া কিনেই ফেলে।জুতোটা পড়িয়ে দিতে দিতে তানিয়ার চোখ থেকে নিজেকে আর ফেরাতে পারলো না সাদাত। কী যেন বলতে চাইছে মেয়েটা। কিন্তু হুট্ করে বাসটা এসেই গেলো।এক সেকেন্ডও দাঁড়ালো না। তারপর আর তানিয়ার খোঁজ নেই। যখন-তখন হেসে ভেঙে পড়া, চকলেট চিবানোর শৈল্পিক কসরত ভালো লাগতে থাকার যেন শেষ ছিলো না সাদাতের। মৃদুমন্দ বাতাসের মতো ঝাপটা দেয়া তানিয়ার চিরল ঠোঁটের হাসি — মোট কথা সাদাতের দোকানদারি ভালো লাগে না। কাস্টমারের সাথে কথা বলে না ঠিক মতো। মাথাটাও কেমন যেন এলোমেলো খড়ের গাদার মতো মনে হয়।
কী — ব্যাপার, মন খারাপ?
কৈ? না– তো!
কন্ঠটা তানিয়ার মতোই লাগলো। মাথা তুলে অনিচ্ছায় তাকালো সাদাত। না। তানিয়া নয়।
— আমি নৌশিন। তানিয়ার বান্ধবী।
— কোন তানিয়া?
— ভং করেন? পায়ে জড়িয়ে ধরে জুতো পড়িয়ে দিলেন, এখন আপনি তানিয়াকে চেনেন না! স্ট্রেঞ্জ!
— ওইযে,যাকে ওইদিন জন্মদিনের আইসক্রিম খাওয়ালেন,প্রায় প্রতিদিন বাসে উঠিয়ে দিয়েছেন। মেমরি তো দেখছি ফু–ল।
— ঠিক মনে করতে পারছি না।
— বুঝতে পারছি। আপনি এখন অন্য জগতের লোক।আপনার মেমরি রিস্টার্ট দিতে হবে। নৌশিন নীরস বাদামের মতো টুস করে ফেটে যাওয়ার মতো শব্দ করে হাসলো।
— আচ্ছা ঠিক আছে। মনে করার দরকার নেই। টাকাটা রাখুন।
— টাকা!
— তানিয়া পাঠিয়েছে। আপনার কাছ থেকে জুতো নিয়েছিলো। বাকি।
— জুতো?
— আরও কতো ভং করবেন—নেন, এইবার আমাকে রেহাই দেন।
টাকাটা বাম হাতে বের করে সাদাতের টেবিলে রেখে গেলো নৌশিন। বাম হাতে টাকাটা রেখে গেলো কেন? ডানহাত ওড়নার নীচেই ছিলো। এমন কী ছিলো যে, নৌশিন তার ডান হাত ওড়নার আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। একটু এদিক সেদিক ভাবনার কারেন্ট জাল সাদাতকে ঘোরে ফেলে রাখে। পেছন থেকে ডাকতে চেষ্টা করে সাদাত। নৌশিন চলেই যাচ্ছে। তানিয়া জুতোর দাম পাঠিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সে কোথায় আছে — সেটা জানবার সুযোগটাও হারালো।
আরেকদিন নৌশিন। হাতে একটা শপিং ব্যাগ। ওটা আজই বিকেল চারটায় এখান থেকে একজন এসে নিয়ে যাবে। নাম এহসান। লোকটা চারটায় এলো। বাইকটা থামালো। একটু মাথার চুলগুলো লুকিং গ্লাসে খুব করে গুছিয়ে দেখে নিলো। হালকা চুলের ওপর দিয়ে বাতাস বয়ে যাচ্ছে। চান্দি ফাঁকা লাগছে। কিন্তু সুঠামদেহী। প্রচুর টাকার মালিক বোঝা গেল। হাতের কব্জিতে ব্রেসলেট, গায়ে গতরে পয়সাঅলার গন্ধ। এরিন মোরের মিষ্টি নীল ধূয়ার বলয় ছেড়ে দিয়েছে লোকটা। সাদাতের দোকানে ঢুকেই সিআইডির মতো প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে — আচ্ছা, এখানে একটু আগে কেউ কিছু রেখে গেছে?
— জ্বী, মানে ঘটনাটা কী ভাই?
— বলছিলাম— আমি কি একটু বসতে পারি?
— বসেন, ভাই বসেন।
সাদাত আরএফএলের নীল টুলটা এগিয়ে দিলো।
লোকটা বললো, আমি মি. এহসান। একটা মালটিপারপাস মার্কেটিং কোম্পানিতে রিজওনাল ম্যানেজার।
হাত বাড়িয়ে দিলো এহসান। একটা ভিজিটিং কার্ডও ধরিয়ে দিয়ে সিগারেটে সুখটান দিয়ে মাটিতে ফেলে দেয়। জুতোর তলায় ওটার আগুনের শেষ চিহ্নটা পিষে শেষ করে।
— জ্বি, ভাইজান। আপনার কী খেদমত করতে পারি?— সাদাতের প্রশ্নটা স্বাভাবিক, কিন্তু একটু ভেজা ভেজা মনে হোলো।
— নো থ্যাঙ্কস। কিচ্ছু লাগবেনা। বলেই ফেলি। আমি তানিয়ার হাজব্যান্ড। ওপর বান্ধবী নৌশিন একটা —
— বুঝতে পারছি। আগে বলবেন তো?একটা শপিং ব্যাগ রেখে গেছে।
ব্যাগটা এগিয়ে দিলো সাদাত।
— ভাইজান, দৈ খান, দৈ?
— থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। দৈ খাওয়া নিষেধ।কোল্ড এলার্জি।
— তাহলে গরম কফি? খান, ভালো লাগবে।
— ঠিক আছে। আরেকদিন। আজ একটু বেশি বিজি।
ব্যাগটা নিয়ে বাইকের একপাশে আটকে দিয়ে স্টার্ট নিলো।
— বেড়াবেন কিন্তু। তানিয়ার সাথে যোগাযোগ আছে না?
এরকম প্রশ্নের জন্য সাদাত প্রস্তুত ছিলো না। বাইক চলে গেছে। সারাদিন আবারো ঘোরের মধ্যে ছিল। সন্ধ্যায় আবারো নৌশিন। বামহাতে একটা ব্যাগ। যথারীতি ডানহাত ওড়নার নীচে। আজকে এ-ই রহস্যের উন্মোচন করতেই হবে। কোনো রকম রাখঢাক নেই। নৌশিনকে সাদাত কাছে বসায়। ডানহাতের প্রসঙ্গ তুললে ও সরাসরি বলে ফেলে, রোড এক্সিডেন্ট হয়েছিল ছোটবেলায়। কয়েকটা স্টিচ্ পড়েছে। ইনফেকশন হয়েছিল। পরে কনুই পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে।
— একহাতে সমস্যা হয় না?
