Stories of Nasir Waden
Kahini Bengali Book Online | Read Bangla Galpo
মায়া সংসার [Maya Sangsar | Maya Sansar]
এক
জীবন সংগ্রামের রণতরীতে চড়ে কোন একজন অভিযাত্রী যখন অনিশ্চিত দূর গন্তব্যের দিকে ধাওয়া করে, তখন সেও জানে না, সেই অনন্ত গন্তব্যের জায়গাটা হতে পারে কতখানি সুন্দর, অথবা যন্ত্রণাদায়ক। নিরপেক্ষ যাত্রা বলে যেমন কিছু হয় না, তেমনি মানুষও নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। যদি কেউ নিজেকে নিরপেক্ষ বলে দাবি করে, তবে তা যতখানি ভান, ততখানি শঠতা ছাড়া অন্য কিছু নয়।
শরতের শিশির যতটুকু মধুর ও প্রাণোচ্ছল থাকে, জ্যৈষ্ঠের কাঠফাটা গ্রীষ্মের দাবদাহে সেই শিশির পতনের দিকে কেউ কি ততখানি লক্ষ রাখে? অসময়ে ঝরা-শিশির প্রচণ্ড তাপে ও দাহে ধূসর পাতায় সেঁধিয়ে মরে যায়। তার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যায়। কেউ বুঝতেই চায় না যে, সেই শিশিরের ক্লান্তময় বেদনার্ত ব্যথা কীভাবে জগতময় হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকে। যেমন মানুষকে দুরারোগ্য ব্যাধির কবলে পড়ে হাবুডুবু খেতে হয়।
জীবন সংসারের পালতোলা নৌকাখানি যতদিন মৃদুমন্দ বাতাসে, স্বতঃসলিলা জলধারা ঢেউয়ের ওপর উড়ে চলে, ততদিন নৌকোর মাঝি ও আরোহীর মনে থাকে উদ্দাম ও উৎফুল্লতা। শিক্ষাই, নতুন করে গড়ে তোলে জীবন, সমাজ হয়ে ওঠে আলোর প্রহরী। সামাজিক জীবসমূহ সেই আলোর পথ ধরে, তিমিরকে ভেদ করে অনন্ত সুখের দিকে পাড়ি দিতে চায়। সুধাংশু বাবু সারাটা জীবন শিক্ষার্থীদের জ্ঞান বিতরণ করেই এসেছেন। এই বয়সে এসেও ছাত্র-দরদী মনোভাব দূর হয়ে যায়নি। স্কুল থেকে অবসর নিয়েও শরীরের সামর্থ্যটুকুকে আশ্রয় করে বিদ্যা বিতরণে কার্পণ্য করেন না । এহেন ব্যক্তির জীবন সায়াহ্ন নেমে এলে নিজেকে অসহায় বোধ করেন।
পঁচাত্তর ছুঁয়ে ফেলেছেন গত মাসে। আগের মতো জন্মদিন পালন করার আদিখ্যেতা আর নেই। তাই, অসহায় মরামাছের মতো নিষ্পলক চোখে বারান্দার এক কোণে শক্ত চৌকির উপর শুয়ে থাকেন সারাক্ষণ। সেবা যত্ন বলতে সেই সাবিত্রীর হাতের ছোঁয়া। জীবন সঙ্গিনীর অক্লান্ত সেবা যত্নে হাড়গোড় ক’খানা এখনও টিকে রয়েছে। হাসপাতাল থেকে ডাক্তারবাবু বলে দিয়েছেন,
— আপনারা বাড়ি নিয়ে যান। একটু সেবা যত্ন করুন। যতদিন টিকে থাকে।
— তার মানে?
— তার মানে হচ্ছে আর বেঁচে ওঠার কোন আশা ভরসা ডাক্তার বাবু দিতে পারেননি।
এতদিনের সব শখ, আহ্লাদ নিঃশেষের দিকে। হয়তো এই দেখাই, দুনিয়াকে শেষবারের মতন দেখা। অগোছালো বিছানার উপর শুয়ে শুয়ে ভাবছেন সুধাংশু বাবু। কোন এক অজানা আতঙ্ক তাঁর চোখে মুখে ক্রমে ক্রমে এসে জমা হচ্ছে। ‘খুক্, খুক্’ করে বারকয়েক কেশে উঠলেন। জীবনের প্রান্ত সীমায় এসে এতদিনে বুঝতে পারছেন, জীবন কতটা মূল্যবান। অথচ তিনিই এই জীবন, এই সংসারকে এতদিন কোন গুরুত্বই দিতে চাননি।
কাশতে কাশতে, আস্তে আস্তে মুখ থেকে বের হয়ে আসে দুই এক ফোঁটা তাজা রক্ত । বের হয়ে আসা রক্ত সাবিত্রী দেবী বিছানার পাশে রাখা ছেঁড়া শাড়ির টুকরো দিয়ে আলতো ভাবে মুছে দেয় মুখখানা।
দুই
স্কুল শিক্ষক সুধাংশু রঞ্জন বাবু যৌবনের দিনগুলোতে স্কুল সামলানোর পাশাপাশি রাজনীতির হাল ধরেছিলেন। ততদিন সংসার ধর্ম কি? কীভাবে চলছে, সেদিকে লক্ষ ছিল না। কেবল ভাঙাচোরা সংসারটা টুকটাক যন্ত্রপাতিতে তালি দিয়েই সারিয়ে এসেছেন মাত্র। পূর্ণ সময় দিয়ে দেখার অবকাশ ছিল না। সমাজের নানান প্রতিকূল ঘটনার বারবার সম্মুখীন হয়েছেন, তবুও হাল ছেড়ে দেননি। নিজ দক্ষতা ও বুদ্ধি বিদ্যা প্রয়োগে সমাধান করে দল ও সংগঠনকে মজবুত করে তুলেছেন। যেকোনো বস্তু বা জিনিসের মেরুদণ্ডটা আসল। কিন্তু যেদিন সেই মেরুদণ্ডে ঘুণ ধরে, ভঙ্গুর হয়ে পড়ে, সেদিন সেই শরীরকে কোনক্রমে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। মানবিকতা ও সততা ছাড়া কোন রাজনৈতিক বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করা যায় না।
— কি সুধাংশু বাবু! আমাদের সমস্যাটা একটু দেখুন–, বলে উত্তেজিত হয় শংকর। শংকর ঘোড়েল। একজন নামকরা কুখ্যাত সমাজবিরোধী। শক্তি প্রদর্শন করে, রাজনৈতিক ছত্রছায়ার আড়ালে থেকে দেদার লুটে, ঘরবাড়ি বানিয়ে ফেলেছেন। এলাকায় মাফিয়া বলে চিহ্নিত। মানুষজন ত্রাসে সম্ভ্রম করে থাকে।
‘দেখছি, দেখছি’– বলে জানান সুধাংশু বাবু।
— আর কত দিন দেখবেন? এবার আমাকেই দেখতে হবে, আপনার পদ রাখা যায় কিনা, — বলে হুংকার দিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে যায় শংকর।
চেয়ারে বসে বসে ভাবেন, এইসব লোকেদের জন্যই দলের এত ভরাডুবি। এদের ডানাছাটা না করলে এক সময় দল ধ্বংসের মুখে পড়বে। দলকে বিশুদ্ধিকরণ করা সম্ভব হবে না।
কিন্তু, এদের হাত এতটাই লম্বা যে সুধাংশুর থেকে অনেক গুণ দীর্ঘতর। তাদের হাত যে লম্বতর সেটা টের পেয়েছিলেন কিছুদিন বাদেই। একেবারে কমিটি থেকে ছাঁটাই হয়ে গেলেন তিনি। দীর্ঘদিনের এক সক্রিয় সংগঠক ও জনদরদী কর্মী। একবুক জমানো সেই অপমান আর অপরাধবোধ নিয়ে দূরে সরে যেতে হয় তাঁকে। এদিকে বয়সের জন্য বিদ্যালয় থেকেও নিয়মের কারণে অবসর নিতে হলো একদিন। এখন অফুরন্ত সময় হাতে থাকলেও দলের কাজে ব্রাত্য । অপমান, জ্বালা বুকে নিয়েই সুধাংশু বাবু দল পার্টি অফিস ছাড়লেন, ওমুখো আর হননি কোনদিন।
এই বয়সে ধর্ম, কর্ম নিয়ে থাকার কথা কিন্তু সুধাংশু বাবুর ধর্মের প্রতি অতটা টান নেই। একেবারে অবিশ্বাস করেন তা নয়; তবে আস্তিকতাবাদেও ঘোরতর আসত্তি দেখা যায় না। পাড়া ছেলে ছোকরারদল ধর্মীয় কাজে চাঁদা নিতে এলে সামর্থানুসারে সাহায্য করেও থাকেন। তিনি বলেন, এটা সামাজিকতা। সমাজে পাঁচজনের সাথে থাকতে হলে একটু এদিক ওদিক করতেই হয়।
নিচু এলাকা হওয়ায় বাঁধের অতিরিক্ত জল ছাড়লেই ফি বছর বন্যা হয়ে ঘরবাড়ি, ফসল, গবাদি পশুর হানি ঘটে। লাগাতার সপ্তাহ খানেক জল তো জমেই থাকে, যদি না অনবরত বৃষ্টি হয়। আকাশের বুক চিরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি পড়লে তো কথাই নেই। বড় বড় বাঁধ থেকে অতর্কিতে জল ছেড়ে দেওয়া হয়।
ঘোষণা হতে না হতেই এলাকাকে প্লাবিত করে জল বহে যায়। এইসব দিনে পাড়ার ছেলে ছোকরাদের নিয়ে ত্রাণ কাজে নেমে পড়তেন। এই বয়সে সেরকম ছোটাছুটি করতে না পারলেও ছেলেদের অর্থ দিয়ে উৎসাহ জুগিয়ে থাকেন। গ্রামের উচ্চ বিদ্যালয়ে আশ্রয় দেওয়া হয় নাবি এলাকার বসতিদের। কয়েকদিন ধরে পাকশালা বানিয়ে খিচুড়ি রান্না করে বিতরণ করা হয়। অসহায় শিশুদের বেবি ফুডেরও ব্যবস্থা থাকে। অবশ্যি জলস্তর নেমে যেতেই চারিদিকে মহামারী যাতে না ছড়ায় সেদিকে লক্ষ রেখে চুন, ব্লিচিং পাউডার,ও আর এস, কৃমিনাশক অ্যালবেন্ডাজোল ট্যাবলেট, প্যারাসিটামল ৬৫০ ট্যাবলেট বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দিতে দেওয়া হয়।
বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি শুনতে পান নানানজনের গুঞ্জন। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন। স্মার্টফোনের মাধ্যমে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে ‘ম্যানমেড’ বন্যার কথা। তিনি কতদিন থেকে শুনেছেন ওই একটাই কথা। একজন আরেকজনকে দোষারোপ করে নিজের দায়িত্ব ঘাড় থেকে ঝেড়ে ফেলার ফন্দি। এই শেষ মুহূর্তে, শয্যাগত হয়ে সেই অতীত দিনের কথা মনে আসে বারবার। অনেক কিছু করার ইচ্ছে জাগে মনে, কিন্তু সামর্থ্য তার কতটুকু। এই আছে, এই নেই। শ্বাস ফুরোলেই আশ শেষ।
— একটু জল দিই! জল খাবে? পাশে বসে থাকা গিন্নি জিজ্ঞেস করে।
— জল দেবে? একটু দাও। জীবনটা একটু ঠাণ্ডা হোক।
বিড়বিড় করে অনুচ্চারিত স্বরে উত্তর দেন সুধাংশু বাবু।
তিন
ছেলেটার জন্য মনে বড় চিন্তা তাঁর। একমাত্র সন্তান লেখাপড়া শিখেও কোন কাজ জোগাড় করতে পারছে না। চারিদিকে বেকারের ছড়াছড়ি, কাজের বড় অভাব। পুঁজির দাপটে সাধারণ মানুষ দিশেহারা, ব্যবসাও ভাল চলছে না। এদিকে দুর্নীতিতে ভরে গেছে গোটা সমাজ। যেখানেই যাবে সেখানেই দুর্নীতির আখড়া। ছোট দুর্নীতিকে সমর্থন মরতে গিয়ে আরও একটা বড় দুর্নীতি তার কাঁধে চেপে বসে ।