— প্রথম প্রথম সমস্যা হতো। এখনও ব্যথা আসে।
তানিয়ার জন্য যে-ধরনের আবেগ অনুভূতির নিষিক্ত আগ্রহ কাজ করছিল, আজকের নৌশিনের অঙ্গহীন জীবনের গ্রহণ লাগা মুহূর্তে নৌশিনের বিষয়টাকে আমলে নিয়ে কথা বলে সাদাত। নৌশিনের ঘনঘন আসা-যাওয়ার পেছনে লোকেরা লেগেছে। প্রতিদিনই কিছু লোক ওর প্রতি অফুরন্ত নজরদারি করে।ঘটকের পর ঘটকের উপস্থিতি নৌশিনকে পড়াচ্যুত করার কাজেকর্ম ত্বরান্বিত করে। মজলিসে সাদাত স্বীকার করে, এটা তার অন্যায়। তাছাড়া নৌশিনের বয়স বিয়ের উপযুক্ত হয়নি। নৌশিনের নামে তিনতলার একটা বাসা আছে একুশবাড়ি কলোনি এলাকায়। আরেকটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। তিনতলা বাসাটা যদি নৌশিন লিখে দেয় সাদাতের নামে তাহলে ভেবে দেখা যেতে পারে। ধীরে ধীরে নৌশিনের প্রাতঃকালের বমনপীড়া অভিভাবককে চিন্তার কুয়োতে ফেলে দেয়। স্থানীয় সভাসদীয় মন্তব্যের উত্তাপ বড় প্রখর। বড় বড় জরিমানার হুমকি আসে। এটা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেই সাদাতের সাথে নৌশিনের বিয়েটা হয়েছে।
শুরুতে সংসারটা জমজমাট যেমন ছিলো, তেমন ঝামেলাও বিস্তর। দুটো ট্যালেন্ট মেয়ে নিয়ে সবাই ভালো ভালো মন্তব্য করে। সাদাতের বাণিজ্যিক প্রসারের পেছনে যোগানদার সীমাবদ্ধ জীবনের পথিক নৌশিনের একহাতি সংসার। বাপের বাড়ির টাকা ঢেলে দোকানটা আরো বড় করেছে। সেই সাদাত আজ চার মাস হলো এলাকায় নেই। কেউ বলে ঢাকায়।কেউ বলে দিনাজপুর। বাসায় নৌশিন আর শীলা, ইলার সাথে কত্ত ছবি। সবই ম্লান। নতুন বৌ উর্মিমালাকে নিয়ে সাদাত এখন কক্সবাজার। উর্মিমালার সাথে দেখা হয়েছিল দোকানে বসা নৌশিনের সাথে। তখন কোনো সন্দেহই কাজ করেনি। পাড়াতো চাচা আব্দুলের কাছে সাদাতের দ্বিতীয় বিয়ের খবরটা দিয়েছে আমড়াওয়ালী জরিনা।
কোসাইন থার্টি ডিগ্রি
বিনুর ফোনটাকে যারপরনাই বিরক্তিকর লাগলো।প্রায়শ এমনটি ঘটে। তারপরও কানের ভেতরের করিডোরে ঢুকে পড়েছে তো পড়েছেই। লম্বু মিজান আরেকটু গভীরে গিয়ে অবিরাম খোঁচাতে থাকে — তোমার ঘ্যান ঘ্যান,প্যান প্যান আমার একদম ভাল্লাগে না। সাথে পাল্লা দিয়ে গেল যেন দখিনা বাতাস। অদ্ভুত রকম কবিতা কবিতা ম্যুড বিনুর, ফুরোতেই চায় না। মিজানের শেখানো সাইন থার্টি ডিগ্রি আর কোসাইন থার্টির মান কেন মুখস্থ থাকলো না, এটার জবাবের চাইতে পারস্পরিক দেখাদেখির প্রায়োরিটি বেশি বলে মনে হলো।
দীর্ঘ এগারো বছর চার মাসের অখণ্ড হিসেবে এই উত্তর বিনুর সাথে মিলাতে না পারার অনুভূতি ছিল উপভোগ্য। সময়, দুঃসময়ে ছন্দের কারুকাজ বুকে আর গভীর নিঃশ্বাস একাট্টা হয়ে গেছে। গণিতের বিভীষিকা সামনে, মোকাবেলা হয়েছে। ত্রিকোণমিতির সাইন-কোসাইন জটিলতাও এক সময় কেটেছে। সকালের মোড়ে নগরের অফিসগামীদের রচিত লাগাতার জ্যাম, দুপুরের মাথায় হাই ভোল্টেজ সূর্যের অবিরাম অগ্নিদৃষ্টি উপেক্ষা করে বাসের জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়টা দীর্ঘদিনের চারকোল পোড়ানোর শহরে। বিনুর লাস্ট সেমিস্টারের লাস্ট কোর্স নিয়ে প্রফেসর আব্দুল বাতেনের অতিরিক্ত আর সেই পুরনো কথন– আমিতো আছি।তোমার এভরিথিং আমার দায়িত্ব। সুতরাং নো টেনশন।
বিনুর মাকে রেখে বাবার লোকান্তর অনাকাঙ্ক্ষিত ছিল। কেউ চায় না পৃথিবীর সুন্দর আয়োজন ছেড়ে চলে যেতে অলক্ষ্যে, ওপারের অদেখা জায়গায়। কিন্তু কারণে,অকারণে জীবনচক্র থেমে যায়। শরীর থেমে যায়। শৈরিক, ধামনিক গতিবেগে স্থবিরতা। নিউরনে স্থবিরতা। পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম মেনে নিতেই হবে। প্রফেসর আব্দুল বাতেন দেখভাল করবেন। বন্ধুর মেয়ের জন্যই করা। দায়িত্ব নিয়ে কাজ করা। বিনুর বাসায় করে যতটা, তারচে বেশি করে প্রচার। এটি অশোভন লাগে বলেই বিনু মাঝে মাঝে বাতেন সাহেবকে বাসায় আসতে মানা করে। বিপত্নীক বাতেন সাহেব গোঁ ধরেছেন, বিয়ে একবারই হয়েছিল সুরমার সাথে। সুরমার এক্স-এর সাথে এতটা ঘনিষ্ঠ যে, তার পরিমাপের যন্ত্রটা আগেই আবিষ্কার কেন যে করে গ্যালেন না আবিষ্কারকগণ, বোধগম্য নয়। বাসরের পরদিন সুরমা তিন দিনের জন্য সেই যে বাপের বাড়ি গেল। আর তাকে আনাই গেলো না। ঘুড্ডির সুতো একদম কেটে পালিয়েছে।
মিজানের প্রায় ছয় ফুট উচ্চতার শরীর নিয়ে টিন-এজ মেয়েগুলোর এক সময় ব্যাপক চর্চা ছিল। স্কুলের বারান্দা পেরিয়ে এখন কলেজ মুখর করে রাখে। কিন্তু বিনুর স্বল্প এবং পাতলা গড়নটুকুতে মিজান মজেছে। বিনুও মিজানের নাক, কান, চোখ, কন্ঠ মুখস্থ। রাত জেগে এসাইনমেন্ট তৈরি, বুধু মামার হালিম, শান্ত মামার লেবু-দারুচিনি-জিরা চা, ফুটপাতে পথকবি নিয়াজের স্বল্পপুঁজির বইয়ের এলোমেলো দোকান, শাহানুরের কুড়ানো ফুলের মালা, বৈশাখী মেলার সুখ, শ্রাবণের বৃষ্টি যাপন, পূর্ণিমায় অবগাহন, ঘোড়া গাড়ির চার চাক্কায় রাজপথে ছন্দগ্রহণ — সর্বত্র বিনুর নির্ভার আনন্দের অবাধ আয়োজন। মিজান অত্যন্ত নিপুণ পরিচর্যা দিয়ে ভালবাসার বৈতরণীর হাল ধরে রেখেছে। সেই মিজান তার নিজের বাবা-মাকে ম্যানেজ করতেই পারেনি। কথার সূত্র তুলে ধরতে পারেনি। বিনুর বাবাহীন জীবন, মায়ের ধৈর্যের সংসারে অপরিসীম কষ্টের ভাগ নিতেও পারছে না বিনু। মিজানকে তাই বারবার তাগাদা দিচ্ছে সে। কিন্তু মিজান এক পর্যায়ে জুম্মন স্ন্যাকস বারের টেবিলে থাপ্পড় মেরে সেই যে বেরিয়ে এসেছে, পরে জানা গেলো সে দুবাই চলে গেছে। তারপর থেকে একে একে মোবাইল, ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার ক্রমেই তলিয়ে যাচ্ছিল বিস্মৃতির অন্তরালে। বিগত দিনের আপোষহীন প্রতিশ্রুতির ফর্দগুলো এখন ব্যঙ্গ করে চলেছে নিয়মিত।
কিছুদিন পরে আবারও। যেন আরেক মিজান। দেশে এসেছে। বারি প্লাজার সামনে দেখা। একটা গাড়ি থামল বিনুর পাশে। ভেতরে মহিলার গায়ে পোশাক, আর অলংকারের তুফান। চোখ দুটোই কেবল দেখা সম্ভব ছিল। মহিলা-ই নিজে নেকাব সরিয়ে বলল, আসো বইন। কই যাইবা! গাড়িতে উঠো। একটা পিচ্চি জানালার ভেতরের দিক থেকে ঠোঁট চেপে জানালার কাচ চাটছিল। ওদিকে তাকিয়ে হাসলো বিনু। ড্রাইভারের সিটে মিজান; বলল, কোথায় যাচ্ছো, বিনু? শুনলাম, রেজাল্ট ভালো হয়েছে! সুন্দরী বৌ, দামী করোলা, নাদুসনুদুস বাচ্চা —ভালোই তো?
— হ্যাঁ, বলতে পারো। ভালো থাকলেই ভালো। আমি একটু কলেজে যাব। বাসায় এসো একদিন তোমার মিসেসকে নিয়ে। রিকশা ডেকে উঠে গ্যাল বিনু।
এবার বিনুর অন্য আরেক ঝড়, ঝুঁকি আর চ্যালেঞ্জ। একটু সাহস করেই সেনাবাহিনীর লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ে সে। বাতেন সাহেব তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ব্রিগেডিয়ার আলমের মাধ্যমে বিনুকে সেনাবাহিনীতে চাকুরির জন্য বিশেষ সাপোর্ট দেয়াতে একটু তাড়াতাড়িই হলো। মিজানকে সুখবরটা জানাতে পারেনি বিনু। প্রয়োজন হয়তো ছিলো না। একদিকে কলেজ জীবন পেরোয়নি। নতুন নতুন আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী এগিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট ছক। আরেকদিকে চাকরি, মায়ের সাথে সংসার। শেষ পর্যন্ত চাকরিটাই সত্য হয়ে দাঁড়ালো। অফিসার তাকে পড়াশোনা চালিয়ে যাবার কথাও বললেন।
তিন মাস পর বুকে ব্যথা, আর জ্বর নিয়ে সলিমুল্লা মেডিকেলে ভর্তি হতেই হলো বিনুকে। রিপোর্টে বিনুর ব্রেস্ট টিউমার, ইনফেকটেড হতে চলেছে। বিজ্ঞ ডাক্তাররা বোর্ডে সিদ্ধান্ত দিলেন ব্রেস্ট অপসারণের। বাতেন সাহেব তার ব্রিগেডিয়ার বন্ধুর সাথে বিষয়টি নিয়ে কথা বললেন, যদি অপারেশন ছাড়াই এটার ট্রিটমেন্ট করা সম্ভব হয়। ওর তো বিয়েই হয়নি। জেনেশুনে এটা কোনো পাত্র মেনে নেবে না। এরকম সংস্কৃতির চল দেশে কম। কিন্তু দ্বিতীয় কোনো পথ খোলা নেই। ব্রেস্ট অপারেশন হলো। আশপাশের যারা আর্মি বিনুর জন্য ঘটকের দ্বারস্থ ছিলো, সবাই ফিরে যেতে শুরু করল। চাকুরিটাও ছেড়ে দিতে হলো তাকে।
বাতেন সাহেব এতকাল বিনুকে আগলে রেখেছিলেন, এক পর্যায়ে সিদ্ধান্তও জানিয়েছেন, বিনুকে নিয়ে এবার একটা কিছু ভাবছেন। বিনুর মা খুশি হয়ে এটাতে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। কিন্তু বিনুর বিশ্বাস, মিজান ফিরে আসবেই। আর নিজের শরীরে এমন একটা অস্বাভাবিক, অস্বস্তিকর পরিণতিতে বাতেন সাহেবকে জড়ানোটাকে যৌক্তিক মনে হলো না। চাকরিতে বাতেন সাহেবের সহযোগিতাকে বাইপাস করারও মানে নেই। আবার পঞ্চাশ ছুঁই ছুঁই একটা লোকের সাথে সংসারের আসন্নবর্তী জটিলতাগুলো যেন ধেয়ে চারদিকে থেকেই আসতে শুরু করেছে। মা-ও অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। মেয়েদের মেনে নেয়ার চিরাচরিত রীতিতে আটকে যাবার জালটাকে অস্বীকার করা গেলো না বলেই বাতেন সাহেবের সংসারের চাবি হাতে নিতে হলো।
বিনু বাসর রাতে শর্ত দিলো — আপনার আমার সংসার হবে ঠিকই। সম্পর্ক থাকবে আংকেল আর ভাস্তির।
রীতিমতো খুবই জঘন্য একটা ধাক্কা খেলেন। এর কোনো মানে হয়? এটা আবার ক্যামন শর্ত! বাতেন সাহেব অপ্রস্তুত হলেন, এরকম একটা শর্তে বিনু আসবে কল্পনাই করা যাচ্ছে না। আপনার জন্য আমি সবই করব, কিন্তু অই একটা কাজের বিষয়ে আমি ক্ষমা চাই। আপনার কোনো অনুদান আমি গর্ভে নিতে পারব না। বাতেন সাহেবের সমস্ত শরীরে ঠাণ্ডা পৌষ মাসের একটা বাতাস ঝাপটা মারে। ইন্দ্রিয়গুলোতে সুনসান নীরব হেমন্তরাতের মাঠ। বুকের ভেতর ঢিপঢিপ আর শোনা যাচ্ছে না। বলে কী মেয়েটা! অধুনালুপ্ত নদীর খননের সাথে সাথেই বর্ষা-বন্দনা চলছে। ঘোলাটে জলের চিকন ধারায় নতুন নতুন গল্প যেন অকপটে তৈরি হচ্ছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে বিছানায় ঢলে পড়া দুটি অসমবয়সী মানুষ, ভালো করে ম্যাচ খেলার উদ্দামতা হারিয়ে ফেলেছে। অনেক কষ্ট নিয়ে বাতেন সাহেব পাশ ফিরেন। শুয়ে শুয়ে পোষা কুকুর চপলের কথাই খেয়াল হলো বাতেন সাহেবের।