— বাবা কিছু টাকা দিতে পারো, তাহলে একটা কিছু করা যেত।
— কি করবি বল? ব্যবসাপাতির বাজার ঢলঢলে। মাৎস্যন্যায় চলছে। ছোট ছোট পুঁজি, বড় পুঁজির পেটে চলে যাচ্ছে। রাঘব বোয়াল হাঁ করে আছে চারিদিকে।
বাবার কিছু অর্থ নিয়ে ছোট্ট একটা ব্যবস্থা শুরু করে ছেলে। বছর যেতে না যেতেই পুঁজি গায়েব। দিন দিন জিনিসের মূল্য ক্রমবর্ধমান। লগ্নিপূজিতে খেয়ে ফেলে লাভের অংক। অগত্যা ছেলে বাবার হাতে ব্যবসা তুলে দিয়ে ভিন রাজ্যে চলে যায় কাজের সন্ধানে। পরিযায়ী শ্রমিক জীবনও বড্ড যন্ত্রণাদায়ক। আগের মতো আর এ দেশ নেই। তীব্র জাতি-বিদ্বেষ আর উগ্র প্রাদেশিকতাবাদ মানুষকে অমানুষ করে তুলছে। সেই কাজে গিয়েও অনেকের জীবন চলে যাচ্ছে রোষের কারণে।
জমির মায়া যে বড্ড টানে সুধাংশু বাবুকে। সাত পুরুষের গায়ে ঘাম ঝরিয়ে যে জমি তৈরি, তার টান যে নাড়ীর টান। যৌবনকালে এক হাতে জমি, শিক্ষকতা আর রাজনীতি সামলেছেন সব্যসাচীর মতো। প্রতিদিন ভোরবেলায় উঠে সারাটা মাঠ এক চক্কর না দিয়ে জল খাবার খেতেন না। জমি তাঁকে যে বড় ডাকে। জমি তাঁর মা। মা যেমন দুহাত দিয়ে ছেলের গলা চেপে ধরে, আদরে আদরে গাল, ঠোঁট ভরে তোলে, তেমনি মাঠের ফসলগুলোও হাত বাড়িয়ে আহ্বান করে এক শিক্ষককে। শিশির ভেজা ভোরের আলো এসে লাগে গায়ে, শরীরে। ধানের শীষগুলো হাত বাড়িয়ে দেয় মালিকের দিকে। ভালোবাসার হাত। বিশ্বাসের হাত। আদরের হাত। হাত ছুঁয়ে ছুঁয়ে আশীর্বাদ করেন তিনি। এরা যে তাঁর আপন আত্মজ। মাটির সোঁদা গন্ধ আর বাতাসের স্নিগ্ধতা তাঁকে করে মোহিত।
কর্মজীবন থেকে অবসর নেওয়ার পর, একদিন গিন্নি এসে বলে, হা গা, এতদিন তো পার্টি পার্টি করে সময় কাটালে কি পেলে? পার্টিই শেষ পর্যন্ত গলা ধাক্কা দিয়ে তাড়িয়ে দিল।
— সত্যিই তো, এতদিন ঘর সংসার কিছুই দেখেননি। গিন্নির খোঁচা খেয়ে মনটা ভীষণ খারাপ হয়।
বলেন, সত্যিই তো! এতদিন সংসারের কিছুই সেভাবে দেখা হয়নি। সংসারের সবকিছুর দায়িত্ব কিরসানের ঘাড়ে চড়িয়ে এসেছেন।
গিন্নিকে বলতেন, আর বলো না গো, সময় তো মানুষের দাস। সময় যেমন অসুখের আরোগ্য করে, তেমনি সময়কে ঠিকমতো কাজে না লাগাতে পারলে, সময়ও বিদ্রোহ করে। ধরে নাও, এটাও তাই।
গিন্নি চুপ করে থাকে। সেসব কথা আজ মনে এলে তাঁর মন বিষাদে ভরে যায়। সময় বড় মধুর, আবার সময় বড় নিষ্ঠুর। সময় মানুষকে সচেতনও করে। আয়নার সামনে দাঁড়ালে চেহারার পরিবর্তন নিয়ত হতে দেখা যায়। এটাই তো সময়ের নিয়ম। সময় নদীর স্রোতের মতো যেমন থেমে থাকে না,তরতর গতিতে এগিয়ে যায় অনির্দিষ্ট গন্তব্যের দিকে।
চার
অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে চলেছে সমাজ। সামাজিক কাজকর্ম কেমন যেন ছন্নছাড়া। চারিদিকে হতাশা আর বিষাদের ছায়া। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে শুয়েই সুধাংশু বাবু শুনতে পান তীব্র জনরোষের কথা। কোথায় একজন ডাক্তারকে ধর্ষণ করে খুন করেছে একদল লোভী মানুষের দল। চেপে রাখা ক্রোধ জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। তবে কতদিন এই তীব্রতা থাকবে? আন্দোলন তো সময়ের ঘড়ির কাটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে। এই আগুনের উত্তাপ একসময় নিরুত্তাপ হয়ে হিম হয়ে যাবে। কোথায় থাকবে এই জ্বলন্ত আগুনের আঁচ? তীব্র আন্দোলন যাকে বলা হয়, সেটাও একসময় তীব্রতা হারিয়ে নিষ্প্রভ হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
বিচার চাই। উই ওয়ান্ট জাস্টিস। জাস্টিস। এই কলরব কতক্ষণ জোরালো হয়ে টিকে থাকবে। তাঁর মনেও তীব্র সন্দেহ। এই আন্দোলন থামার সাথে সাথে একদলকে অশান্তির আগুনে পুড়তে হবে। তাদের পেছনে দাঁড়াবার কোন লোক থাকবে না। রাষ্ট্রশক্তি তাদের কণ্ঠরোধ করবে, এটাই তো রাষ্ট্রের চরিত্র। এসব ভালোভাবেই বোঝেন সুধাংশু বাবু। তাঁর মনে একটুকরো শান্তির বাতাস ছুঁয়ে যায়। তবুও তো কিছু মানুষ অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাহস পাচ্ছে। ইতিহাস তো সেই নিদর্শন জানিয়ে দেয়। রাজশক্তি কিভাবে রাজ-বিদ্রোহীদের কণ্ঠরোধ করত। খুনের ইতিহাস অতীত। প্রাচীন কায়েমি শক্তি বরাবরই দ্রোহ শক্তিকে চেপে ধরেছে। আগামীতেও সেটাই হবে। না হলে, ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটবে কেমন করে। প্রশ্নগুলো নিজের মনকেই করেন।
আকাশে সাদা সাদা মেঘের দল উড়ে বেড়ায় এদিক-ওদিক। শরতের এই শুভ্র প্রভাতে নীল আকাশে আগমনীর সুর আসছে ভেসে। কাশের সাদা সাদা ফুল, মাথা দুলিয়ে শরতকে আহবান করছে। পদ্ম পাতার ফাঁক দিয়ে পদ্মফুল ফুটে রয়েছে রং-বেরঙের। পদ্মের সৌন্দর্য আর মায়া-বাতাস প্রকৃতির বুকে এক নতুনত্বের সৃষ্টি করে। মা আসছেন। অসুর দমন করতেই আসছেন, তখনই সত্যিকার মানুষাসুর বধ হবে। সুধাংশু বাবুর মনে তবুও বড় আশঙ্কা। যে আন্দোলন ছড়িয়ে ছিটিয়ে উঠছে,উড়ে বেড়াচ্ছে আকাশে বাতাসে এর পরিণতি কি হবে? সত্যিই কি নির্যাতিতা নারী, নিহতা আত্মজারা ন্যায়বিচার পায়? — হাজার প্রশ্ন তাঁর মনের ভেতর কিলবিল করে। তাঁর দৃঢ় ধারণা যে, এ আন্দোলন এক সময়ে স্তিমিত হয়ে পড়বে। ন্যায়ের আদালতে হয়ত অন্যায়ের বিচার হবে না। অর্থশক্তি চেপে ধরবে সত্যকে। বিচারের উত্তর হবে, লস জাস্টিস।
তাহলে? তাহলে কী আন্দোলন-টান্দোলন করা বৃথা যাবে। না, আন্দোলন বৃথা হয় না। এর উত্তরও সময় ঠিক করে দেয়। একদিন এই আন্দোলনের মাতৃগর্ভে জন্ম নেয় নতুন আলোর দিশা। আলো-কে দাবিয়ে রাখা যায় না। অন্ধকারে বন্দী রাখা যায় না। সুযোগ মতো সময়ের স্রোতে প্রস্ফুটিত হয়ে উঠে পদ্মফুলের মতো। এই পদ্ম ফুলের পাপড়ি মেলার পথ ধরে জেগে উঠবে নতুন সভ্যতা নতুন দিন। ভোরের বাতাসে শিশিরের গন্ধ। ঝুঁঝকি আলোর মায়াজালে মায়াময় পৃথিবীর দৃশ্যসমূহ সূত্রে জড়ানো। এই সময়ে ভোরের পাখি ডেকে ওঠে, নতুন সূচনা ঘোষণা করে।
টুপটাপ বৃষ্টি পড়ছে। অকাল বর্ষণে ছেদ কাটছে প্রকৃতির কার্যকলাপ। বাতাসে সানাইয়ের শব্দ ভেসে আসছে উদোম গতিতে। সুধাংশু বাবু একটা হেঁচকা টান দিয়ে জোরে নিঃশ্বাস টানলেন। স্তব্ধ চারিদিক। মায়া সংসার উড়ে চলেছ এক বৃদ্ধের মনের ওপর দিয়ে। বৃদ্ধের দেহে একটা মৃদু কম্পন ছড়িয়ে পড়ল বেহালার ছড়ের মতন। ঘরখানা কেঁপে কেঁপে উঠে ঘরখানা। সময়ই তো শেষ কথা বলে।
[Read Kahini Bengali Book Online]
কারবালার যুদ্ধ [Karbalar Juddho | Karbala Jung]
এক
পশ্চিম আকাশে সরু কাস্তের মতো চাঁদ উঠেছে। এই দিন কয়েকের চাঁদই মহরমের চাঁদ।দখিন পাড়ার একদল শিশু কিশোর ঝাঁক বেঁধে মর্সিয়া গেয়ে ধান,চাল, টাকাকড়ি যা দিচ্ছে তাই নিয়ে কোচরে রাখছে। এইসব দ্রব্য সামগ্রী বিক্রি বাটা করে হরবছরের মতো ইবারও পবিত্র জালসা মোবারক করা হবে। সিন্নি হবে চিকেন বিরিয়ানি। জৌলুসে ভরে উঠবে একটা ঝলমলে দিন। একবুক আশা নিয়ে কচিকাঁচারদল সুরে বেসুরে, মর্সিয়া গেয়ে চলেছে এক গেরাম থেকে আরেক গেরামে।
উত্তরপাড়ার মসজিদের পাশেই দরগাহতলা। সেখানে মহরম মাসের ১০ তারিখে আশুরার দিনে গাঁয়ের মেয়েরা সেদুয়া পুকুরে স্নান করে ভিজে কাপড়ে মাটির ঘোড়া আর সিন্নি দিয়ে যায়। মাজারের খাদেম হেকমত শেখ সেজেগুজে বসে সিন্নি গ্রহণ করে। জমানো সিন্নির অর্ধেকটা লোকদের বিতরণ ক’রে বাকিটা গামছায় বেঁধে ঘরে নিয়ে যায়। ওই সন্ধ্যের সময় মেয়েরা প্রদীপ হাতে নিয়ে আসে। মাটির তৈরি প্রদীপে সর্ষের তেল দিয়ে ছেঁড়া ন্যাকড়ার পলতে বানিয়ে দরগাহতলার মাজারে দীপ জ্বালে। কারবালার ময়দানে হাসেন হোসেনের বংশধর এইদিনে শাহাদাত বরণ করে। তাঁদের স্মরণে ওই দিন মুসলিম সমাজে শোক পালন করা হয়। গাঁয়ের সমস্ত লোকজন খিচুড়ি রান্না করে খাওয়াদাওয়া করে। খিচুড়ির সাথে মাটন, চিকেন যে যার সামর্থ্য মতো আহারের ব্যবস্থা করে থাকে।
— কি কোরছো হে, আফিয়ার মা,ধরো,ধরো, সিন্নির গামছাখ্যান ধরো। বলে, তাড়া দেয় হেকমত।
— আ মলো! মিনসে এসেই ক্যামুন চিল্লাচিল্লি শুরু করি দ্যায়ছে। বুলি কি, ওরকুম খেপা ষাঁড়ের মুতুন এ্যাতো হুকড়াছো ক্যানে? তুমার কি রৌ উঠ্যাছে?