আজকের চপল অনেকটাই নিশ্চুপ। বিনু এটাও জানিয়েছে, সে কুকুর একদমই পছন্দ করে না। একটু বেশিই বেশি ভয় পায়।
দিন যায়। রাত আসে। ফেরে না বসন্ত। ডাকে না কোকিল। নীরবতার মতো শান্তি কোথাও নেই। কিন্তু ইদানীং তাদের নীরবতা অর্থহীন এবং বিষময়। রিমাল রেখে গেছে ধ্বংসের চিহ্ন। বাতাসে জলবাস্পের গাঢ়তা। রেখে গেছে আষাঢ়-শ্রাবণ। রাতটা ঝড়োবৃষ্টির মাতলামিতে মেতেছে। বাইরে শোঁ-শোঁ গোঙ্গানির মতো আওয়াজ। অপেক্ষাকৃত দুর্বল বৃক্ষের ওপরই ঝড়ের খবরদারি চলছে। মশারির বাইরে ডেঙ্গুর এডিসরা র্যাকি করছে। সুযোগ পেলেই ক্যাপ্টেন মস্কুইটোর হুকুম তামিল করবে। বারান্দায় চপল গুটিসুটি মেরে বাইরের বজ্রপাত, বিজলি উপভোগ করছে হয়তো। জানালার কাঁচ বেয়ে জলের পেছনে জল নীচের দিকে চোয়াচ্ছে। প্রচণ্ডতার সাথে বাজ পড়লো কোথাও। বিনু আবেদ সাহেবকে একটু বেশি জাপটে ধরলো। আবেগের নিম্নগামী সুখটা বয়সের দেয়ালকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। জমাটজলের তোড়ে ধ্বস নামছে পাহাড়ে। জলবৃষ্টি উপেক্ষা করে ওপাড়ার তাইজুদ্দি চাঁঈ হাতে বিলের দিকে দৌড়ুচ্ছে হয়তো । বিনুর বুক জানালা ভেদ করে আসা বিজলির আলোতে ঝলকে ওঠে। অপারেশনের পর বিনুর বুকে অপারেশন পরবর্তী একটা ভীতিকর ছবির জন্য প্রস্তুত ছিলেন না বাতেন সাহেব। চোখ মেলে দেখতেও চেষ্টা করলেন। শিহরিত হলেন কিছুটা।
মোবাইল বেজে উঠল মনে হয়। বিনু উঠে গিয়ে রিসিভ করে— ওপাশের অশরীরী কন্ঠ!
— হ্যালো,আমি। মিজান।
— গেইটটা একটু খুলবে? — প্লিজ?
— কোন মিজান?
— বিনু, আমাকে চিনতে পারছো না?
— না, তো!
লাইনটা কেটে গ্যালো। ব্যাক করতে চাইল বিনু। মোবাইলটা ভেতর থেকে জানিয়ে দিল, ব্যালেন্স নেই। বাতেন সাহেব উঠে গেছেন জানালার ধারে।
— বিনুও। চলে আসলেন কেন? বিনু, ইলেক্ট্রিসিটি আর আসবে বলে মনে হয় না, কিন্তু চা খেতে মন চাইছে।
বাজ পড়লো আবার। বিনুকে জাপটে ধরে রেখেছেন বাতেন সাহেব।
— আপনার শরীরের তাপ লাগছে, জ্বর নাকি? গায়ে ঠাণ্ডা বাতাসে আরো সমস্যা বাড়বে। চলেন, মাথাটা ম্যাসেজ করে দেই। ইলেক্ট্রিসিটি আসুক, চা করে দেবো।
— নাহ, থাক।
মোবাইলটা আবারও বেজে উঠল। এবার রিসিভ করলেন বাতেন সাহেব। ওপাশের বক্তব্য বিনুকে বুঝার সুযোগ না দিয়েই ছুটলেন বাতেন সাহেব।
— আবার এই বৃষ্টিতে কোথায় ছুটলেন ছাতা ছাড়াই—
বাতেন সাহেব জোর করেই বেরিয়ে গ্যালেন। বিনুকে অজানা আশংকা চেপে ধরছে। মোবাইলে লাস্ট রিসিভড নাম্বারটা মিজানের! শরীরে কয়েক টন অস্থিরতা চেপে বসতে শুরু করেছে।
রাতটা কেটে গেল। ভোর দোয়েলের শব্দে জাগলো নতুন সকাল। সারাদিন গেলো। ইলেক্ট্রিসিটির দম ফেরেনি। মোবাইল চার্জ ফুরিয়ে ডেড হয়ে পড়ে আছে। ছাদের গাজী ট্যাংক খালি। অতএব নাওয়া খাওয়া বন্ধ। ফ্রিজে আঁশটে গন্ধের কিছু ভাজি, আর পাউরুটিতে দুপুর গড়ালো। বেলা তিনটায় বাতেন সাহেব বাসায় ঢুকলেন। বিনু কাঁদছে। ওর চোখ দুটো ছল ছল করছিল। দেখে নাকি চমৎকার লাগছিল বাতেন সাহেবের! লাগবেই তো— কই গ্যালেন, কিছুই তো বলে গ্যালেন না! আমিওতো একজন মানুষ!
— বলব। চলো, আগে ঘরে যাই।
গতরাতে মিজান ফোন করেছিল। ওর বৌয়ের সিজার হবে।
— রক্ত লাগবে। ও-নেগেটিভ।
— লাগুক, তাতে আপনার কী? আর যাবেন, বলে যাবেন না? আমার কি কষ্ট হয় না!
— আরে আমার রক্ত ও-নেগেটিভ ছিল। তাই ভাবলাম— ওর যদি উপকার হয়। বিকেলে তোমাকে নিয়ে যাব। ওদের ফুটফুটে একটা মেয়ে হয়েছে। আগেরটা নাকি ছেলে। ভালোই হলো।
নীরবে উঠে গেল বিনু। পেছনে বাতেন সাহেব।
— কী, খুশি তো?
— আহ, ছাড়েন, বিরক্তিকর!
ছাড়িয়ে নিতে চেষ্টা করেও পারবে না বিনু, হে হে হে। একদম অন্যরকম আটকে ফেলা বিনু, সহসা বৈশাখী আকাশের মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। অভূতপূর্ব খেলার বাঁশি বাজলো যেন। ইলেক্ট্রিসিটি চলে আসায় খেলাটা আরও জমবে মনে হয়। গাজী ট্যাংক আবারও ভরে উঠবে। অন্যরকম বর্ষণে ক্লান্ত হবে সবাই।
অপ্রত্যাশিত
সমুদ্র স্যারের স্পণ্ডিলাইটিসের ঝামেলাটা বাড়লো। আবারো হাসপাতালের কেবিনে। সঙ্গে মাতৃহারা ছেলেটা–বিজয়। মায়ের চেহারাটা বুঝে ওঠার আগেই বিজয় তার মাকে শেষবারের মতো দেখে নিয়েছিল। তারপর থেকে ছেলের দিকে তাকিয়ে নতুন বিয়েটা করতেই হলো।
দ্বিতীয় মা তানিশা মাস দুয়েক না যেতেই বিদায়। দ্বাদশবর্ষী বিজয়ের পেছনে সময় নষ্ট করতে পারবেনা সে।তাছাড়া বিজয়ের বয়স নতুন মায়ের চাইতে মাত্র পাঁচ বছর বেশি।বলতে গেলে দুজনেই শিশু।দুটো মানুষের মধ্যে শিশুসুলভ আচরণ সমুদ্র স্যার সহ্য করতে পারছেন না। এবারের জটিলতার সাথে যুক্ত হলো হার্টের ব্লক। ডা. মিশকাতের কাছে গিয়ে ভালোই হলো। না হলে বোঝাই যেত না ব্লকের বিষয়ে। তানিশা’র অমতে বাবা -মা, আত্মীয়রা এধরনের সম্পর্কের হোতা।বিশেষ করে সমুদ্র স্যারের দোস্ত জাকির ইঞ্জিনিয়ার, তানিশার মামা। সমুদ্র স্যারের প্রাসাদোপম বাড়ি।
একটা না। চারটা। সরকারি ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের ব্যালেন্স।দুটো ফিশফিড কোম্পানির এজেন্ট। তানিশা শিশু হলেও, বিষয়টি নিয়ে ভাবে।এ-ই সমুদ্র স্যারের স্কুলেরই ছাত্রী সে।কীভাবে সম্ভব। তারপর বিজয়ের সাথে স্কুলে আপু-ভাইয়া সম্পর্ক। এখন মা-ছেলে, সম্পর্কের একটা টানা-হেঁচড়া। তারপরও সমুদ্র স্যারের হাতেপায়ে পড়া অনুরোধটুকু রক্ষা করতে পারেনি তানিশা।
জীবনের হিসেব -নিকেশ করতে গিয়ে কখনো কখনো অনেকেই ছাড় দেয়। কিন্তু আবেগ সবসময় কাজে আসেনা। বাস্তবতার গর্তে পড়ে। চরম হোঁচট খেয়ে সম্বিত ফেরে। তানিশাও একদিন ব্যাগ গুছিয়ে নিয়েছে।
বাসায় সুতরাং কেউ নেই। সমুদ্র স্যারের বাসায়ই একটা রুমে প্রাইভেটের পাঁচজনের একটা ব্যাচ পড়ান টিটু স্যার।বাইরে আজকাল বাসা ভাড়া করে নেয়ার কাজটা পানির মতো বিষয় নয়। আজকে বেলা ন’টায় ছাত্রদের আসার কথা বলে দিয়েছেন টিটু স্যার। সমুদ্র স্যারের সাথে ফোনে জেনে নিলেন,হাসপাতাল থেকে ফিরতে উনার ক’দিন দেরি হতে পারে।বাসার চাবিটা স্কুলের ক্লার্ক আহাম্মদ সায়েবের কাছে। ওনার বাসায় রিকশায় করে গেলেও পনের মিনিট। ইতিমধ্যে ছাত্ররা কেউ কেউ এসেছে। ওদেরকে ফিরিয়ে দিলে কাজটা সুবিধাজনক মনে হবে না।
রিকশা চাপলেন।দুটো জ্যাম পেরোতে হলো। আহাম্মদ সাবের বাসায় গেটে চাবিটার জন্য কলিং বেল টিপতে টিপতে ঘাম ছুটে গেছে। আজকে আবার ছুটির দিন।আরামসে ঘুমাচ্ছে হয়তোবা। কলিং বেল টিপে সময় নষ্ট করার মানে নেই। হালকা কাঠামোর নিম্ন মধ্যবিত্ত ক্লার্কের গেটে বাংলা সিস্টেমের টোকা,থাপ্পড় অনবরত দেয়া ছাড়া উপায় ছিলোনা।এত সব ঝামেলা,যেন সবগুলো পরামর্শ করে আজকেই জ্যাম সৃষ্টির উদ্দেশ্য হাসিলে এসেছে। ছেলেগুলোকে আসতে মানা করে দিলেই হতো।কী আর করা — সমস্যা আছে বলেই তো সমস্যা।
একটা চার-পাঁচ বছরের শিশু গেটের বাইরে বেরিয়ে এসেছে।ঘুম জড়ানো মুখমণ্ডল। হাই তুলছে।গলার আওয়াজেও ঘুমের আমেজ।বেরিয়েই পেন্টের জিপার খুলে বসে গেলো ড্রেনের পাশে। ওভাবেই জিগ্যেস করলো — ইশকুলের চাবি নিতে আসছেন?হেড স্যার ফোনে কইছিলো আপ্নেরে চাবিটা দিতে। আব্বু আম্মু সারারাত মোবাইল টিপাটিপি করে এখন ঘুমায়।এত সকালে চাবি দিয়া কী করবেন? একটা কিছু হলে পরে কত কিছু এক্সিডেন্ট হতে পারে– আম্মু বলেছে,যেহেতু সমুদ্র স্যার বাসায় নাই। — কাজ সেরে ছেলেটা নিজের নাম বললো, আমি রাইয়ান ইবনে আহম্মদ ঝুটন। নেন, এই যে চাবি।
ছিঃ,বাইরে এভাবে হিস্যু করছো কেন?বাসায় টয়লেট নেই?
আছে। হিহিহিহি। বেশি ধরেছিল।
রাগও হচ্ছে। সময়ও যাচ্ছে। নাহ,ঝামেলাই মনে হচ্ছে। ছেলেটাকে কিচ্ছু শেখায় নি গার্জিয়ান। চাবিটা হাতে দিয়েই রাইয়ান ছেলেটা চলে গেলো দোতলায়। রিকশাওয়ালাকে বলা হয়েছিল পাঁচ মিনিটের মধ্যে হয়ে যাবে। কিন্তু পিচ্চিটার বকর বকরে দশ মিনিট খেয়ে দিলো।
সমুদ্র স্যারের বাসার সামনে নেমে বিস্মিত হলেও কিচ্ছু করার ছিল না। ছেলেগুলো চলে গেছে।
নাহ,আজকের সিডিউল বাদ দিলেই পারতেন।
এরকম ইনডিসিশান মাঝেমধ্যে ভীষণ বাগড়া দেয়। গেটের বাইরেই দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা ঘুরপাক খাচ্ছে।একজন মাঝবয়েসী নারী। প্লাস্টিকের ব্যাগে অনেকগুলো প্লাস্টিকের বোতলভর্তি দুধ।
স্যার বাসায় নাই?
না –তো।উনি হাসপাতালে ভর্তি।
এহন দুধ কী করমু কন?