— হ, হ উঠ্যাছে তো। দ্যাখো, দ্যাখো অ্যাজ কত্ত সিন্নি পইড়্যাছে লিজের চোখে দ্যাখো। তাও তো অ্যাজক্যাল মানুষ গুল্যান ক্যামুন বেধম্মী হুঙ যেছে । এইটুকুন ছুটো এ্যাকখ্যান গেরাম। মাত্তর এ্যাই রূপুষপুর গাঁয়ে শো দুয়েক ঘর। লোকজুন বড়োজোর হাজার, বারোশো হোবে। এ্যার মধ্যি দু ফেরকা। ই-দল বোলে হামরা আসল, খাঁটি, ওরা জাহান্নামী। ওরা বোলে হামরাই আসল তরিকায় আছিনু, ওরাই দোজোখে পুড়্যা মোরবে।
রান্নাঘর থেকে আফিয়ার মা আসমানী বিবি কাপড়ের ট্যারে হাত মুছতে মুছতে বেরিয়ে আসে, বলে, কি বুলছো গো? ইব্বার জান খুলি বুলো।
— বিবিজানের এ্যাতোখুনে সমুয় হোলো। দ্যাখো, দ্যাখো, অ্যাজ কত্ত সিন্নি প্যায়াছি। সভাইকে দিঙ্ থুঙ্ সবকটাকে গামছায় বেঁধি নিঙ্ এল্যাম। বলে হেকমত গামছাটা বাড়িয়ে দেয় আসমানী বিবির দিকে।
— সিন্নি না হাতি। শুধু চিনি, খুরমা, বাস্সা দিঙ্ খালাস। মাঝেমধ্যে অসোগোল্লা খেতি কার মুন লাগে না বুলো। অতে কি প্যাট ভোরবে। বরঙচো যদি টাকা দ্যায় তাও কাজে লাগে। বুঝল্যা? প্রশ্ন ছুঁড়ে মারে খাদিমের দিকে।
— হ্, হ্, সব বুঝ্যাছি, সব। সাঁঝের বেলায় গাঁয়ের ম্যায়াগুল্যান অ্যাসবে। ওরা কেহু কেহু টাকা পায়সাও দিবে, বুঝ্যাছো। বলে আশ্বাস দেয় হিকু।
— হু, বুঝ্যাছি, দ্যাও তাড়াতাড়ি ঘরে রেখি এ্যাসি। এদিকে চুল্যার দাগি পুড়ি কইল্যা হুয়ে য্যাবে।
তুমি ওই দিকেই তাকাঙ্ থাকো। কখুন সাকিনা নাচবে, তখুন মধু ঝরবে। মুখ ঝামটা দিয়ে আসমানী বিবি বলে।
আরো বলে, দ্যাও, দ্যাও। ও গুল্যান যতনু করি রেখি দিমু, রেতের দিকে টুক করি অতুনকাকুর দুকানে দিঙ্ অ্যাসব্যা। দেখব্যা, কেহু যেনু দেখতি না পায়। যা পাওয়া যায়, তাতেই কম কীসের। একটু একটু করি জমায় সাগোর তৈয়ার হয়, পাহাড় গড়ে, বুঝ্যাছো। এতো সিন্নি ঘরে থুলে পিঁপড়াতে খ্যাবে। কুনু কাজেটাজে লাগবে না।
হেকমতের হাত থেকে বাজপাখির মতো ছোঁ মেরে সিন্নির গামছাখানাকে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকে আসমানী। ঘরের ভেতর উইএ খাওয়া একখানা কাঠের আলমারির ভিতরে রেখে দেয়। আলমারির ভিতরে রেখে হাত বের করে উল্টো দিকে ঘুরতেই দেখে হেকমত লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। একটা ক্ষুধার্ত বাঘ কতদিন আহার না পেয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে আছে। চোখের সামনের শিকার দেখতে পেয়ে সে কিছুতেই হাতছাড়া করতে চায় না। ওর ঘোরালো চোখের দিকে তাকিয়ে আসমানী বুঝতে পারে, ওর বুকে এক ভয়ংকর ঝড় বইছে, এখুনি না সামলাতে পারলে লণ্ডভণ্ড কিছু একটা ঘটে যাবে।
হেকমতের কুমতলব বুঝতে পেরে আসমানী নিজেকে সাবধানী করে তোলে। জোরে জোরেই হাঁক ছেড়ে বলে, সরো, সরো। এখুনো রান্নাবান্না করা হয়নি। আমাকে ছাড়ো। ততক্ষণে হেকমত রীতিমতো আসমানীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। আলোআঁধারিতে একটা যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, ঘরে ঝিম মেরে থাকা বাতাস চোখমুখ ঢেকে ঘরে থেকে বেরিয়ে পড়তে পারলে বাঁচে। লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে যায় ওর। আসমানী রীতিমতো শরীরের জোর খাটিয়ে তার লম্বা হাত দুটো ছাড়িয়ে দেয় গতর থেকে।
— ছি,ছি। সমুয়, অসমুয় বলি তুমার জ্ঞান ন্যাই দেখছি। যখুন তখুন বুললেই হলো, এর লেগি অন্যজুনারও ইচ্ছার দরকার, বুঝ্যাছো?
আসমানীর হিংস্র চোখের চাহনি দেখে হেকমত দুহাত পিছনে সরে দাঁড়ায়। মনে ক্ষুধার তাড়না যতই তীব্র হোক না, বাঘিনীর দিকে এগিয়ে যেতে তার সাহস হয়না। ঝিমিয়ে পড়ে, চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
গর্জন করে আসমানী বলে, অ্যাজ না,শোকের দিন। আশুরাবার, মহরমের দিন। মুছলমানের দুঃখু শুকুর দিন। এদিন কারবালার মাঠে হোসেন ও তার পরিবারের লোকজন শহীদ হুয়ছিল। তুমার শক তো দেখছি উথল্যাই উঠছে। না-পাক শরিলে বুঝি দরগাহ শরীপে য্যাবা। চারিদিকে শোকের ছায়া। আর তুমার রস উথল্যাই উঠছে।
লজ্জা পেয়ে হেকমত নিজের ভুল বুঝতে পারে। সত্যিই তো, সে এতক্ষণ কী করতে যাচ্ছিল।দিন,অদিন বুলি কতা। ভাল মুন্দ বলি দিন আছে তো।
দুই
ফোরাত নদীর তীরে মোয়াবিয়ার পুত্র ইয়াজিদের সাথে হাসেন হোসাইনের অসম যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে এজিদ বাহিনী এক প্রকার হোসেনের দলকে খতম করে। মায়মুনা দাসীর সহায়তায় হাসেনকে বিষ খাইয়ে কৌশলে খুন করে এজিদ। এই লড়াই নিছক বংশগত লড়াই ছিল না, এ লড়াই ছিল খলিফা পদের লড়াই। হযরত আলীর মৃত্যুর পর উমাইয়া বংশের মুয়াবিয়া খলিফা হতে চেয়েছিল। কিন্তু জনগণ তাকে খলিফা হিসেবে মানতে রাজি না হওয়ায় মুয়াবিয়া তার পুত্র এজিদকে খলিফা করতে চায়। কুফাবাসী এজিদকে খলিফা মানতে রাজি নয়, কিন্তু এজিদ এক ঘৃণ্য রণকৌশলের নীতি প্রয়োগ করে হোসেনকে খুন করে এবং খলিফা হতে চায়।
রাজসিংহাসনে বসার জন্যই এই লড়াই। সাম্য-অসাম্যের লড়াই। ধর্ম-অধর্মের লড়াই। ন্যায়-অন্যায় বোধের লড়াই। এজিদ এই বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হতে চায়, অন্যদিকে কুফাবাসী এজিদের অত্যাচারে অত্যাচারিত হয়ে তাঁরা হোসেনকে আমন্ত্রণ জানায়। সেই আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে হোসেন সপরিবারে কুফা গমন করেন। পথিমধ্যে এজিদের বাহিনী চতুর্দিকে তাঁদের ঘিরে ফেলে।
এক বিশাল প্রান্তরে তাঁরা তাবু খাটিয়ে অপেক্ষা করে এবং হোসেন যখন জানতে পারে যে, এটা কারবালার প্রান্তর; তখন তাঁর নানাজির কথা মনে পড়ে এবং এখানেই যে তাঁর নিয়তির লিখনে শোচনীয় পরাজয় হবে, তা তিনি উপলব্ধি করেন। শত্রুপক্ষ তাঁদের ঘিরে ফেলার সাথে সাথে পানীয় জল বন্ধ করে দেয়, ফোরাত নদীতে সৈন্য মোতায়েন করে এবং তৃষ্ণার্ত পরিবারের সদস্যরা একে একে শত্রুপক্ষের তীরে আহত হয়ে শাহাদাত বরণ করেন। আলী আকবর, আলী আসগার, জয়নাল আবেদিন, সাকিনা বিবি, জয়নব বেগম সকলকেই খুন করা হয়।
আকাশে তেজস্বী সূর্যের আলো। চারদিকের গাছপালা, লতাপাতা রোদের তেজে সিজে যাচ্ছে। আরবের বুকে বইছে উষ্ণ লু-বাতাস, লু-এর কবলে পড়ে মানুষজন পিপাসার্ত ও ক্ষুধার্ত। ফোরাত নদীর দুই পাড়ে শত্রু পক্ষের সৈন্য মোতায়েন করে পাহারা দিচ্ছে। হোসেন তিনটি শর্ত দিলেও এজিদ বাহিনী তা মানতে নারাজ। এই সময়ে হোসেন তৃষ্ণার্ত পরিবারের সদস্যদের জন্য এক মশক পানি আনতে ফোরাত নদীর জলে নেমে পড়ে, এক আঁজলা পানি মুখে দিতে গিয়ে পুত্রদের করুণ মুখ দেখে হাত থেকে পানি ফেলে দেয়। পাড়ে এসে দাঁড়াতেই মল্ল যুদ্ধ শুরু হলে একে একে সকলেই পর্যুদস্ত হয়ে যায়। অবশেষে আসরের নামাজ আদায় করতে যেয়ে সিজদারত অবস্থায় সিমার আক্রমণ করে। সিমার আনন্দে আটখানা। তরোবারির এক কোপে দেহ থেকে শির পৃথক করে ফেলে। এবং হোসেন শাহাদাত বরণ করেন।
জানা যায় যে, হোসেনের শরীরে ৪৬টি আঘাত ও ৪৭ টি তীরের চিহ্ন ছিল। সিমার হোসেনের শির ধড় থেকে আলাদা করে তসতরিতে ঢেকে বাদশাহ ওয়াবাইদুল্লা দরবারে প্রেরণ করে। সেই খণ্ডিত মস্তক দেখে সকলেই আতঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং সঙ্গে সঙ্গে কুফায় দাফন করা হয়। এই মর্মান্তিক ঐতিহাসিক ঘটনা, সকরুণ কাহিনী মুছলমান সমাজ নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করে আসছে। এক নিষ্ঠুর, নিদারুণ শোক কাহিনী,তার আত্মত্যাগ, জাতির প্রতি মহানুভবতাকে সম্মান জানিয়ে মুছলমান সমাজ আজকেও শোকবরণের মধ্যে আশুরার দিন অভুক্ত রেখে শ্রদ্ধা নিবেদন করে।
তিন
মর্সিয়া দলে একজন দলপতি থাকে। সে দলের মাস্টার হিসেবে পরিগণিত হয়ে দল পরিচালনা করে। তার নির্দেশ অন্য সদস্যরা যথাযথভাবে শোনে ও সকল নিয়মকানুন মান্য করে চলে। সেই দলের মাস্টার হলো মানসুর আলি। তারা দল বেঁধে চাঁদের পাঁচ তারিখ থেকে বাড়ি বাড়ি মর্সিয়া সুর করে গায়। সেই সুরে গেরাম, মাঠঘাট শোকে বিহ্বল ও মুহ্যমান হয়ে ওঠে। উতর পাড়ার দরগাহ শরীপে গিয়ে তেকোণা পতাকা তুলে মর্সিয়া গেয়ে সেলাম ঠুকে বের হয়। সারি বেঁধে দুই দল পরস্পরের দিকে মুখ করে মর্সিয়া গান শুরু করে।