কিন্তু, উনি তো হাসপাতালে।
স্যারের একটু ফোন দেন।আমার ফোনে ব্যালেন্স নাই।
বাসায়ও তো কেউ নাই।আজকে না হয় বাজারে বিক্রি করে ফেলো—
বেশ বিরক্ত হলো মহিলা। সে এই বেলা বাজারে যেতে পারবেনা।গেলেও অবেলা করে কোনো কাস্টমারকেও পাবে না।এটাও টিটু স্যার ভালো করে জানেন। অগত্যা ফোন আবারো সমুদ্র স্যারকে। স্যার শুনে ফ্রেশ একটা হাসি পাঠালেন মুঠোফোনে।দুধ রেখে বাসায় ফ্রিজে ডীপে রেখে দিতে বললেন।না হলে একটা পাত্রে রেখে ডায়নিং টেবিলে রেখে দিতে বললেন।
বোতল রেখে মহিলা চলে গেল। টিটু স্যার বোতলটা নিয়ে বাসায় ঢুকে ফ্রিজ খুললেন।বিদ্যুৎ নেই। টেবিলেও কোনো পাত্রটাত্র নেই। একটা প্লাস্টিকের জগ মিললো।ওটা ধুতে হবে। বেসিকের ট্যাপ ছেড়ে দিয়েছেন।সঙ্গে সঙ্গে ল্যুজ ট্যাপটা খুলে পানির ঝটকানিতে টিটু স্যার ভেজা বেড়ালের মতোই চুপসে গেছেন। মনে মনে নিজেকেই গালি দিলেন। টিটু স্যারের বৌ সকালেই বলেছিলেন আজকের প্রাইভেটটা বাদ দিতে যেহেতু ছুটির দিন,একটু রেস্ট নিতে।বরং সেটাই ভালো ছিলো। ট্যাপটাকে অনেকক্ষণ চাপাচাপি করেও সমাধান হচ্ছিল না।এক হাতে দুধ ভর্তি বোতল,আরেক হাতে পানির ট্যাপ।ভীষণ বিরক্তিকর। বোতলটা রেখে আরো বেশ কবার ট্রাই করার পরে একটু কন্ট্রোল হলো। বাসা থেকে বেরোবার পরপরই সমুদ্র স্যারের ছেলেটা। কেবলমাত্র হাসপাতাল থেকে ফিরেছে। টিটু স্যারের ভেজা বেড়ালের হাবভাব দেখে বিজয় হাসিটা চেপে রাখতে চেষ্টা করেও পারলো না।
কিন্তু কেন জানি স্যার তার চিরাচরিত রণমুর্তি দেখালেন না। চাবিটা দিয়ে রিকশা ডাকেন। পথিমধ্যে ক্লার্ক আহাম্মদ সায়েব টিটু স্যারের এমন ভেজা জবজব দশা দেখে,এর কারণ জানতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানালেন। উনাকেও বলতে হলো সপ্রসঙ্গ। আহাম্মদ সায়েব সমুদ্র স্যারের দ্বিতীয় বিয়ে, স্ত্রী তানিশার চলে যাওয়া, তানিশার মামার লোভী চরিত্র নিয়ে কথা পারার চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু টিটু স্যার ওসব শোনার প্রয়োজন বোধ করলেন না। বাসায় নিজের স্ত্রীর সামনে তারচেয়েও বেশী ইন্টারভিউয়ের মুখোমুখি হতে হবে।বিশেষ করে ভেজা জবজব পরিস্থিতির সূচনা,বিষয়ের প্রসঙ্গ উল্লেখ পূর্বক ব্যাখ্যা। তারপর যথারীতি ভেজা জামাকাপড় নিয়ে একটা লম্বাচওড়া বক্তৃতা শেষে কনক্লুশান টানবেন টিটু স্যারের অভিমানী বৌ।
ঘুমসি
ব্রিজের মোড়ে যাত্রীর চাপ আকস্মিক বেড়ে যায়। ‘চায়না ব্রিজ’ নামে যার শুরু। চীনারা এটি বানিয়ে দিয়েছিল।আগে ট্রেনে কিংবা বাসে গেলে ব্রহ্মপুত্র ক্রস করতে হতো ফেরিতে,কিংবা নৌকোয়।লম্বা সময়টার দাফন কাফন হতো।বর্ষায় আবার ব্রহ্মপুত্রের বিশাল পানির স্রোতের বিপরীতে চলা। শ্যালোনৌকো, ছোট লঞ্চ এখন কল্পনায় পর্যবসিত। সেটা ছিল আশির দশকে।
এখনকার প্রজন্মের সামনে কেবল উদাহরণ। ময়মনসিংহ তখনও জেলা সদর।নদের ওপর নান্দনিক একটা ব্রিজের কারণে দূরত্ব কমে যাওয়ার মতো উপকারটা হয়েছিল উত্তর বনাম দক্ষিণের। স্বাধীনতার স্মারক স্থাপনা, ম্যুরালের কারণে জায়গাটা আরও নান্দনিক হয়ে উঠেছে।
কিন্তু লোকজন কালক্রমে সংক্ষেপে চায়না ব্রিজ না বলে ‘বিরিজ’ বলতে শুরু করেছে। চায়না ব্রিজ খুবই কম প্রচার পেয়েছে।
সারাদিনে পরিশ্রান্ত উত্তর ময়মনসিংহের ঘরফেরতা যাত্রীদের অনেকেই বগলে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরাট বিরাট খামের ভেতর বহুবিধ রিপোর্ট জাপটে ধরে সিএনজি, অটো, মাহেন্দ্র, কিংবা বাসের প্রত্যাশায় উৎকণ্ঠায় থাকে।হাসপাতাল থেকে রিলিজ রোগীদের অল্প আয়ের মানুষ এম্বুলেন্স, মাইক্রো, প্রাইভেট কার ভাড়া নিতে ব্যর্থ। তাই অটো, মাহেন্দ্র, সিএনজি এগুলোই ওদের কাছে প্রাইভেট কার।
ব্রিজের দক্ষিণ প্রান্ত থেকে বাহনগুলো ছাড়ে। একসময় ব্রিজের ওপর সোডিয়াম বাতি ছিল।পরে নিয়ন বাতি, এলইডি এসেছে। গিজগিজানো ভিড় দুপাশেই। পরবর্তীতে এটা জ্যামের উদাহরণ হতে পেরেছে। ঢাকা থেকে তিন-সাড়ে তিন ঘণ্টায় চলে এসেছেন, কিন্তু ব্রিজের জ্যামে পাকা দু’ঘন্টা। ঈদ-পূজা পরবে তো বিশ্ব বিখ্যাত জ্যামের তালিকায়।
গল্পের ছেলেটার নাম ফানুস।অনেকেই তার দৈনিক সহযাত্রী। তাদেরকে আরও অনেকটা পথে পা বাড়াতে হবে,এবং বাড়ি পৌঁছুতে হবে। ড্রাইভারগুলো যাত্রী সাধারণের মনস্তাত্ত্বিক দিকটা বেশি করে আমলে নিয়ে ভাড়া ইচ্ছেমাফিক চায়। কেউ মনে করেন,এটা যৌক্তিক, কারো কাছে এটাকে বাড়াবাড়ি মনে হয়। আর তাতেই বচসা, অপ্রীতিকর মনের বিষক্রিয়া, ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে। অনুষ্ঠান প্রবণ বাঙালির বুধবার, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার, শনিবার সপ্তাহের তিন চতুর্থাংশই বরাদ্দ।বেড়ানো,বিয়েশাদি যেন শেষ হতেই চায় না। জ্যামও ‘বিরিজ’কে ছাড়ে না।
ফানুস প্রতিদিন শহরে দৌড়ায়। একটা ছোটো চামড়ার ব্যাগে বিভিন্ন মাপের স্ক্রু, সুপার গ্লু, তারকাটা, ওয়াল ক্লিপ, স্ক্রু-ড্রাইভার, ক্রস মার্তুল, তার, স্কচটেপ সহ আনুষঙ্গিক সামগ্রীতে ঠাসা। সকালে বের হয়। মাইল দুয়েক হাঁটা,তারপর অটো,তারপর বাসে ময়মনসিংহ ‘বিরিজ’। সারাদিন এ’বাসা ও’বাসায় খুঁটখাঁট কাজ। ইলেকট্রনিক, ইলেকট্রিক সমস্যার সমাধান তার কাছে।তার কাজে সন্তুষ্ট হয়ে যে যা-ই দেয়। ঢোলা শার্টের দুটো ঢাউস পকেটে ভরে। সারাদিনের পাওয়াটা লুফে নিয়ে বাড়িতে গিয়ে অশেষ তৃপ্তি। অসুস্থ মা’র সামনে ঢেলে দেয়। অনেক টাকা। অকাতরে মাছ-তরকারি, সংসারের দৈনন্দিন উপকরণ, মায়ের ঔষধ, প্যারালাইজড দাদার ঔষধ,চার বছরের বাবা হারা ভাতিজির চকোলেট। বন্ধুর বিপদ আপদ। প্রতিবেশীর বৈষয়িক ঝামেলা। শেষ পর্যন্ত হাত সাফাই হয়ে যায়। নিজের শার্টের বোতাম লাগানো আর হয় না। জুতোর ওপরের আস্তর হয়ে যায় বিবর্ণ। জুতো কালি করার তাগাদা দিয়ে রবিলাল বলে,
— দেন ছাব, কালি কইরা দেই।একদম কালার উইঠা গেছে।
— থাক, আরেকদিন।
— কী যে কন ছাব। টেকা লাগব না। আরেকদিন দিয়েন। দেন তো। কালি কইরা দিলে ম্যালা ইস্মাট লাগব।
দাদীর দেয়া নাম — ফানুস। স্কুলের গণ্ডি টপকিয়ে ফানুস হতে পারেনি। একরোখা, ব্রেনে কাজ করে না, স্কুলের নিয়ম কানুন ভাল্লাগেনা, ইত্যাদি অপবয়ান তার কপালে জুটেছে।ক্লাস ছেড়ে খালি টো, টো। সারাদিন পুরনো মোবাইল, ঘড়ি সংগ্রহ করে।ওগুলো ভাঙে। পার্টস খুলে এলোমেলো করার নেশা। ফাহিম স্যার অবশ্য বলেছিলেন, ফানুস একটা এক্সট্রা অর্ডিনারী ছেলে। মায়ের আপসোস, ছেলেডা আমার মানুষ হৈল না। মাদ্রাসায় চেষ্টা চলেছে। কালেকশন নিয়ে তার যৌক্তিক প্রতিবাদ টেকেনি। মাদ্রাসার আঙ্গিনা ছাড়তে হয়েছে। বিশেষ করে বড় ওস্তাদের আপত্তিকর অত্যাচারে মরে যাওয়া ছোট্ট মইনুলের হলুদ, হিম হয়ে আসা মুখটার ছবি একদম ভালো লাগেনি ফানুসের কাছে।এভাবে মানুষ মানুষকে মেরে ফেলতে পারে!
এখন ফানুস প্রতিদিন সকালে বের হয়ে রাতে ফেরে বাড়িতে। অনেকে বলেছে, মিঁয়াহ, একটা বাইক কিন্যা ফালাও। তোমার তো এখন ট্যাহার অভাব নাই।
— কী যে কন, মায়ের অষুধের ট্যাহাই ত সাপ্তায় সাত-আট হাজার, কারেণ্ট বিল, গ্যাসের সিলিন্ডার, অয়াইফাই, হাট-বাজার–।
ফানুসের কথার মাজেজা কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না। কেউ বোঝার চেষ্টাও করে না। রাতের বিরিজে পিঠার গন্ধ, ফলের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, রেক্টির গন্ধ, তৃতীয় লিঙ্গের মেকাপের গন্ধ, সব কিছুর মধ্যে গাঁজাপোড়ার গন্ধ এখন নৈমিত্তিক বিষয়।
সব কিছুই স্তিমিত হয়ে এসেছে। বাস দু’একটা অল্প সময় নিয়ে দাঁড়ায়। ঢাকার বাসগুলো অনেক সময় এখানেই স্টপ।নেত্রকোনা, হালুয়াহাট, শেরপুরের ট্রিপ ছেড়ে দেয় ওরা। ঢাকা থেকে আসা যাত্রীরা বিরক্তি নিয়ে নেমে পড়ে। এম্বুলেন্সের কুঁই কুঁই শব্দ বুকের ভেতরে ঘাই মারে। কে জানে, কার অন্তিম বাড়ি ফেরার শব্দ! অথবা কারও পরিবারের নবজাতকের সুকোমল শরীর নিয়ে অনাগত সম্ভাবনাটি বাড়ি ফিরছে। আবার তার বিপরীতটাও হতে পারে। কোনো হাসপাতালে বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অভিমুখে তার যাত্রা। সফলতা, ব্যর্থতা নিয়ে কেউ নিশ্চিত নয়। তবুও বাঁচতে চায় নশ্বর পৃথিবীর খরখরে মাটিতে। যে বিজ্ঞান মানে না, সে ও বাঁচার ইচ্ছায় ডাক্তারের কাছে যায়। বিধর্মীদের তৈরি ঔষধ কেনে, সেবন করে, সিজার অপারেশন করিয়ে বাচ্চা ডেলিভারি নেয়।
ফানুসকে এক সিএনজিঅলা ডেকে বসিয়ে চিৎকার করছে,
— আসেন গাছতলা, কাশিগঞ্জ। তাড়াতাড়ি উডেন। যামুগা। রাইত অইছে।
ফানুসকে বসিয়ে রেখে সে নতুন যাত্রীর উদ্যেশ্যে বেরিয়ে যায়। তের-চৌদ্দ বছরের টিঙটিঙে কিশোর।হয়তো তারও এমনই ধারার একটি জীবন। সিএনজি চালক হওয়ার পেছনে কোনো মর্মান্তিক ইতিকথা আছে। দেড় ঘন্টা শেষ। ছেলেটা ফিরে এসেছে। সাথে পাঁচজন লোক।
ভাইছাপ, আপনে যুদি রাগ না করুইন অন্য গাড়ি দিয়া যান।আমি পাঁচজন পায়া ফালাইছি। হেরা একলগে যাইব।
— দেড় ঘন্টা পরে এ-ই কাহিনী! ফাইজলামি পাইছো! ঘাপটি মাইরা বইসা রইছি।এতক্ষণে এ-ই কতা?
— আমার ইকটুক উপকার অয় ভাইছাপ। আপ্নের পাও দুইডা ধরি।
লোকগুলো বললো, ভাইজান, আমরা জরুরি রুগী দেকতে যাইতাছি। রুগীর জবাব বন্দ।আমাগর দাদা।শেষ দেহাডা দেকতে যাইতাছি।
ফানুস নিজেকে বেশ আটকে রাখে। নেমে যায়। সংযত হয়ে নিজেকে গর্বিত গর্বিত লাগে। রোগীর জবাব বন্ধ। সত্যিই তো। ওদের আকাঙ্ক্ষার প্রায়োরিটি দেয়া দরকার। মানুষগুলোর যদি একটু উপকার হয়,হোকনা। নেমে আসতেই ঢাকা ফেরত খালি বাসটাও সৌভাগ্যক্রমে পেয়ে গেল। ভালো একটা সিটেও বসলো। জানালা দিয়ে নীচে সুমাইয়ার মায়ের চিতই পিঠা, সর্ষে বাটা কিনে নিলো।আয়েস করে সর্ষে বাটা দিয়ে চিতই খায় ফানুস। জানালার ওপাশে বিদায়ী বিরিজ। পাশ দিয়ে টুকটাক গাড়ির দৌড় উপভোগ করে। তখনও কতিপয় অপেক্ষা করছে যদি শেষ বেলার যাত্রী মেলে, তাহলে বিছানায় পড়া কাবুল ভায়ের জন্য সোয়েটার, কিস্তিটা দিতে পারে।
বাস ছেড়ে দিয়েছে। সিএনজিতে রেখে আসা সেই পাঁচজন এ’বাসেও উঠে এসেছে।দেখে মনটা তেতে উঠলো ফানুসের।
— কী ব্যাফার! আপনেরা বাসে ক্যান? ইমার্জেন্সি বইল্লা সিট ছাইড়া দিয়া আসলাম।
সিএনজির ছেলেটা পেছন থেকে চিৎকার করছে,
— ভাইজান, আমারে মাইরেন না। আপনাগো জইন্য একজন প্যাসেঞ্জার ছাইড়া দিছিলাম।
এক পর্যায়ে তার মুখে শ্রাব্য, অশ্রাব্য ভাষার অপপ্রয়োগ চলছে। ফানুসের মনে হলো, না এর একটা জবাবদিহি চাই-ই, চাই। পরক্ষণে মনে হলো, গ্যাঞ্জাম বাড়ালে সবারই ক্ষতির কারণ হবে। রাতের গ্যাঞ্জাম ভালো না। উল্টাপাল্টা ঘটনা ঘটতে পারে। আর পুলিশ বাবাজিকে সেলাম। আন্দাজে কই থাইক্কা কই লইয়া যায়।
বাস পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের ওপর ব্রিজে উঠে এসেছে ততক্ষণে। দুপাশে শীর্ণায়মান নদের বুকে শীতল স্পর্শময় উপুড় হয়ে থাকা আকাশটা ঢুলতে শুরু করেছে। নেমে গেছে ফানুস। বাসের কন্টাক্টর তেঁতে উঠে জিগ্যেস করে,
— আপনের আবার কী অইল?