হাতে একখানা খাতা নিয়ে মানসুর সুর তোলে,
আহা রে মহরমের চাঁদ,ক্যানে তুই উঠিলি
হোসেনের শিরখানা এজিদের কাছে পাটালি
এক আঁজলা পানির লেগি আলি আসগার মরিল
সাকিনা তুই বেধবা হলি, আবুল কাশেম শহীদ হইল
হায়রে ফোরাত নদী তুই একফোঁটা পানি না দিলি
আহা রে মহরমের চাঁদ ক্যানে তুই উঠিলি।
দুই দলের ছেলেরা দুই হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে ধ্বনি তোলে, দোহার কণ্ঠে, আহা রে মহরমের চাঁদ ক্যানে তুই উঠিলি, হায় হোসেন, হায় হাসেন, হায় হোসেন, হায় হাসেন।
আরবি সনের পহেলা মাস মহরমের মাস। মহরমের চাঁদ উঠলে গাঁয়ের এক শ্রেণীর মানুষ, আবালবৃদ্ধবনিতা শোকাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। রাতের বেলা লম্ফ জ্বেলে দিদিমারা, তাঁদের কচিকাঁচা সন্তানদের কারবালা যুদ্ধের করুণ কাহিনী শুনিয়ে ঘুম পাড়ায়। শিশুসন্তানেরা অবাক হয়ে সেই কাহানী শুনে। পরিণতির কথা শুনে ভীষণ ভীত ও আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। চুপচাপ ঘুমিয়ে পড়ে, বর্গী সংসদ এলো ঘরের মতোই।মহরমের চাঁদ দেখা গেলে ছেলেদের দল কাঁচা বাঁশ কেটে লাঠি বানায়। ঝাণ্ডি তৈরি করে। চারদিন ধরে রিহার্সাল চলে, তারপর মাঠে নামা। পঞ্চম থেকে দশম দিন পর্যন্ত গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে,বাড়ি বাড়ি থেকে সামগ্রী সংগ্রহ করে এবং সেই সংগৃহীত অর্থ দিয়ে বড় করে জালসা মেহফিল করা হয়ে থাকে। সেই জালসায় ভিন্ন জায়গা থেকে বড় আলেম আনা হয়।
মানসুর সেদিন তার দলবল নিয়ে পরিকল্পনা করছে এবারে বিক্রমগড়ের ফয়জাল মৌলানাকে আনা হবে।সেই পরিকল্পনা করে তারা। স্কুলের মাঠে ত্রিপল বিছিয়ে এমার্জেন্সি লাইট জেলে তাদের আলোচনা হয়। প্রথমে প্রস্তাব দেয় রমজান। রমজান বলে, আলী ভাই এবারও না হয় ফয়জাল মাওলানাকে আনা হোক। ওর নামডাকটা খুব বেশি। ওকে আনতে পারলে লোকে লোকারণ্য হয়ে যাবে। রমজানের প্রস্তাব শুনে মানসুর একে একে সকলের বক্তব্য শুনতে চায়। তখন সকলেই হাত তুলে সম্মতি জানায়। এক কোণে বসে ছিল দিলবাহার, সে একটু আলগা গুছের ছেলে। সব কাজেই উত্তর দেওয়া তার স্বভাব। সে বলে ওঠে, আচ্ছা! ইবার ফয়জাল সাহেবকে বাদ দিয়ে আরশিনগরের মাওলানা হায়দার আলীকে আনা যায় না? সঙ্গে সঙ্গে জয়নাল উত্তর দেয়। ওরে বাপরে! ওর ভিজিট কতো জানিস, মিনিমাম দশ হাজার ,অত টাকা পাবো কুথায়?
— তা ঠিক বুলেছ। তবে হায়দার আলীর চাহিদা বেশি। একে তো প্রতিবছর আনি, এবার না হয় নতুন মুখ আনা যাক। ওকে আনতে পারলে ভিড়ে ছয়লাপ হয়ে যাবে।
— আচ্ছা দেখা যাক না, গাঁয়ের মোড়লকে জানিয়ে রাখি। ওরা যদি কিছু ডোনেশনের ব্যবস্থা করে দ্যায়। উনি আসলে ভালই তো হয়। মুকিত মাস্টার আছে, রিয়াজুল মাস্টার তো পাঁচ হাজার দেবে বুল্যাছে।
ইবার সকলেই চিৎকার করে বলে উঠল, হায়দার আলীকেই আনা চাই।
চার
হাই ইস্কুলের মাঠ। মাঠের উত্তর দিকে ম্যারাপ বেঁধে পনেরো বাই বারো ফুটের মঞ্চ বানানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে তুষারকে। ওর নিজস্ব প্যাণ্ডেল আছে, পয়সা কিছু কম নেবে। তুষার যত্ন করে জমকালো মঞ্চ বানিয়ে ফেলেছে। ইস্কুলে ঢুকার মুখে খুব সুন্দর পরিপাটি করে গেট তৈরি করা হয়েছে।মঞ্চে হরেক কিসিমের আলোর লাইট লাগানো হয়েছে। দুটো হ্যালোজেন বসানো হয়েছে মঞ্চের দুপাশে। আলোয় আলোকিত চারিদিক। মাটির উপর তিরপল আর ছেঁড়া চট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মাঝে বাঁশ বেঁধে মেয়েদের জন্য আলাদা বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাহী ব্যাপার। উপরে মাথায় তিরপলের আচ্ছাদন টাঙানো।
গাঁয়ের ছোটবুড়ো সকলেই আসতে শুরু করেছে। মাইকে কর্মকর্তার তরফ থেকে বারবার আহ্বান জানান হচ্ছে। মেয়েরা মঞ্চে উঠে কেউ কেউ গজল গাইছে। হেকমত মঞ্চের পাশে থেকেই সবকিছু তদারকি করছে। হঠাৎ রইসুদ্দি মাস্টারের মেয়ে, তাসমিনাকে দেখে হেকমত অবাক হয়। বলে, তুমি কার সাথে এস্যাছ মা মণি?
— হ্, দাদু, আমি আমার ভাই রজবের সাথে এস্যাছি।
— খুব ভালো বহিন। বেশ করাছো। তবে এদিকে ওদিকে যেও না ক্যামুন।
— ঠিক আছে। মাথা নেড়ে সম্মতি জানায় তাসমিনা।
— তুমার বাপ জানে?
— না, না। বাপ জানতে পারলে জিন্দা থুবে না।
পনেরো বছরের তাসমিনাকে নিয়ে রইসুদ্দি মাস্টারের খুব অহংকার। গাঁয়ের কোনো ছেলেমেয়ের সাথে মিশতে দেয় না। মুর্শিদাবাদের এক গার্ল মিশনে হোস্টেলে থেকে পড়াশুনা করে।মাসে ছ’মাসে ছুটিতে বাড়ি এলে ঘরবন্দী হয়ে থাকে। একবার তাসমিনাকে নিয়ে কি যে কাণ্ডকারখানা না ঘটেছিল। মঞ্চে সভাপতির আসন অলংকৃত করেছেন পীর মাওলানা গওসুল আজম নুর নবী সাহেব।তিনি ডুমুরজুড় হাই মাদ্রাসার হেড মুদারিস। একে একে মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন নামী-অনামী একাধিক ওলামায়ে একরাম। ওদিকে মাঠ ভরতি হয়ে গেছে,বসার ফাঁকফোকর নেই। লোকে গিজগিজ করছে মেহফিলে।
‘নারায়ে তকবির, নারায়ে ইসালাহ।’
মাইকে বারবার ঘোষিত হচ্ছে, ইব্যারে আসতেছেন পীরে পীর, কেবলা এ দস্তগীর আলহাজ্ব মাওলানা শেখ হায়দার আলী রিজভী সাহেব।
জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।
‘জিন্দাবাদ’ ধ্বনিতে চারদিক মুখরিত। মাইকের সামনে দাঁড়িয়ে মাওলানা। মুখভর্তি জাফরানি দাঁড়ি। ইয়া বড় জেব্বা,ঝুল পোশাক। দূর থেকে দেখলে মনে হচ্ছে আসমান থেকে হুর গেলেমান ধরায় নেমে এসেছে। মাইক হাতে নিয়ে বলেন, আস্ সাল্লামো আলাইকুম।
গোটা মজলিস থেকে উত্তর আসে, ওয়ালাইকুম ওয়াসাল্লাম।
শুরু হয়েছে ওয়াজ নসিহত। ইসলামী আহকাম আরকান নিয়ে বিশদ আলোচনা। দৈনন্দিন জীবনে কি কি কাজ করতে হবে,হারাম হালাল ইত্যাদি ইত্যাদি। একসময়ে মাওলানা সাহেব তুললেন, মুসলমানদের দুই মজহাবের প্রসঙ্গ। এই দুই দলের রেষারেষি, দ্বন্দ্ব চিরকালের। এরা ভাল, ওরা মন্দ, এসব কথা। কথা থেকে কুকথা বেরিয়ে আসে। আগুনে ঘি ঢেলে দিলে আগুন যেমন লকলক করে জ্বলে ওঠে, তেমনি মজলিসের একাংশ চিৎকার করে উঠল।
— আপনার ভাষুণ শুনতে এস্যাছি। ইসলামের কথা বলুন, দলটল, মজহাব টজহাব শুনতে এসিনি। ওসব বিভেদের কুতা বাদ দিয়া হাদিস কুরানের কতা বুলেন।
তিনি সমানে দুই দলের একে অপরের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথা বলতেই থাকেন। কথায় বলে, নিজের গুণ বিচারী, বিপক্ষের কু-আচারী। অকস্মাৎ মজলিসের মধ্য থেকে একখানা আধলা ইট এসে পড়ে মঞ্চে। মাইকের স্ট্যান্ড থাকায় ইট মাওলানা অবধি পৌঁছায়নি। তিনি চিৎকার করে উঠলেন, কে ওই নাস্তিক। ওই নাস্তিককে মজলিস থেকে বের করে দাও।
চারদিকে হৈ হট্টগোল শুরু হয়ে গেছে, রীতিমতো যুদ্ধ চলছে। এ যেন আর এক কারবালার যুদ্ধ। মাওলানা সাহেবকে একদল লোক ঘিরে ফেলেছে, চলছে কথা কাটাকাটি। ভিড় থেকে গালকাটা হিম্মত স্যাখ মঞ্চের উপর উঠে মাওলানার মাইক ডান হাতে ধরে চিৎকার করে, তুমাকে নাস্তিক পরমাণ কোরতে হোবে, না হলে তুমার একদিন কি হামার একদিন। ছেলেমেয়েরা যে যেদিকে পারছে দৌড়ে পালাচ্ছে, কে কার ঘাড়ে, মাথায় পা লাগিয়ে দৌড়াচ্ছে সে হিসেব নেই। চিৎকার, চেঁচামেচি ও কান্নার শব্দে ভরে গেছে মাঠ। এমন সময় এক জন ব্যক্তি চিৎকার করে উঠল,বলে তাসমিনাকে কুথা খুঁজি পাওয়া যেছে না।
[Read Kahini Bengali Book Online]
বাস্তুভিটা বিকিকিনি [Bastu Vita Bikikini]
আষাঢ় পেরিয়ে গেছে দিন কয়েক আগে। কাঠফাটা রোদে ঘাসগুলো পুড়ে হয়ে গেছে ন্যাবারোগে আক্রান্তের মতো। বৃষ্টির অভাবে চাষীদের আটকে পড়েছে চাষের কাজ। আকাশ ঝকঝকে তকতকে সাদা দাঁতের মতো চিকচিক করছে। মাঠঘাট করছে খাঁ খাঁ, পুকুরের পানিতে ছোট ছোট বিভিন্ন জাতের মাছ ছুটে বেড়াচ্ছে ইতিউতি। এক অগ্নিবলাকা তার লম্বা ঠোঁট নিয়ে মাছ ধরার অপেক্ষায় পুকুরের পানিতে ডোবানো লম্বা বাঁশের ডগায় বসে।
সবে শ্রাবণমাস এসে পড়েছে ঋতু চক্রের আয়নায়নে। এ বছর বৃষ্টিও কম। কোনো সরকারই এই অঞ্চলে কৃষির জন্য খাল কাটেনি। এলাকায় কোন ক্যানেল ট্যানেল নেই,তাই চাষের জল ঠিক মতো না-পাওয়ার কারণে চাষবাস ঠিক মতো হয়নি। অথচ কি মজার, সরকারী খাতায় উত্তর ময়ূরাক্ষী কেনেলভুক্ত হয়ে আছে সাতষট্টি থেকেই। ফলে চাষীদের কড়া গন্ডায় খাজনা গুনতে হচ্ছে হরবছরে।
মাঝে মাঝে চাষীদের মনে অসন্তোষ জেগে উঠে, প্রতিবাদের ভাষাও ধ্বনিত হয় এলাকায়। আমলা, মন্ত্রীনেতা-নেত্রীদের জানিয়ে কোন কাজের কাজ হয়নি, শুধুই মিলেছে আশ্বাস। ব্যস এতটুকুই, তারপর যে কে সেই। বিরোধী রাজনৈতিক দল বিভিন্ন সময়ে এই জ্বলন্ত ইস্যুকে সামনে রেখে জনরোষ সৃষ্টির অপূর্ব কৌশল হাতছাড়া করতে চায় না। ওদিকে শাসক দলের নেতা-নেত্রীদের মুখে কোন সদুত্তর মেলেনা, নেতাদের কথা শুনতে শুনতে সাধারণ মানুষের মনে বিদ্বেষ বিতৃষ্ণা জন্মে। তাঁরা বলে যে, নেতাদের গায়ের চামড়া গন্ডারের মতো শক্ত আর ভোঁতা হয়ে যাওয়ায় তাঁরাও কর্ণপাত করে না।
কথায় আছে, “যা বলবি বোল, কান করেছি ঢোল”।
বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতেই সেদিন এই এলাকায় পশ্চিম আকাশে নৈর্ঋত কোণে এক কালোমেঘের আগমন দেখে চাষীদের মনে স্বস্তির বাতাস বইতে শুরু করে। সন্ধের মুখে গুঁড়ি গুঁড়ি ইলশে গুঁড়ির মত হালকা বৃষ্টি ঝরতে শুরু করতেই পথে ঘাটে মানুষ উৎফুল্ল হয়ে উঠে । রুক্ষ শুষ্ক মাটির বুকে বর্ষার প্রথম ছাট এসে পড়ে। চাষীর বুক অপার আশার আনন্দে ভেসে যায়। বাতাসের জোরের সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টিও সমান তালে পড়ছে। পল্লী জীবনে সুখ ও স্বস্তির আশার আলো ফুটে উঠছে, উল্লাসে ভাসছে চাষীর বুক-সাগর। সকাল সকাল গোয়ালঘর থেকে হাল বলদ বের করে চাষিরা মাঠের দিকে চাষ করতে শুরু করবে। সারা বছরের মুখের খাবার, সোনালি ফসল ঘরে তুলে পরিবার এক সুখের মুখ দেখবে। আনন্দ সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায় হল্লাদের হৃদয়।
রিয়াদ চাচা তার ভাঙ্গা ময়ূরপঙ্খী রিক্সাখানা স্টেশনের গা ঘেঁষে লাগিয়ে রেখেছে একখানা পলিথিনের চাদর বিছিয়ে। রেকসিনের সিটখানা যাতে না ভেজে, তার জন্য যত্ন করে রেখেছে ঢেকে। যেমন নব্য প্রসূতি মা তার সদ্যোজাত সন্তানকে যেভাবে বুকের ভেতর আগলে রাখে, চাচাও তার রিক্সাখানাকে অতি যত্নে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচাতে এই প্রচেষ্টা চালিয়েছে।
বৃষ্টি বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই থামার কোন লক্ষণ নেই। সময় অনেকটা চলে গেছে তা কেও ঠাহর করতেই পারেনি। রাতের গাড়িও একটু দেরি করে এসেছে । হয়তো জল ঝড়ের জন্যই এমন বিপত্তি। মাঝে মাঝে মেঘের গর্জন আর বিদ্যুতের ঝলকানি তো চলছেই। আকাশের গায়ে কারা যেন মাঝে মাঝে মেঘের বুক চিরে লাল রক্তের ফোয়ারা বিদ্যুৎ রঙে ঝরিয়ে দিচ্ছে। ঘড়্ ঘড়্ ঘড়্ শব্দ করে অবশেষে আপ গাড়িখানি স্টেশনে এসে দাঁড়ালো।
গভীর অন্ধকার চারদিককে গ্রাস করে ফেলেছে, ঝড়ের তাণ্ডবে বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তার ছিঁড়ে পড়ে গেছে মাটিতে। এলাকায় বিদ্যুতের অভাব। লোডশেডিং চলছে কয়েকদিন থেকেই। এদিকে বিশেষতঃ মফস্বলে বিদ্যুৎ নিয়ে ভীষণ সমস্যা, সামান্য জল-ঝড় হলেই বিদ্যুৎ চলে যায়, দু-তিনদিন বিদ্যুতের দর্শন মেলে না। স্টেশন বাবু, তার ছোট্ট চারকোনা লন্ডনটি নিয়ে বেরিয়ে এলেন। কুলিরা দৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কোথাও যদি মালপত্র নামানো উঠানো যায়।
— এই যে ভাই, এ গাড়িখানা কার বলতে পারো?
কাশিমনগরী গামছাখানা গায়ে জড়িয়ে এক কোণে বসে ছিল রিয়াদ চাচা। বলে — কেনে। হামার রিক্সা আচে বাবু, কতি যাবেন?
— রঘুনাথপুর ।
— চেনো ভাই, যেতে পারবে?
— আরে বলেন কি বাবু ! হামি তো ওই গাঁয়েরই
— লোক আচি। কেনে য্যেতে পারবো না বলেন তো? কাহার বাড়ি য্যাবেন বাবু?
আকাশে যেন চাঁদ হেসে উঠলো, হাতঘড়ির দিকে চেয়ে দেখলো রাত সাড়ে দশটা। এ অসময়ে কোন যানবাহন পাওয়া যায় না। ভেবেছিলেন হয়তো বউকে নিয়ে রাতটা স্টেশনেই কাটিয়ে দিতে হবে। মনে মনে বলল, যাক, তবুও একটা হিল্লে হলো। তিমিরবাবুর বউ রজনী ম্যাডাম হেসে বলল, যাক বাবা, বাঁচা গেল! হাতের কাছেই গাড়ি পেয়ে গেলাম। কেউ যেন ইচ্ছে করে হাতের কাছে স্বর্গটাকে এনে দিয়েছে। রিক্সাওয়ালার দিকে চেয়ে বলল– সুরাজ মাস্টারের বাড়ি যাবো। চেনো তাকে? তার বাড়িতে আমাদের নিয়ে যেতে পারবে?
— বলেন কি দিদিমণি? হামি তো ওদের পাড়াতেই থাকি। ভোরবেলা ওদের বাড়িতেও যাই। খুব ভালো লোক আচে ওনারা।
তিমিরবাবু মুচকি হেসে ওঠে বলেন — বুঝলে রজনী তোমায় না বলেছিলাম সুরাজ মাস্টার খুব ভালো মানুষ। তার কাছে একবার পৌঁছাতে পারলেই আমাদের আর কোন সমস্যা থাকবে না। তিনি সমস্যার সমাধান করেই ছাড়বেন। রিয়াদ চাচা তাদের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। রিক্সাওয়ালার দিকে তাকিয়ে বাবু বলেন — তা কত ভাড়া লাগবে ভাই?
— তোবা তোবা, ভাড়ার কথা তুলবেন না বাবু, সুরাজ সাহেব শুনলে গোস্সা করবেন। তার বাড়ি নিঙে যাব, বেশি ভাড়া চাহিতে পারি।
— সেটা ঠিক, তবুও একটা চুক্তি থাকা ভালো। কি বলো রজনী?
রজনী মাথা নেড়ে বলে — ঠিক তাই। অনেকে তো এই সুযোগ নিয়ে অধিক চেয়ে বসে। তুমি ভালো মানুষ। তবুও ভাড়াটা পাকা করে নিতে চায়। পরে ঝামেলা করা ভাল কাজ নয়।
কোকিল কন্ঠী রজনী তার শাড়িখানায় হাত বুলিয়ে ঠিকঠাক করে নিচ্ছিল। এই সময় সরস কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ। আমরা কলকাতার লোক। তাই আগেভাগে ভাড়া ঠিক করে নিই। পরে বাবু ঝুট ঝামেলা হোক, এটা পছন্দ করি না।
— আরে তোবা, তোবা, এসব কুথা বুলবেন না দিদিমণি। হামরা গরিব হতে পারি, লেকিন বেইমান নেহি। বুঝলেন বাবু, ভাড়া হামি চাহিতেই পারবু না, হাপনারা যাহা দিবেন হামি তাই লিব।
— পঞ্চাশ টাকা দেব।
— বেশি বুললেন বাবু। হক কথা ভাড়া মাত্তর কুড়ি টাকা। তবে, সমুয়ে-অসমুয়ে, বেপদে-আপদে ভাড়া ডবল লাগে। তা আপনি যদি স্বেচ্ছায় দ্যান তাহুলে তাহি লিবো।
অন্ধকার ঘুটঘুটে রাস্তা। মুরারই-মহেশপুর ২৪৫ নঃ রোড দিয়ে পশ্চিম অভিমুখে চলতে শুরু করলো রিক্সা খানা। বৃষ্টির তেজ কমে গেলেও মাঝে মাঝে বৃষ্টির ছাট আসছে। পলিথিনের চাদরখানা জড়িয়ে মাথার হুড তুলে খানিকটা নিরাপদে বসে রয়েছে দম্পতি। রিয়াদ তার পাতলা গামছাখানা মাথায় জড়িয়ে আধোজলে ভিজতে ভিজতে সেই গায়ের দিকেই এগিয়ে চলেছে ভাঙাচোরা রাস্তার উপর দিয়ে । সামনের দিকের ছোট্ট লম্ফোটা হেডলাইটে ঝুলিয়ে দেওয়া আছে, এতে হয়তো পথ দেখা যাবে না সত্যি;কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আসা কোন যানবাহন হঠাৎ করে ধাক্কা মারতে পারবে না। রজনী চাচার দিকে লক্ষ্য করে অন্ধকারে শব্দ ছুঁড়ে দেয়, বলে- সুরাজ মাস্টার কেমন লোক গো?
— খুব ভালো লোক।
— জানেন দিদি, ওরা একদিন খুব গরিব ছিল।
— কিন্তু এখন কিছুটা সচ্ছল। তিন ভাই ওরা। হঠাৎ করে একদিন ওদের বাবা ওদেরকে ছেড়ে চলি গেল। বড় ভাই সুরাজ লেখাপড়া ছেড়ে কাজের সন্ধানে চলে গেল বাহিরে। নাবালক ভাইদের লেখাপড়া শেখাতে তাদেরকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল।
— শুনেছি। এখন ওদের অবস্থাটা ভাল ।
— ভালই তো। এখন মোটামুটি ভালোই, কিছু জমি জমাও করাছে। সজ্জন লোক ছিল ওর বাবা। পরোপকারী।
— সবাই বলে, ওরা ওদের বাপের আশীর্বাদে মানুষ হয়্যাছে, জমি জায়গায় কিন্যাছে। টাকা পয়সাও বেশ করাছে। মেহনত করলে তো প্যায়সা হোবে দিদিমণি, হোবে না বলুন?
— খুব কৃপণ বুঝি? বলে রজনী।
— না, না, ওকে ওইসব মানায় না। ওর মতুন মানুষ আশেপাশের পাঁচটি গেরামে ন্যাই।
বাবু স্মিত হাসি হাসে, মনে মনে ভাবছে তাহলে তার দূর সম্পর্কের আত্মীয় যে বলেছিল, সুরাজ মাস্টার খুব পয়সাওয়ালা, যেমন দাম্ভিক তেমনি মেজাজি, মাস্টারি আর ডাক্তারির টাকায় দালানকোঠাও করেছে। তবে কি নিছক ঠাট্টা করে বলেছিল তার আত্মীয়। তিমিরবাবুর দাদুরা অনেকদিন আগেই গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় গিয়ে কাজ জুটিয়ে বসতি পাকা করে নেয়। বেশ অর্থবান হয়ে ওঠেন। কলকাতায় থেকে ওকালতি পেশা শুরু করে বেশ সচ্ছল হন ও প্রচুর টাকা রোজগার করেন। তাঁদের আর পেছন ফিরে তাকানোর ফুরসৎ নেই।
ঊনষাট,ষাট সাল। তখন গাঁয়ে ভয়ানক অভাব। মানুষের দুবেলা দুমুঠো ভাত জোটে না, ঠিক মত খাবার খেতে পায় না। “ফ্যান দাও,ভাত দাও” বলতে বলতে একদল মানুষ কলকাতায় গিয়ে বিক্ষোভ মিছিলও করে। পুলিশের গুলিতে কিছু প্রাণ চলে যায়। চারিদিকে খাবারের অভাব, না-খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে। গাঁয়ে-গঞ্জে সাধারণ মানুষ খেতে না পেয়ে গৃহস্থের বাড়িতে ঢুকে লুটপাট শুরু করে দিচ্ছে। হাঁড়ি বাটি সামনে যা পাচ্ছে, তাই চুরি করে নিয়ে পালাচ্ছে, বিক্রি করে যা মেলে, তাই দিয়ে দুবেলা আহার জোগাড় করে বাঁচতে চায়।
এই সময়ে মহেন্দ্র বাবু সপরিবারে কলকাতায় গিয়ে আশ্রয় নেয়। সেই যে গেলেন তো গেলেন, সাধ করে একদিনের জন্য হলেও গাঁয়ে ফিরে আসেননি। মারা যাওয়ার আগে একবার ভিটেখানা দেখে গিয়েছিলেন। তারপরই তিনি চলে যান পরপারে। সেও অনেক দিন আগের কথা। মহেন্দ্র বাবুর ছেলে সৌমেন্দ্র সরকারি অফিসে চাকরি করেন। তিনিও কোনদিন বাপের ভিটেয় পা মাড়াননি। কিছুদিন আগে বাবার মৃত্যু হলে, সৌমেন্দ্রবাবু সংসারের হাল ধরেন। পুত্র তিমির চাকরিবাকরি না পেয়ে ব্যবসার কাজে লেগে যায়। পুঁজির দাপটে ব্যবসা এখন লাটে উঠেছে। পয়সার বড় অভাব, তাই তার মনেও কোন শান্তি নেই। পুঁজি দিনদিন কমে যাচ্ছে ব্যবসায়। জিনিসপত্রের দামও আকাশছোঁয়া। এখন ব্যবসায় আরও বেশি বেশি করে পুঁজির দরকার।
এক অপরাহ্নে রজনীর বাবা পীযূষ বাবু মেয়ের বাড়িতে বেড়াতে আসেন। তিনি থাকেন বেহেলায়, দক্ষিণ কলকাতায়। বড় একখানা কাপড়ের দোকান চালান। বেশ ভালয় চলে। একমাত্র ছেলে সৌম্যজিৎ বিদেশে চাকরি করে। মাইনেও ভাল। বছরে একবার, পূজার সময় দেশে আসে। আত্মীয় স্বজনদের দেখা-সাক্ষাৎ করে ফিরে যায়।
— কী গো, বাবাধন, ব্যবসাপাতি চলছে কেমন?
তিমির জবাব দেয় — খুব ভালো চলছে না। পূঁজি দিনদিন কমে যাচ্ছে, কম্পিটিশনের বাজারে ভাল চলছে না। পুঁজি আরও লাগাতে হবে।
— হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক। পুঁজি না থাকলে ব্যবসাপাতি ভালো চলে না।
— ভাবছি এবারে দেশের বাড়িখানা বেচে দেব।কিছু টাকা পেলে ব্যবসাটা জোরদার হবে।
— ঠিক, ঠিক। বেয়াই মশাই তো বেঁচে থাকতে দেশের বাড়িখানা বিক্রি করতে রাজি হননি।
— তাছাড়া, দ্যাখ, ওখানে বাড়িঘর থেকে কোন লাভ নেই, বরং ওই টাকা দিয়ে এখানে ব্যবসা করলে কিছু লাভ পাওয়া যাবে।
এক দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের মাধ্যমে সুরাজ মাস্টারের সাথে তাঁদের বোঝাপড়া । বাড়িটি বিক্রি করে দেওয়ার প্রাথমিক কথাবার্তা সেরেই ফেলেছে। দেশের বাড়িতে গিয়ে কাগজপত্র দেখে মূল্যটা চূড়ান্ত করাটাই কেবলমাত্র বাকি।
— এই যি বাবু, এ্যসি গেলছি। ইবার নামতে পারেন। ওই যি দিখছেন লম্বা দোতলা বাড়ি, ওখানেই সুরাজ মাস্টার থাকে।
বাড়ির হতশ্রী দশা দেখে খানিকটা অবাক হয়ে যায় তিমির। কোথায় সেই রাজপ্রাসাদ,আর কোথায় তার সম্রাট! এ যে ছোট্ট একখানা চালার বাড়ি। ইট দিয়ে দেওয়াল বানানো, ওপরে খড়ের ছাউনি। তবে কি ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। মনে মনে সার্ভে করে নেয় তিমির বাবু। জিগ্যেস করে — তুমি কি আমাদের ঠিক জায়গায় নিয়ে এসেছ?
রিয়াদ বলে — ক্যানে বাবু! ই টো তো সুরাজ মাস্টারের বাড়ি। কুনু ভুলটুল তো হয়নি।
— তোমারদের সুরাজ মাস্টার তো মাস্টারের সাথে সাথেই একজন কোয়াক ডাক্তারও।
— না তো, না-তো বাবু। ইনি তো ডাক্তোরি কোরে না। ভালো জামা কাটতে পারে। অনেক দূর থেকে লোকজন তার কাছে জামা-কাপড় সেলাই করতে আসে। এলাকায় সুরাজ মাস্টার বুলতে একবাক্যে একেই চেনে। এ গাঁয়ে তো আর কুনো মাস্টার ন্যাই।
রজনী বলে — তবে কি ভুল জায়গায় এসেছি?
— হাপনারা তো অঘনাতপুরের সুরাজ মাস্টারের বাড়ি আসতে চাহিলেন দিদি। ইনি একজন খুব ভালো নোক গো,,
দুচোখ কপালে তুলে তিমিরবাবু তার বউ রজনীকে বলে — আমরা অন্য জায়গায় এসে পড়েছি। এখন রাত সাড়ে এগারোটা। অন্ধকার ঘুটঘুটে রাত, মাথার উপর গুঁড়ি গুঁড়ি ইলশে বৃষ্টি। এখন কোথা যাই বলো তো?
— এখন কি হবে?
— বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ঠিক মত ঠিকানাটা বললে এই ভোগান্তি পোহাতে হতো না।
রিয়াদ বলে — আপনি তো আমাকে অঘনাতপুরের সুরাজ মাস্টারের কথা বুললেন। ই গাঁয়ে তো একটোই সুরাজ মাস্টার,আর কুনো ওই নামে সুরাজ মাস্টার ন্যাই।
তখনও মাথার উপর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ঝরেই চলছে। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎও চমকাচ্ছে। আলোর ঝলকানি দেখা দিচ্ছে কালো মেঘের ফাঁকে। এই সময়ে আর কোথাও যাওয়ার উপায় নেই। বিচলিত চোখে তিমিরবাবু বলেন –কোথায় এখন থাকব ? কাউকে তো চিনি না, জানিনা। অজানা অচেনা মানুষকে থাকতে কেই বা দেবে?
–কুছু ভাববেন না বাবু। সুরাজ মাস্টার খুব ভালো মানুষ। আজ ওর বাড়িতে রাতটা কাটিয়ে দেন। কাল ভোর ভোর আপনাদের ঝাড়খণ্ডের অঘনাতপুরে পৌঁছে দিব। পেরায় ইখান থেকি চার ক্রোশ দূরে।
অবশেষে নিরুপায় হয়ে তাঁরা দুজনেই রিক্সা থেকে নেমে আসে। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে মাথায় ধরে। জল থেকে বাঁচতে দুজনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়ায়। দরজায় টোকা দিতেই সুরাজ ভেতর থেকে জিগ্যেস করে, কে গো?
— আমি রিয়াজ চাচা গো। একবার বেরিয়ে আসো। দুজন লোক এসেছে গো, খুব বেপদে পড়েছে। দুয়ারটো একটুকুন খোল না।
রিয়াজ চাচার ডাক শুনে সুরাজ বাইরে বেরিয়ে আসে। হাতে পুরানো আমলের একটা হ্যারিকেন নিয়ে বৈঠকখানার দরজা খুলে দিয়ে বলে -কে গো চাচা, কুথাকার লোক?
— কোলকাতা থেকে আলছে গো। ভুল করি তুমার বাড়িতে এনাছি। ইনাদের জন্যি রাতটুকু থাকার একটু বেবস্তা করে দাও বাপু। আমার ছোট ঘরে কী-করে ওনাদের রাখি বলো।
— ঠিক আছে, চাচা।
— আপনারা ভেতরে আসুন।এই গরীবখানায় একটু কষ্ট করে রাতটা কাটাতে হবে।
রজনী ফিস্ ফিস্ করে স্বামীকে বলে, হ্যাঁ গো শেষে বেধর্মের বাড়িতে রাত কাটাতে হবে?
— চুপ, চুপ। ও শুনতে পাবে।
— ছ্যা, ছ্যা, আমি কিন্তু থাকতে পারব না। ওদের টয়লেটও নেই। আমি মরে যাবো।
— এছাড়া আর কী কোন উপায় আছে? এই বৃষ্টি রাতে কোথায় যাব? অন্য জাতের মানুষ হলেও, ওরা কি মানুষ নয়?
— তুমি যাই বল না বাপু, আমি কিন্তু কিছু খেতে পারব না। ওরা…
সুরাজ মাস্টার পুনরায় তাড়া দিয়ে বলে, আসুন, ভিতরে আসুন। কোন রকম হেজিটেট করবেন না। আপনাদের জন্য নতুন আয়োজন করা হবে। কিছু খেতে হলে বিশুদার দোকান থেকে আনিয়ে নেব। আর রান্না চাপাতে হলে মোড়ের কাছেই অনন্ত পণ্ডিতের বাড়ি। ও আমার বাল্যবন্ধু, একসাথে লেখাপড়া করেছি। ওই আলুসেদ্ধ, ডাল, বেগুন ভাজা ও ডিমের ঝোল রেঁধে দেবে।
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের ঝলকানি চোখ ধাঁধিয়ে দিচ্ছে। ছাতাখানা মাথার উপর ধরে ধীরে ধীরে তিমির বাবু ও তার বউ বৈঠকখানায় প্রবেশ করল।
গোঁসাইডাঙার মাণিক পীর [Gosai Dangaar Manik Pir]
দলে দলে লোকজন আলপথ ভেঙে মাঠের মধ্য দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একজন দুজন হলে হয়তো সেরকম কৌতূহল হতো না মজিদের। তাই বলে এত লোক, তাও পথ বেপথ ভেঙে ছেলে-বুড়ো, নারী-কন্যা হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছে এবড়ো খেবড়ো মাঠের ওপর দিয়ে। কিছুদিন আগেই ধান কাটা মেশিন দিয়েই গেরস্ত চাষিরা গাছ কেটে ধানগুলো ট্রাক্টারে বোঝাই করে বইয়ে নিয়ে গেছে বাড়িতে। খড়গুলো পড়ে রয়েছে জমিতে সারি সারি। এই খড় অনেকেই বোঝা বেঁধে মাথায় করে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বাড়ির দিকে । গরু না থাকলেও একেবারে যে নেই তা বলা যাবে না। ট্রাক্টরের দৌরাত্ম্যে হাল-বলদে চাষ কবেই উঠে গেছে। তবে বেশিরভাগ বাড়িতে গাই-বাছুর পালন করে দুধ-ঘি খাওয়ার একটা রীতি চালু আছে। গাঁয়ে ঘরে অল্প গৃহস্থ চাষীরা নিজেদের বাড়ির প্রয়োজনে গাঁয়ে গঞ্জে গাই পুষে থাকলেও তারা ওই দুধ বিক্রি করে মাসে মাসে কিছু সঞ্চয় করে। গরীবের সংসারের কাজে লাগায়। গাঁয়ের অধিকাংশ পাড়ায় গরিব মেয়েরা কেঁদপাতা কেটে বিড়ি তৈরি করে, বিক্রি করে বিড়ি কোম্পানিগুলোকে। বিড়ি কোম্পানি তাঁদের এজেন্ট গাঁয়ে গাঁয়ে পাঠিয়ে দেয়। বিড়ি কোম্পানিগুলোর এজেন্ট গাঁয়ে গাঁয়ে গিয়ে পাতা, তামাক দিয়ে আসে। সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে গিয়ে বিড়ি সংগ্রহ করে। কোম্পানির এজেন্টের কাছে মেয়েরা দল বেঁধে বিড়ি নিয়ে যায়। ছাঁট বিড়িগুলোতে বেশি লাভ করে কোম্পানি। তা করুক, গাঁয়ের মেয়েদের হাতে সপ্তাহান্তে কিছু কিছু টাকা আসে । ওরা তাতেই খুব খুশি। কেউ কেউ নাকছাবি, হাতের বালা, কানের দুল, নানারকম সোনা কিংবা চাঁদির গয়না বানিয়ে নিয়েছে। এতে মেয়েরা গর্ববোধ করে, কেননা স্বামীর কাছে হাত পেতে কিছু চাইতে হয় না।
মজিদের বাড়ির লোকেরাও বিড়ি বেঁধে সংসার চালায়। মজিদ ভিন্ রাজ্যে কাজ করতে যায়। প্রথমদিকে রাজমিস্ত্রির যোগান হিসেবে কাজ করত, এখন হাফ মিস্ত্রি হয়েছে। হেড মিস্ত্রি বলেছে, আরও কয়েক মাস হাতে নাতে কাজ করতে হবে। মাপজোখ ঠিক ঠিক ভাবে বুঝে নিতে না পারলে রাজমিস্ত্রি হওয়া যায় না। ওতেও অংক জানতে হয়। মজিদ তো কোনদিনই স্কুলে যায়নি। সেই ছোটবেলায় মা মারা যাওয়ার পর থেকেই বাপ তাকে মোড়লের বাড়িতে বাগাল রেখে দিয়েছিল। মোড়লের বাড়িতে সারাদিন ফাই ফরমাস খাটতে খাটতে দিনগুলো গুজরান হয়ে যেত। পড়বে কখন…
মোড়লের বড় ছেলেটা কলেজে পড়ে। তার কাছে থেকে মজিদ কিছু কিছু যোগ, বিয়োগ, গুণ, ভাগ করতে শিখেছিল। তারপর বাবা যেইদিন দ্বিতীয় বউ বাড়িতে আনল, সেদিন থেকেই ঘরে ঘোর অশান্তি। মোড়লের বাড়ি থেকে বাপের বাড়িতে শুতে গেলেই সংসারে অশান্তি হতো। রাতে ঘুম হতো না। তবুও সবকিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু, একদিন একটা অপবাদ সৎ মায়ের কাছ থেকে পেয়ে, যন্ত্রণা মুখ বুজে সহ্য করতে না-পেরে ভিন রাজ্যে চলে গেছিল সে কাজের সন্ধানে। বাবা যে খুব খুশি হয়েছিল তা নয়, কিন্তু সৎ মায়ের মনে শান্তি এসেছিল। বাপও এব্যাপারে ঘরের কথা বাইরে বলে বেশি ঘাঁটাতে চায়নি।
সেদিনে মজিদ পাড়ার বন্ধু রকিকে সাথে করে ওই দলের পিছনে গেছিল গোঁসাইডাঙার মাঠে। সেখানে এই মাঘ মাসে মেলা বসে। মেলা অবশ্যই ২৪ ঘন্টার । সকালে সাজো সাজো রব, সন্ধ্যেয় বেশ মেলা জমে যায়। রাত দশটার পর সকলেই ফিরে যায় নিজের নিজের বাড়ির দিকে। মেলায় যে সকল বিক্রেতা পসরা সাজিয়ে জিনিসপত্র বিক্রি করে, এই কয়েক ঘন্টায় যা বিক্রি বাটা হয়, তা নিয়েই তারা বেজায় খুশি । রাতের মধ্যে সব মালপত্র গুটিয়ে নিয়ে নিজের নিজের বাড়ি ফিরে যায়। পরদিন সকালে গেলে দেখা যাবে মাঠ খাঁ খাঁ করছে। কোথাও কোথাও ন্যাড়া পুড়ছে। গেরস্থরা জমিতে খড় পুড়িয়ে সেই জমিতে বোরো ধানের চাষ করবে।
ছোটবেলায় মজিদ কতদিন ওই গোঁসাইডাঙার মাঠে গরু,ছাগল চড়াতে গেছে; কিন্তু তখন কোনদিনই মেলা বসতে দেখেনি। যখন ভিন রাজ্যে পাড়ি দেয় কাজের সন্ধানে, তখনও শোনেনি এই মেলার কথা। তখন গোঁসাইডাঙার মাঠ খাঁ খাঁ করত, কাশবনে শিয়াল ডাকত, ডাঙাটার পাশে ছোট জলের খাল। তাতে নানারকম মাছ খেলে বেড়াত, বক পাখি মাছ ধরে খাওয়ার উদ্দেশ্যে উড়াউড়ি করত । খালের পাশে ঝোপেঝাড়ে কাঠবিড়ালি, খরগোশ, বুনো বিড়াল, খব্বিশ, শেয়াল ঘোরাঘুরি করত। মজিদরা গরু বাছুর চড়াতে গিয়ে ওদের লোলুপ দৃষ্টি দেখে চোখে চোখে রাখত পশুগুলোকে। সেই খালপাড়ের উত্তর দিকে একটা পতিত জমিতে বিশাল একটা বটগাছ ছিল। সেই ঝোপেঝাড়ে ঘিরে থাকা বটগাছটার তলায় কতদিন যে বিশ্রাম নিয়েছে তা বলা যায় না। বৃষ্টি হলে গরু ছাগলগুলো সেই বটগাছের তলায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদেরকে রক্ষা করত।
রকি যেতে যেতে মজিদকে বলছিল, জানিস মজু, ওই যে বটগাছটা দেখছিস, ওই গাছটার পাশে একটা মাজার তৈরি হয়েছে। ছোটখাটো একখানা ঘর, এক দরবেশের মাজার, মানিকপীর। কোত্থেকে একজন ফকিরবাবা এসে দশখান গাঁয়ে ঘুরে ঘুরে টাকাপয়সা, চাল-ডাল সংগ্রহ করে ওই ঘরখানা বানিয়েছে। ফকিরবাবা নাকি স্বপ্নে জেনেছে ওইখানে একজন পীর বাবা, সমাধিস্থ আছেন। বহুকাল থেকেই অযত্নে পড়ে থাকার অভিশাপেই নাকি এই মাঠে ভালো চাষ আবাদ হয় না। বর্ষাকালে বেশিরভাগ সময়েই বজ্রপাত ঘটত ওই মাঠে। কুসুমপুরের রিয়াজ মুন্সীকে তো বর্ষায় সময়ে চাষ করতে গিয়ে সাপে কেটেছিল। কোন গুণিন বাঁচাতে পারেনি। সেই থেকে তো লোকজন ওই মাঠে যেতে ভয় করত।
— তারপর! এখন কি মানুষ ভয় পায় ।
— ওই তো; মুশকিল আসান ওই ফকিরবাবা।
ওই একদিন এসে দোয়া-মন্ত্র পড়ে। দশখান গাঁয়ের মোড়ল মাতব্বরকে ডেকে, তার স্বপ্নের কথা বললে, একদিন ওখানে বড় করে মিলাদ, ফাতেহা করা হয়। পীরের নামে মাজার বানানো হয়। শিন্নি চড়িয়ে গরিব মিসকিনদের খাওয়ানো হয়।
— বেশ, তারপর ?
— হ্যাঁ, তারপর থেকেই তো ওই মাঠে সোনা ফলছে। বছরে দু’বার ধান হচ্ছে। মাঠের ওপর দিয়ে ইলেকট্রিকের লাইন গেছে, সেই লাইন দিয়ে শ্যালো, সাবমার্সিবল চালাচ্ছে । সারাটা বছর ধরে সবুজে, ফসলে ভরা।
— কি বলিস, এত পরিবর্তন?
— পরিবর্তন বলতে তো পরিবর্তন।
সেই থেকেই মানুষজন তো এই দিনের অপেক্ষায় থাকে । শুনেছি, এই পীরবাবার মাজারে যদি মনপ্রাণ দিয়ে প্রার্থনা করা হয়, তাহলে মনের ইচ্ছাও নাকি পূরণ হয়ে থাকে।
— সত্যি?
— আরে, সেই জন্যই তো মানুষ ওই দিনে দলে দলে গিয়ে মনের কথা পীরবাবার মাজারে জানায়, শিন্নি দেয়, চাদর চড়ায়, যদি পীরবাবা তার মনের ইচ্ছাটা পূরণ করেন।
মাঠের মাঝখানে হরেকরকমের পসরা নিয়ে বসে আছে কিসমত চাচা। কিসমত চাচা উজিরপুরের একজন রসিক মানুষ। মজিদেরা মাঝে মাঝে কিসমত চাচার কাছে দেশ-বিদেশের কথা শুনত, জানত, খবর নিত। লোকটা সেই অল্প বয়স থেকেই চুরি, ফিতে ঝাঁকায় করে, গাঁয়ে গাঁয়ে ফেরি করে বেড়াত। বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে বিভিন্ন জনের মুখে বিভিন্ন খবর নিত। তাদের মুখের কথা শুনে, নিজের মনের মত সাজিয়ে একটা গল্প তৈরি করে শোনাত লোকজনদের । যখন দেশ স্বাধীন হয়নি, পৃথিবী জুড়ে যুদ্ধ চলছে। সেসময় রেডিওর খবর শুনতে নিষেধ ছিল। রেডিও চালালে পুলিশ ধরে নিয়ে যেত। কিসমত চাচার একখানা ভাঙা মারফি রেডিও ছিল। বুকের ভেতর ভরে, চাদর জড়িয়ে গোঁসাইডাঙার মাঠের ঝোপের আড়ালে গিয়ে যুদ্ধের খবর শুনত। এই ব্রিটিশরা আক্রমণ করল। কখনো জাপানি বোমারু উড়ে যেত মাথার উপর দিয়ে সাঁই সাঁই করে। চারিদিকে আতঙ্ক, এই বুঝি বোমা পড়ল।
যেদিনে রেডিওতে শুনলো যে, জাপানের মাটিতে বোমা ফেলে জাপান দেশটাকে শেষ করে দিয়েছে, সেদিন থেকেই নাকি যুদ্ধ বন্ধ হয়ে গেছিল। আরও কত কথা, সেইসব গল্পকথা চাচা এমন সুন্দর করে রসিয়ে রসিয়ে বলতো যে, না শুনে উপায় নেই । পেটে খিদে থাকলেও ভোগ নেই। কতদিন গল্প শুনতে গিয়ে মজিদকে মোড়লের গালি মন্দ শুনতে হয়েছিল, একথা আজও ভুলতে পারে না মজু।
চলতে চলতে মজিদ ভাবে তাকে আর কতদিন ভিন রাজ্যে কাজ করে বেড়াতে হবে । আজকাল ভিন রাজ্যে কাজ করতে গিয়ে ভয়েডরে থাকতে হয়। কত রকম ঝক্কি ঝামেলা। প্রাণকে হাতে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাবারের জন্য পয়সা রোজগার করতে, সেই জন্য থাকতে হয়।
মনে মনে ঠিক করে, আজ মাণিকপীরের মাজারে চাদর চড়াবে। তার কত দিনের মনের বাসনা, সেই কথা অকপটে মন ভরে পীরকে জানাবে। একরকম একটা হিল্লে চাইবে।
— জোরে জোরে পা চালা, পা চালা মজু। হাঁক দেয় রকি।
— হ্যাঁ, এইতো চলছি, আর কত জোরে দৌড়াব বল ।
কিসমত চাচার দোকানের সামনে দাঁড়াতেই কিসমত চাচা চিনতে পারে মজিদকে। কাছে ডেকে নিয়ে বলে, আরে তুই মজু না! গোপালপুরের খবর টবর কেমন রে?
মজু জবাব দেয়, সব বলতে পারব না চাচা! এইতো দুদিন হলো বাড়ি এসেছি আর কয়েকদিন থেকেই তো আবার চলে যাব।
— আচ্ছা! আচ্ছা! তোর বাপ কেমন আছে রে?
— কেমন আর থাকবে? বয়স হলে যা হয়, কোনোরকমে টিকে আছে!
— তোর মা! মানে, ওই সৎ মা ! তারা কেমন আছে, তোকে কেমন দেখে?
— ওই একরকম! মাঝে মাঝে টাকা পয়সা দিই ত। তাই একটু আদর খাতির করে। নইলে যা দজ্জাল মেয়ে! তুমি ত জানো, তোমার গাঁয়ের বিটি কেমন হবে!
সন্ধ্যায় আকাশে পূর্ণিমার চাঁদ উঠেছে। ধবল জ্যোৎস্নায় ভরে গেছে চারিদিক। ওইদিকে মাঠে লোকজন গিজগিজ করছে। রকি তাড়া দেয়।
— চল চাদর চাপিয়ে দিয়ে আসি।
মজিদ বলে, দাঁড়া না! দেখছিস না কেমন ভিড়। একটু ভিড়টা কমুক। তারপর না হয় যাব।
দুজনে মেলার চারিপাশে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। জিলিপি কিনে খায়। গরম গরম মাসকালাইয়ের জিলিপি খুব পছন্দ করে মজিদ। দুজনে পেট পুরে জিলিপি খায়।
মজিদ বলে, চল। এবার দুটো পাঁপড় ভাজা খাই। মিষ্টির পরে নোনতা খেতে ভালোই লাগে। কি বলিস ?
ওই দিকের পাঁপড়গুলো বেশ বড় বড় সাইজের, তেলে মুচমুচে ভাজা। ও-গুলো খেতে ভালই লাগবে।
রাতের অন্ধকার ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছে। লোকজন অনেকেই বাড়িও ফিরে গেছে। ভিড় অনেকটাই হালকা হয়েছে তখন। রাত বাড়ার সাথে সাথে ভিড় যে কমে যায়, তা সকলেই জানে। ছেলেমেয়েরা বায়না মত খেলনা, বাঁশি ,বেলুন কিনে ঘরে নিয়ে ফিরে যাচ্ছে। আকাশে একটা মেঘ উঠেছে।
উঠে দাঁড়ালো তারা দুজন। রকি বলে, মজু চল! আর দেরি করিস না। আকাশে মেঘ উঠেছে, অকাল বৃষ্টি হতে পারে।
দুজনে এসে চাদর চড়াল পীরবাবার মাজারে। খাদেম সাহেব বলে, শিন্নিটা দাও বাবা! পীরবাবার মাজারে শিন্নি চড়াব। আর তোমরা, মনে মনে পীর মাণিকবাবার কাছে মনের বাসনা জানাও। পীরবাবা তোমাদের মনের ইচ্ছা পূরণ করবেন।
মজিদ কোনদিনই ধর্ম-কর্ম নিয়ে ভাবেনি। পীরবাবাদের বিশ্বাস করেনি; কিন্তু আজকে কেমন যেন তার মনটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে।
সেও কি তবে চায় পার্থিব জীবনে সুখ, একটু সুখের সন্ধান।
রকি মজিদকে তার বামকনুইয়ে গুঁতো দিয়ে বলে, চল, চল মজু! তোর মনের দুঃখ,কষ্টের কথা পীর বাবাকে জানা। নিশ্চয়ই পীরবাবা তোর অভাব দূর করে দিবেন।
মজিদ মনে মনে ভাবে, সংসারে অর্থই সবকিছু সত্যি ; কিন্তু টাকা পয়সা, ধনদৌলত থাকলেই কি মানুষ সুখী হতে পারে। তাহলে, সে কি চাইবে?
মনে মনে ঠিক করতে পারে না মজু। সুখ ক্ষণিকের। একটু বেঁচে থাকার জন্যই কি সুখ চাইবে।
না, না। সে টাকাপয়সা, ধনদৌলত ,সুখ চাইতে পারবে না। সে চায়, তার প্রতি যে অবিচার অন্যায় হয়েছে, তার উপযুক্ত বিচার।
আর কি চাইবে? সেই পারুলের কথা, যে তাকে একদিন ভালোবাসত এবং সেও তাকে ভালোবাসত। তাকে আর পাবে কি করে। সে তো আজকে অন্য ঘরে বন্দি । তার সংসারে কি নতুন করে আগুন জ্বালাতে চাইবে। না, সে তা পারবে না,,,,
মেঘ থেকে ঝিরঝির করে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি ঝরে পড়তে লাগল। সেই বৃষ্টির জলে ভিজে মন অনেকটা হালকা হতে লাগলো মজিদের।
নাসির ওয়াদেন | Nasir Waden
Orange Grove Tour India | Best 2023 | Travel Story
Best Porokia Bangla Galpo 2023 | পরকীয়ার পরাকাশে
Songs of Ramakrishna Mission | রামকৃষ্ণ মিশনের গানগুলো | Best 2023
Is Three Mile Island Still Dangerous? | Best Article 2023
Shabdodweep Web Magazine | Kahini Bengali Book Online | Nasir Waden
In today’s digital age, the world of Bengali literature has expanded beyond traditional bookstores, making it easier for readers to access a wide range of Kahini Bengali Book Online. Whether you’re a fan of Bengali thrillers, historical fiction, or rare Bangla books, there’s something for everyone. With the increasing demand for Buy Bengali Books Online and the convenience of reading Bangla eBooks PDF, platforms like Shabdodweep Web Magazine are providing an online haven for literature enthusiasts.
Expertise, Authoritativeness, Trustworthiness in Bengali Literature
When it comes to Kahini Bengali Book Online, it’s essential to turn to sources that reflect Expertise, Authoritativeness, and Trustworthiness (E-A-T). Shabdodweep Web Magazine is one such platform that showcases the work of reputed writers and offers a wide collection of Bengali Fiction Books, Thriller Books Online, and Rare Bangla Books. With a well-curated selection of Kahini Bengali Books, it aims to bring the best of Bengali literature to a global audience.
Popular Works by Nasir Waden on Shabdodweep Web Magazine
Shabdodweep Web Magazine is proud to feature works by acclaimed Bengali writer Nasir Waden, who has penned memorable stories like Karbalar Juddho, Bastu Vita Bikikini, and Maya Sangsar. These thought-provoking works combine rich storytelling with deep human emotions, making them a must-read for anyone interested in Bengali literature.
Why Choose Shabdodweep for Kahini Bengali Book Online?
When searching for Kahini Bengali Book Online, Shabdodweep Web Magazine offers a rich selection of Bengali Fiction Books across various genres:
Bengali Thriller Books: If you enjoy gripping narratives and heart-pounding suspense, explore our collection of Thriller Books Online that feature a perfect blend of intrigue and mystery.
Historical Fiction (Oitihasik Kahini Samagra Bengali): Delve into the history and rich culture of Bengal through Oitihasik Kahini Samagra Bengali stories, perfect for history buffs and readers who enjoy detailed, period-specific narratives.
Rare Bangla Books: Discover Rare Bangla Books that are hard to find anywhere else, with limited editions and stories from older generations of writers.
Raj Kahini: Enjoy Raj Kahini – stories that explore royalty, politics, and power through the lens of Bengali culture.
Kishor Kahini Sangraha: For younger readers, Kishor Kahini Sangraha offers a delightful collection of stories for teens and young adults.
One of the highlights of reading Kahini Bengali Books Online from Shabdodweep is the ability to Read Bengali Books Online Free in some cases or purchase eBooks that are optimized for easy reading on digital platforms. You can also access Kahini Bengali Book PDF Download if you prefer downloading books for offline reading.
Shabdodweep’s Growing Collection of Bengali Literature
At Shabdodweep, we strive to promote quality Bengali literature through easy access to books that cover a wide array of themes and genres. From Mohabidroher Kahini (Epic Narratives) to modern-day Raj Kahini, readers can explore a treasure trove of Bengali Fiction Books. Our commitment is to provide high-quality literary content, including works by emerging writers as well as established names in Bengali literature.
Why Read Bengali Books Online?
Reading Bengali books online is not just about convenience; it’s about accessing a rich cultural heritage. Shabdodweep Web Magazine offers a platform where readers can explore, enjoy, and connect with the vibrant world of Bengali literature, all from the comfort of their own homes. Whether you’re a longtime fan of Bengali literature or a newcomer exploring the works of authors like Nasir Waden, you’ll find plenty of engaging material that reflects the beauty and depth of Bengali culture.
Moreover, you can always count on the quality of content at Shabdodweep. Each story is carefully curated to ensure that readers experience the richness of Bengali literature without any compromise.
If you’re searching for Kahini Bengali Book Online, you can rely on Shabdodweep Web Magazine for a trustworthy selection. Additionally, search engines like Google can help you find our articles by typing keywords like Kahini Bengali Book PDF Download, Read Bengali Books Online Free, or Bengali Fiction Books.
FAQ: All You Need to Know About Kahini Bengali Book Online
- What is the best place to read Kahini Bengali Book Online?
Shabdodweep Web Magazine is an excellent choice for reading Kahini Bengali Book Online. We offer a wide range of Bengali Fiction Books, including Bengali Thrillers and Historical Bengali Novels, as well as rare and hard-to-find books in PDF format for easy reading. - Can I read Bengali books online for free on Shabdodweep Web Magazine?
Yes, you can access several Bengali books online for free at Shabdodweep. For more exclusive titles, you can check Bangla eBooks PDF directly from our website. - What are some popular Kahini Bengali Books on Shabdodweep Web Magazine written by Nasir Waden?
Some of the most popular stories include Karbalar Juddho, Maya Sangsar, and Bastu Vita Bikikini written by Nasir Waden. We also feature genres like Raj Kahini, Mohabidroher Kahini, and Kishor Kahini Sangraha. - Can I download Bengali books from Shabdodweep?
Yes, many of the Bengali Books on Shabdodweep are available for PDF download, allowing you to read them offline. We ensure that our digital books are easy to download and accessible on multiple devices. - How can I stay updated with new Bengali books on Shabdodweep Web Magazine?
To stay updated with the latest Bengali books online, follow Shabdodweep Web Magazine’s newsletter or check our site frequently for new releases, author interviews, and literary articles. We regularly update our collection of Bengali Fiction Books, including Thriller Books Online and Rare Bangla Books.
Exploring the world of Kahini Bengali Book Online has never been easier. With platforms like Shabdodweep Web Magazine, readers can access a diverse range of Bengali literature, from classic Raj Kahini to modern Kishor Kahini Sangraha. Whether you’re a fan of Bengali thrillers or historical narratives, Shabdodweep provides an authoritative and trustworthy source of high-quality literary content. Start your journey today by visiting our website and delving into the world of Bengali storytelling.
Sabuj Basinda | Follow our channel – Sabuj Basinda Studio