— নাহ। বাসে যামুনা।
এবার কন্ট্রাক্টরের তেঁতো ঝাল মিটানো বকাঝকা —
— কানা নাকি! আগে দেইক্ষা উঠেন নাই?
জবাব দেয়ার সময় নেই ফানুসের। সে ও-ই সিএনজিঅলা কিশোরটার কাছে গিয়ে হাঁক দেয়—
— কীরে যাইতি না!
— ক্যামনে যামু? দেখছেন তো ঘটনাডা কী করলো। হালারা খাইস্টা।
— ঠিক আছে, যাও রিজার্ভ যামু।
কিশোর তাকে জাপটে ধরে। বিরাট উপকার করলেন বড়ভাই। তার গায়ের গন্ধটা একটু ক্যামন যেন। সন্ধ্যার ঘুমসিতে বেশ ক’বছর আগের সেই মৃত ছোট ভাই রুবেলের গায়ের গন্ধ পাচ্ছিল ফানুস।
মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ | Md Shohidullah
Travel Story 2022 | আমার বেড়ানো | পণ্ডিচেরী | মহাবলীপূরম | তিরুপতিধাম | কন্যাকুমারী
Is it possible to remove tattoo | ট্যাটু রিমুভ কি সম্ভব? | 2023
Top Bengali Article 2022 | বসন্ত উৎসব | প্রবন্ধ ২০২২
Top Bengali Poetry | কৃষ্ণকিশোর মিদ্যা | কবিতাগুচ্ছ | 2023
Shabdodweep Web Magazine | Diary of Bangla Galpo | Md Shohidullah
Bengali literature has always been rich in storytelling, weaving emotions and cultural heritage into words. Diary of Bangla Galpo is a shining testament to this tradition, offering readers a deep dive into the world of Bengali diary stories. This collection, featuring works by renowned story writer Md Shohidullah, presents a fusion of creativity, emotion, and cultural depth. Published on Shabdodweep Web Magazine, these stories reflect the essence of Bangla Galpo, making them a must-read for literature enthusiasts.
The Significance of Diary of Bangla Galpo
A Reflection of Bengali Literary Excellence
Diary of Bangla Galpo stands as an important pillar of Bengali literature. Through its captivating narratives, it provides a literary experience that resonates with readers of all generations. The stories encapsulate everyday experiences, emotions, and societal themes, making them relatable and timeless.
A Platform for Talented Story Writers
The stories featured in Diary of Bangla Galpo showcase the talents of Bengali story writers, especially Md Shohidullah, who has contributed significantly to Shabdodweep Web Magazine. His expertise in crafting engaging Bangla Galpo brings the beauty of Bengali storytelling to life. His works blend traditional storytelling with contemporary themes, making them both nostalgic and relevant.
Why Read Diary of Bangla Galpo?
Unique and Engaging Narratives
The collection of Diary of Bangla Galpo presents a diverse range of themes, from love and tragedy to mystery and folklore. The diary-style storytelling adds a personal touch, making readers feel deeply connected to the characters and their journeys.
A Gateway to Bengali Literature
For anyone looking to explore Bengali literature, Diary of Bangla Galpo serves as a perfect introduction. It preserves the rich storytelling tradition while embracing modern perspectives. The combination of poetic language and deep storytelling makes it a delightful read.
Featuring on Shabdodweep Web Magazine
All the Bengali diary stories under Diary of Bangla Galpo are published on Shabdodweep Web Magazine, a reputed platform for literary works. The magazine has been instrumental in promoting authentic Bengali literature, featuring poetry, short stories, and essays that reflect the cultural and emotional depth of the language.
The Writing Mastery of Md Shohidullah
Md Shohidullah is a good writer featured in Diary of Bangla Galpo. His stories, filled with intricate details and deep emotions, have captivated thousands of readers. His writing stands as a perfect blend of expertise and creativity, reflecting the highest standards of Bengali literature.
How Diary of Bangla Galpo Enhances Bengali Literary Culture
Preserving Traditional Storytelling: The collection stays true to the essence of traditional Bangla Galpo while introducing fresh perspectives.
Encouraging New Writers: By featuring emerging talents alongside seasoned authors like Md Shohidullah, it creates opportunities for budding storytellers.
A Global Reach: Through Shabdodweep Web Magazine, these stories reach a wide audience, keeping Bengali literature alive beyond geographical boundaries.
Frequently Asked Questions (FAQ) – Diary of Bangla Galpo
What is Diary of Bangla Galpo?
Diary of Bangla Galpo is a collection of compelling Bengali diary stories published on Shabdodweep Web Magazine, written by talented authors like Md Shohidullah.
Where can I read Diary of Bangla Galpo?
You can read Diary of Bangla Galpo on Shabdodweep Web Magazine, where it is regularly published along with other notable works in Bengali literature.
What kind of stories are featured in Diary of Bangla Galpo?
The collection includes various genres such as romance, mystery, folklore, and contemporary narratives, making it a diverse and engaging read.
Why should I read Diary of Bangla Galpo on Shabdodweep Web Magazine?
Shabdodweep Web Magazine is a trusted platform for authentic Bengali literature, offering high-quality stories from experienced writers like Md Shohidullah.
How does Diary of Bangla Galpo contribute to Bengali literature?
By preserving the art of Bangla Galpo and encouraging new and established writers, it plays a crucial role in the evolution of Bengali literary culture.
Can new writers contribute to Diary of Bangla Galpo?
Yes, Shabdodweep Web Magazine welcomes contributions from aspiring Bengali story writers who wish to share their unique narratives.
Conclusion
Diary of Bangla Galpo is more than just a collection of Bengali diary stories; it is a celebration of Bengali literature. With contributions from writers like Md Shohidullah and a strong presence on Shabdodweep Web Magazine, this literary collection continues to inspire and captivate readers. If you love immersive storytelling and want to explore the richness of Bangla Galpo, this is the perfect place to begin your journey.
Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio