Best Online Bangla Hasir Golpo | Bengali Story

Sharing Is Caring:

Online Bangla Hasir Golpo | Bangla Funny Story

ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ

রোজকার কাজের জন্য, অফিস আদালত ব্যবসা কিম্বা মর্নিং ওয়াক, বেড়ানো বা আড্ডায় বাড়ি থেকে বেরনোর পর প্রতিদিনই পথে বিভিন্ন পরিচিত দৃশ্য দেখি আমরা, চোখ অভ্যস্ত হয়ে যায়, আবার দুর্ঘটনা বা তৎক্ষণাৎ ঘটে যাওয়া এমন আকস্মিক ঘটনা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে, মনে দাগ কেটে যায়। চাকরীর প্রথম দিকে আমাকে বেশ কয়েক বৎসর নিত্যযাত্রী হয়ে বাসে করে অন্যত্র যেতে হত। সেই সময় অন্য একটি রুটে আমার ঘনিষ্ঠ এক বন্ধু সুরেশের নিত্য যাত্রায় স্মরণীয় কিছু ভাল লাগার কথা জানতে পেরেছিলাম। প্রত্যহ বাসে ওরা একত্রে বাসে যাতায়াত করত। প্রায় দিনই ভিড় বাসে ওপরের রড ধরে দাঁড়িয়েই সাধারণত যেতে হয় নিত্যযাত্রীদের। এক ঘন্টার যাত্রাপথে মধ্যবর্তী স্টপেজে স্কুল পড়ুয়া একঝাঁক কিশোর-কিশোরী ও চার-পাঁচজন কলেজ পড়ুয়া তরুণীও বাসে উঠত রোজ। এর মধ্যে বেশ সুশ্রী দোহারা চেহারার এক তরুণীর সাথে বন্ধুবর সুরেশের সাথে চোখে চোখে কথা হতো। প্রথমে চোখাচোখি পরে ভাল লাগা শুরু, কখনো আড়চোখে দেখে নিত মেয়েটি, পরে দুই আঁখির মিলন হলেই মুচকি হেসে নামিয়ে নিত নেত্র পহ্লব। এটা রোজকার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওদের; বাসে ওঠার পরই শ্যামল আনচান করত, চোখ খুঁজে বেড়াত এদিক ওদিক। ভিড়ের মধ্যে লোকের মাথা ঘাড়ের ফাঁক দিয়ে পলকের চোখাচোখি, ইশারা, চোখে চোখে কথা, একটু মুচকি হাসি এসব নিয়ে বেশ ভালই চলত ওদের গোপন প্রেম। একটা অন্য ধরণের ভাল লাগায় আপ্লুত থাকত সুরেশ সারাক্ষণ, অফিসেও বেশ চনমনে থাকত। ভাল লাগা ক্রমশ: গভীর হচ্ছিল প্রতিদিন একটু একটু করে; ওদের নিয়ে হাল্কা ইয়ার্কি ঠাট্টা বাসের অন্যেরাও বেশ রসিয়ে উপভোগ করত; এভাবেই চলছিল বেশ কিছুদিন। হয়তো একটা পরিণতির দিকে যেত, কিন্তু তার আগেই ছন্দপতন। দিনকয়েক আসছিল না মেয়েটি; খবর পাওয়া গেল মেয়েটির মৃগী ছিল, পুকুরে স্নানে গিয়ে জলে ডুবে মারা গেছে। তারপর থেকে সুরেশ কেমন যেন উদভ্রান্ত হয়ে গেল; কিছুদিন পর ও ট্রান্সফার নিয়ে উত্তরবঙ্গের দিকে চলে যায়।

নিত্যযাত্রার আর একটি বেদনাদায়ক ঘটনা মনে পড়লে আজও কষ্ট পাই। নিত্য বাসযাত্রায় ধলডাঙ্গা থেকে তালডাংরা এই এক ঘন্টার রাস্তায় আমাদের ঐ বাসে বিভিন্ন স্টপেজে বেশ কিছু প্রান্তিক পরিবারের ছেলেমেয়ে বাসে করে স্কুলে যেত। ওদের প্যান্ট-জামা ব্যাগ জুতো সবই ছিল খুব সস্তার, মোটেই সাফ সুতরো নয়। এদের কাছ থেকে একটাকা বা আটআনা ভাড়া আদায় করা ছিল কন্ডাক্টরের কাছে রীতিমত কসরতের ব্যাপার। কন্ডাক্টর ধমক দিয়ে যা আদায় করা যায় তাই করত। দক্ষিণ বাঁকুড়ার এই সব অঞ্চলের বেশীর ভাগ লোকজনই ভাগচাষী, দিনমজুর, ছোটখাটো মুদি বা মিষ্টির দোকানদার। বাসের কন্ডাক্টর-হেলপার ওদের প্রতিদিনকার কাজকর্ম-রোজগার জীবনযাত্রার খুঁটিনাটির খবর রাখত, ভীষণভাবে জড়িত ছিল ওরা। দিদি-ভাই-দাদা-কাকা এসব সম্পর্কের মধ্যেই থাকত আর এভাবেই ওরা বাস চালাত। সেদিনকার কন্ডাক্টর লোকটা নতুন মনে হল, কথাবার্তায় বদমেজাজি, কাটখোট্টা, রুক্ষ চেহারার, কেমন যেন অমানবিক মনোভাব। বাসটা চলতে চলতে হঠাৎ সামনের দিকে জোরে কথাবার্তা,চিৎকার শুনলাম। ‘‘আজ আজ তোর মজাটা দেখাচ্ছি। ভাড়া না দিয়ে বাসে চাপা, নেমে যা আমার বাস থেকে।” বলে ভিড়ের মধ্য থেকে একটা বাচ্চা ছেলের সরু লিকলিকে হাতটা ধরে হিড়হিড় করে দরজার কাছে টেনে নিয়ে যাচ্ছে। আমরা সকলে সমস্বরে বলে উঠলাম, করছেন কি দাদা, ওইটুকা বাচ্চা, হাতটা ছিঁড়ে যাবে যে…”কে শোনে কার কথা। বাসটা পুরোপুরি থামেনি, সামনের গেট থেকে প্রায় ধাক্কা মেরে বাচ্চাটাকে ফেলে দিল কন্ডাক্টর। ছেলেটা টাল সামলাতে না পেরে রাস্তার ধারে ইট-পাথরের গাদায় গিয়ে পড়ল। সকলে গেল গেল রব তুলল। বাস থামিয়ে সকলে নামলাম আমরা, রক্তাক্ত অবস্থায় কাতরাচ্ছে লিকপিকে ছেলেটা। জনরোষে বাসের কনডাক্টরকে গণপ্রহার শুরু হল। মারধোর থামান হল; আমরা সকলে ছেলেটাকে চিকিৎসা কেন্দ্রে পাঠানোর ব্যবস্থা করলাম; ঘটনার রাত্রে ঘুমুতে পারিনি, বেশ কিছুদিন লেগেছিল ট্রমা কাটতে। অনেকদিন পর দেখেছিলাম ছেলেটাকে খুঁড়িয়ে বাসে উঠতে।

এরকম পথচলতি কত ঘটনার সাক্ষী হই আমরা। প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে আপনার আমার জীবন রঙ্গমঞ্চে কত কি তো ঘটে চলে, কাজের ব্যস্ততায়, চোখের অভ্যস্ততায় পেরিয়ে আসি ,সবটা মনে দাগ কাটে না; কোনটা দেখে খুশীতে মন ভরে ওঠে, কখনও বেদনায় চোখে জল আসে। আমার পাড়ার পাশেই বস্তিতে থাকে মদনা, রোজ রাত্রে মদ খেয়ে বাড়িতে ঢুকেই ওর প্রথম কাজ বউকে পেটানো। নানা ছুতোয় বউকে ঘা-কতক মারলে ভাত হজম হয় না; রোজ চলে একই নাটক, ওদের গালিগালাজ, চিৎকার, মারধোর, ঝগড়া শুনতে শুনতে কান অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, নতুন করে আর কানে লাগে না।

ওদিকে প্রতিবেশী মধুবাবুর বাড়িতে তখন অন্য নাটক। একান্ত ব্যক্তিগত সাংসারিক দাম্পত্য কলহ, মাঝে তো ঢোকা যায় না, কিন্তু পাশের বাড়ির বৌ-ঝিদের কৌতূহলের সীমা নেই। এত চিৎকারের কারণ জানা গেল তার পরদিন। মধুবাবু নাকি গোপনে দেশের বাড়িতে অসুস্থ ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য ওর স্ত্রীকে টাকা পাঠাতেন, গতকাল ওনার স্ত্রী জামা-প্যান্ট কাচতে গিয়ে ব্যাঙ্কের রিসিট হাতে পান, ব্যস, আর যায় কোথা, গিয়ে স্ত্রীর কাছে ধরা পড়ে কি নাজেহাল অবস্থা! তুলকালাম কাণ্ড, স্ত্রীর চিৎকার চেঁচামেচি কৈফিয়ত তলব, আরও কত কি, মধুবাবু ঠাণ্ডা মাথার লোক, প্রথম থেকেই চুপচাপ, কানই দিচ্ছেন না, একটা কথাও বলছেন না। বিন্দাস আছেন, বেপরোয়া মনোভাব, ধরা পড়লেন তো কি হল! একই মায়ের গর্ভে জন্ম, সহোদর ভাই, একসঙ্গে বড় হয়েছেন, তাঁর কষ্ট দেখা যায়, রোজগার করেন মধুবাবু নিজে, তার নিজের টাকায় ভাইকে সাহায্য করছেন, লুকোচুরির দরকার নেই। তবুও ওই, গিন্নীকে সমঝে চলা, সংসারে শান্তি বজায় রাখতে হবে। তাই চুপচাপ থাকা। বাইরে থেকে অনেক কিছু বলা যায়, কিন্তু, যার সংসার তাকেই ম্যানেজ করতে হয়, সংসারে ঝামেলা নিজেকেই মিটাতে হয়। যেমন ও পাড়ার যদুবাবুর নিজের মা-কে টাকা পাঠানোটা গৃহিণী কেমন বাঁকা চোখে দেখেন, তাই শান্তি বজায় রাখতে মিথ্যের আশ্রয় নিতে হয় যদুবাবুকে, আবার বেকার দেওরের হাতখরচ, হরেক আবদার বৌদিই মেটান, দাদাকে মিথ্যা বলে ম্যানেজ করেন। গৃহিণী প্রায়ই কর্তার মানিব্যাগ থেকে কিছু কিছু সরিয়ে রাখেন, টাকার খোঁজ হলে মিথ্যে বলে ম্যানেজ করেন, যদুবাবু স্ত্রীর অসত্য ভাষণ বুঝতে পেরে যান, মৃদু হাসেন, মুখে কিছু বলেন না, কারণ উনি জানেন ঐ টাকা অসময়ে যদুবাবুর হাতেই তুলে দেবেন স্ত্রী।

‘‘যাহা বলিব সত্য বলিব, সত্য ছাড়া মিথ্যা বলিব না‘‘- শপথ বাক্য পাঠ করে সত্য বলার ঝুঁকি যিনি নিয়ে থাকেন তাঁর মানসিক জোর তিনি যেমন বোঝেন, ছা-পোষা মধ্যবিত্ত বাঙালীর সংসার নির্বাহের জন্য সত্য কথা বলা কত বিড়ম্বনার ভুক্তভোগীরা জানেন। প্রতিদিনের মত সেদিনও বস্তির মদনার ছেলে নেপলা রাতে ঘুম ভেঙে দেখে বাবা নেশা করে এসে মাকে পেটাচ্ছে আর চিৎকার করে অশ্লীল গালিগালাজ দিচ্ছে; সেদিন রাতে অত্যাচার চরমে পৌঁছাল, চুলের মুঠি ধরে এলোপাথাড়ি মার, লাথি অপমান আর সহ্য করতে পারে নি বউটা, অসহ্য হতে আত্মরক্ষায় মায়ের ছুঁড়ে দেওয়া পাথরের আঘাতে বাবার মাথা ফেটে চৌচির; পুলিশের সামনে নেপলা সত্যিটা বলতে পারে না; মায়ের জেল হলে, ও খাবে কি! এই সত্যি গোপন করাটাকে কি বলবেন! মহাপাপ না অপরাধ!

ঘটনা গোপন বা বিকৃত করাটাই মিথ্যে। সত্য বলাটাকেই সকলেই ভাল মনে করে। সত্যকে আদর্শ করে আমাদের দেশের মহাপুরুষগণ জীবনের অনেক কিছু ত্যাগ করেছেন। সব ধর্মেই মিথ্যা বলা মহাপাপ; মিথ্যাচারিতা পাপ জেনেও বলি, একটা মিথ্যে কখনো একটা জীবন বাঁচিয়ে দেয় কিংবা একটা সত্যি বলার কারণে একজনের জীবন চলে যায়। কিন্তু সত্যিটা বলার জন্য একটা মানুষের প্রাণ গেলে ধর্মের দোঁহাই দিয়ে বাঁচা যায় না। আবার অন্য দিকে, একটা সত্যিকে গোপন করতে গিয়ে মিথ্যের জাল বুনে চলি অনেকে। মিথ্যে বলাটা অভ্যাস হয়ে দাঁড়ায়, লোক ঠকানো পেশায় পরিণত হয়, যা অনেক সময় ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনে। সংযমী হওয়া প্রয়োজন, লোভ সংবরণ করার অভ্যাস রপ্ত করলে মনে শান্তি পাওয়া যায়, একটা অন্যরকম ভাল লাগায় ভরে উঠে জীবনটা, ভেবে দেখি কি ?

পৃথিবীতে কত রকমের যে মানুষ রয়েছে, যত মানুষ তত পৃথক চরিত্র, ক্রোমোজোমের গঠন পৃথক, জীবন ধারাও আলাদা। জিনের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মানুষের চরিত্র গঠন হয়। কারোর সঙ্গে কারোর মিল নেই। কেউ আয় বুঝে ব্যয় করে, কেউ বেহিসেবী হয়ে খরচ করে, সামলাতে না পারলে ঋণের জ্বালে জড়িয়ে পড়ে, জীবন বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে। কেউ আবার ধার করেও ঘি খায়। আমার পাড়ারই এক সহপাঠী, বরাবর বেহিসেবী খরচ করে, আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি। বেপরোয়া জীবন যাপন। কথায় কথায় বলতে শুনেছি, ‘‘আরে ধার কে না নেয়, হয়েছেটা কি, ধার নিয়েছি.. শোধ করে দেব, মেরে তো দিচ্ছি না; ঋণ না নিয়ে কটা মানুষের চলে বল তো, বিশেষ করে আমাদের মতো মধ্যবিত্তের! আর এখন তো ঋণ দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে ব্যাঙ্কগুলো; কত কি লোন: হোম লোন -কার লোন -এডুকেশন লোন….একবার ফাঁসাতে পারলেই হোল। আর এদিকে কোটী কোটী টাকা লোন নিয়ে যারা পগার পার… তার বেলা!” খেঁকিয়ে উঠল বন্ধুবর। প্রকৃতপক্ষে ঋণ নিলে পরিশোধ করতে মানুষ দায়বদ্ধ। এই বোধ যাঁর যত বেশী সক্রিয়, তিনি তত বেশী সজাগ, ঋণ নিলে শোধ করতে অসুবিধায় পড়বেন কিনা…এসব ভাবেন। আবার ঋণ নিয়ে শোধ না করা মানুষেরও অভাব নেই। একটা বেপরোয়া মনোভাব ..সম্মানহানি..কোর্ট..মামলা এসব তুচ্ছ .… কে তোয়াক্কা করে ! কিন্তু আপনি আমি করি, ঋণ পরিশোধ করতে না পারলে… অপমানিত হতে হলে সংসারে অশান্তি…অনিদ্রা… রক্তচাপ বৃদ্ধি…খিটখিটে মেজাজ…এসব উপসর্গ জেঁকে বসে। আয় অপেক্ষা অধিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের ইচ্ছা থেকেই ঋণের মানসিকতা উঁকি মারে। অবশ্য বাধ্য হয়ে যাঁদের ঋণ নিতে হয়….মহাজনের ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে কৃষকদের যখন আত্মাহুতি দিতে হয়,,, তখন বুকটা হু হু করে না কি! তাই ‘‘ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” যাদের জীবনদর্শন তাদেরই থাক….। ওরা ঋণ করে ঘি খেয়ে যান যত খুশী।

যেমন আমার প্রতিবেশী ভূমি সংস্কার অফিসের হেডক্লার্ক দত্তবাবুর গৃহিণী আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সঙ্গতি রাখতে না পেরে কেমন হিমশিম খাচ্ছেন দেখুন। ‘‘না:, আর পারা যায় না, এবার বাজেট বাড়াতেই হবে। সংসার আর চলে না। মেয়ের মাস্টার্স শেষ হতে না হতেই বি.এড. পড়ানোর ধাক্কা, ছেলের হায়ার সেকেন্ডারির টিউটর, সায়েন্স পড়ছে, রাশি রাশি বই, ইলেকট্রিক বিল, খবরের কাগজ, কাজের মাসির টাকা, কেবল টি.ভি.র বিল, ডাক্তার, ওষুধ, চার-চারটে মোবাইলের খরচ, এল.আই.সি.র প্রিমিয়াম, বাড়ির ই.এম.আই. মেটাতে মেটাতে হাতে আর থাকছে না যে কিছুই….. মাস চলবে কি করে? টাকাটা বাড়াও বুঝলে।” —-এক নি:শ্বাসে কথাগুলো মুখস্থর মনে আউড়ে তবে থামলেন দত্তগিন্নী। সকাল বেলার চা খেতে খেতে খবরের কাগজ দেখার আমেজটাই নষ্ট কয়ে গেল দত্তবাবুর। গলা ঝাঁঝিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়ে নিজেকে সামলে নিলেন। ওরই বা দোষ কি। সীমিত অর্থে কুলিয়ে ওঠার চেষ্টা তো চালিয়ে যাচ্ছে।আমার মত মাঝারি আয়ের মধ্যবিত্তের সাধ ও সাধ্যের এই টানাপোড়েনের চিত্র অনেকেরই পরিচিত। হিসেবের খাতায় যোগ-বিযোগ কিছুতেই মেলে না। এদিক টানলে ওদিকটায় টান পড়ে, কাকে ছেড়ে কাকে রাখি। কোন খরচ করলে দু-পয়সা বাঁচানো দায় তারই আপ্রাণ চেষ্টা; চরে সারা মাস, সারা বছর, স্ট্যাটাস বজায় রেখে আধুনিক জীবনযাত্রার সাথে তাল রাখা মাঝারি মাপের মাস মাইনেতে সত্যিই নাজেহাল অবস্থা আমার মত অনেক মধ্যবিত্তের। উচ্চ আয়ের মানুষদের আমার মত সংকটাপন্ন অবস্থা না হলেও অন্য সমস্যা আছে, তাদের কথা তারাই ভাবুন। আমার হিসেবের খাতার সুদোকু আমাকেই সমাধান করতে হবে এটাই সারসত্য। ছেলেমেয়ের আবদার, পড়াশুনার খরচ, গৃহিণীর বায়না, সংসারের খরচের কড়ি মেটানোর দায় আমারই। আমি কোথায় পাব, এটা অনেক সময় বুঝেও বুঝতে চায় না আমার আপনজনেরা। অনেকটা পুরাণের সেই দস্যু রত্নাকরের বাল্মিকী হয়ে ওঠার গল্পের মত।

টিফিন বিরতিতে অফিস ক্যান্টিনে বসে আড্ডা হচ্ছিল, আড্ডা মানেই তো চা, ক্যান্টিন যখন সঙ্গে কিছু তো থাকবেই। গরম ফুলুরির সঙ্গে আদা দেওয়া স্পেশাল চা অর্ডার দিয়েছিল অতনু, ওর ছেলে ভাল রেজাল্ট করার সুবাদে চলছে এই চা-পার্টি। সময় বিশেষে এক কাপ চা যে কি বিশাল উদ্দীপনা সৃষ্টি করে ভাবা যায় না। এক কাপ ধোঁয়া ওঠা গরম চা, কত সামান্য আয়োজন, অথচ মৌজ কত ব্যাপক; শুধু এক কাপ চা আর দুটো বিস্কুট, অতিথি আপ্যায়নে এর চেয়ে সোজা উপায় আর কিছু নেই মধ্যবিত্ত বাঙালীর; অতিথি চা না খেলে মুশকিলে পড়েন গৃহকর্তা। সকালে এক কাপ চা না হলে দিনটাই যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে, চায়ের নেশা নেই এমন বাঙালী যেমন পাবেন না, কাজের ফাঁকে অফিস ক্যান্টিনে কলিগদের সাথে চায়ের আড্ডায় বসেন না এমন কর্মচারীও খুঁজে পাবেন না। পড়ুয়াদের কলেজ ক্যান্টিন আর কাজের সন্ধানে ঘোরা ছেলে-ছোকরার সময় কাটানোর উৎকৃষ্ট জায়গা ওই চায়ের দোকান বা রেস্তোরা। শুধু এক কাপ চা এর ছুঁতোয় ঘন্টার পর ঘন্টা দোকানে আড্ডা মারার সুযোগ অন্য কোথাও নেই; চায়ের টেবিলে তর্কের তুফান তুলতে আড্ডাবাজ বাঙালীর যে জুড়ি নেই একথা নতুন করে বলতে হয় না। এলাকার কোন ঘটনার যেমন সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় তেমনই চায়ের টেবিলে সমালোচনার ঝড় তোলে অলস আড্ডাবাজেরা। আবার রসিক বাঙালীর বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়ার মতই চিন্তাশক্তিকে বাড়িয়ে দিতে গরম চায়ের চুমুকই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট। মাটির ভাঁড়ে সোঁদা মাটির গন্ধে গরম চায়ের স্বাদ আলাদা একটা আমেজ আনে; অনেকে শব্দ করে, কেউ বা নি:শব্দে চোখ বন্ধ করে চুমুক দিতে দিতে চিন্তায় রাজ্যে হারিয়ে যান; চা শুধু আড্ডাই জমায় না, চা মেটাবলিজম বাড়ায়, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। কিন্তু খালি পেটে চা মোটেই স্বাস্থ্যসম্মত নয়। আমার বাড়ির পাশেই পাড়ার মোড়ে সাধারণ চালাঘরের ভিতরে দুটো নড়বড়ে হাইবেঞ্চ-লোবেঞ্চ আর ছোট্ট জানালার মধ্য দিয়ে চলে আলো আঁধারির খেলা, মফস্বল শহরে আদর্শ চা-এর ঠেক ঠিক এটাই। এখানে বসেই সমস্যার সমাধান করে পাড়ার মাতব্বর ছেলে ছোকরারা। সবেরই কেন্দ্রবিন্দু ওই এক কাপ চা।

যাক, অনেকক্ষণ চা-এর মৌতাত হল, নিজের হিসাবের খাতার যোগ-বিয়োগও শোনালাম। এবার সংসারে অন্য হিসাবের দিকগুলো দেখা যাক। টাকার হিসাব ছাড়াও সংসারে অনেকরকম পাওনা গণ্ডার হিসাব নিকাশ করতে হয় আমাদের। স্নেহ ভালবাসার মধ্য দিয়ে সন্তানকে শৈশব থেকে বড় করে তোলার পিছনে বাবা-মাকে যে কৃচ্ছসাধন ও আত্মত্যাগ করেতে হয় তার মূল্য আমাদের হিসেবের খাতায় তুলে রাখি না অনেকেই। সেই হিসেব রাখি না বলেই আমরা সংসার থেকে নিতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়ি, ফিরিয়ে দিতে অনীহা বোধ করি। কিছু পেতে গেলে যে কিছু দিতে হয় তা মনে রাখি না। তা হিসেবে বার বার গরমিল ধরা জপে। আত্মসর্বস্ব অহংবোধে যৌবনে আমরা আত্মহারা হই। নেওয়ার হিসেব না রেখে কেবল পাওয়া আর না পাওয়ার হিসেব নিয়েই মশগুল থাকি, না পেলে দোষারোপ করি আক্ষেপ করি। একাকীত্বের হতাশায় দিন কাটান।আর্থিক সঙ্গতি থাকলে বৃদ্ধাশ্রমে জীবনের বাকি দিনগুলি অতিবাহিত করেন, অন্যথায় সংসারের বোঝা হয়ে বা নিরন্ন থাকতে বাধ্য হন। আমরা একবারও ভেবে দেখি না আমাদের সন্তান যাদের সাধ-আহ্লাদ মেটানোর জন্য, উচ্চশিক্ষার জন্য আমরা আমাদের সর্বস্ব উজাড় করে দিয়ে নি:স্ব হই, তারা আমাদের মেষ বয়সে পাশে থাকছে তো। অবশ্য এটাও ঠিক যে, না থাকলেও আমার কর্তব্য আমাকে করে যেতেই হবে। তবে এটাও মনে রাখা বিশেষ দরকার যে, স্ত্রী-ছেলেমেয়ের জন্য আমি যেমন দায়বদ্ধ তেমনই যারা আমাকে এই পৃথিবী দেখিয়েছেন তাদের জন্যও সমানভাবে আমি দায়বদ্ধ। দেওয়া নেওয়ার এই হিসেব আমার তুলে রাখছি কি হিসেবের খাতায়। মনের একটা ছোট্ট কোণে, স্মৃতির মণিকোঠায় শৈশব হতে বাবা-মার হাতে তিল তিল করে বেড়ে ওঠার ছোট ছোট মুহূর্তগুলোর হিসেব জমা করে রাখলে সময়ে তার সুদেই এখনকার পথচলার খরচ তো আমরাই বের করতে পারি, তাই নয় কি। তাই হিসেবের ঐ লাল খেরো খাতার আয়-ব্যয় মেলানোটা বড়ই জরুরী তা সে যতই জটিল হোক না কেন। আবার আয় বুঝে ব্যয় করাটাও জরুরী নইলে প্রয়োজন মেটাতে ধার করতে হয়। এই ধার করার অভ্যাসটা রপ্ত হয়ে যায় সহজেই অর্থাৎ নিতে পারি কিন্তু শোধ দিতে পারি না। এই দেওয়া আর নেওয়ার হিসেবটা ঠিকঠাক রাখা খুবই দরকার। হিসেবের খাতা তাই রাখতেই হবে, তুলতেই হবে জীবনের প্রতিটি খরচ, প্রতিটি দেওয়া নেওয়া আমাদের নিজেদের স্বার্থেই, তবেই ঠিকঠাক চলবে সংসারের রথের চাকা।

বাঙালীর বৈশাখ

বৈশাখ এলেই নাকি বাঙালির বাঙালীয়ানা জেগে ওঠে! নিন্দুকেরা যা বলে বলুক, তাতে খাদ্যরসিক আড্ডাবাজ বাঙালির কিচ্ছু যায় আসে না। বৈশাখে বাঙালীয়ানার জ্বরে কাবু হয় না এমন বাঙালি কি খুঁজে পাবেন। আবার এটাও ঠিক, ২৫শে বৈশাখ পেরিয়ে খুব জোর ১১ই জ্যৈষ্ঠ, ব্যস ! বাঙালির বাংলা প্রেম কেমন যেন ঝিমিয়ে পড়ে। সে যাই হোক, সারা বৈশাখ মাস জুড়ে এত পার্বণ, পূজোর মাস ছাড়া দেখা যায় না। বাঙালির বৈশাখ শুরু হয় নববর্ষ দিয়ে আর শেষ হয় রবীন্দ্রজয়ন্তীতে। ২৫শে বৈশাখের অনেক আগে থেকেই ফেসবুক-হোয়াটস্-অ্যাপ জুড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত-কবিতাপাঠের আলাপচারিতা শুরু হয়, দিন যত এগোয় রবিঠাকুর, জোড়াসাঁকো, শান্তিনিকেতনের পুরানো আবেগ মাথা চাড়া দেয় আম বাঙালির। বৈশাখ মানে নববর্ষ, সারা বছরের হিসেব, মহাজনের ধার শোধ, হাল খাতার নেমন্তন্ন, বাংলা ক্যালেণ্ডার, বাংলা-পঞ্জিকা আর অবশ্যই আত্মীয়-পরিজন একসাথে মহাভোজের আসর বসাই আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলি আমরা খাদ্যরসিক বাঙালিরা। বৈশাখ মানে আবার ভ্যাপসা গরম, কালবৈশাখী, আম কুড়োনোর ধুম, আম পোড়ার সরবত, থাকে ঠাণ্ডা দই, আইশক্রীম, লোভনীয় ল্যাংড়া-আম্রপালির স্বর্গীয় স্বাদ আর রসে টই-টম্বুর কাঁঠালের সুমিষ্ট আঘ্রাণ। বাঙালীর বৈশাখ মানে সূতীর পোশাকের সম্ভার, চৈত্র সেল, ছাড়….ছাড়….ছাড়… বিজ্ঞাপনের বাহারি আকর্ষণ, টিভি চ্যানেল,পত্র-পত্রিকায় এসি, ফ্রিজ, এয়ারকুলার, ফ্যান বিক্রির অক্লান্ত প্রতিযোগিতা। দুর্গাপূজার পর চৈত্র সেল-এ আর একদফা নতুন জামা-প্যাণ্ট কেনার রেওয়াজ আছে যে বাঙালী পরিবারে, তাই বাঙালীর বৈশাখে শুধু ছেলেমেয়েদের নয়, গৃহিণীরও নতুন শাড়ী চাই-ই চাই !

সম্ভাবনা

সুযোগের অভাবে, সময়ের সদ্ব্যবহারের অবহেলায় কত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা, কত প্রতিভার বিকাশ যে থমকে দাঁড়ায় মাঝপথে, বাস্তবের কঠোর অভিঘাতে সম্ভাবনার বীজ যে অঙ্কুরেই নষ্ট হয়, কত ভবিষ্যতের আশা যে তলিয়ে যায় মহাকালের স্রোতে, তার হাল-হকিকৎ আমরা রাখতে পারি না। আমার আশেপাশে এ রকম কয়েকটি সম্ভাবনা অকালে বিনষ্ট হয়ে যেতে দেখেছি চোখের সামনে। আমাদের পাড়ার শেষে বস্তীতে থাকে পিকু, ওর বাবা ভ্যান-রিকসা চালায় আর মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে; তিন ছেলেমেয়ের পিকুই বড়। ছোট বেলা থেকে দারুণ আঁকার হাত, ছোট-খাট নানান প্রতিযোগিতায় প্রাইজ এনেছে অনেকবার। সকলে ওর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। পিকুর ইচ্ছে বড় হয়ে আর্ট স্কুলে পড়ে বড় আর্টিস্ট হবে, কিন্তু হল না । অভাবের সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোয়; হঠাৎ স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে বাবা মারা গেল; প্রা্ইমারীর পর কোনরকমে হাইস্কুলে ভর্তি হয়েছিল; স্কুলে মিড ডে মিল অফ্ থাকলে সেদিন খাওয়া হয় না পিকুর, মালিকের বাড়ি থেকে মায়ের আনা ভাত-তরকারি আর মেগে-চেয়ে যা পায় রাত্রে ভাগ করে খায় সবা্ই একসঙ্গে। পড়া হল না আর, পাড়ার মুদির দোকানে কাজে লাগতে হল, কি করে আর আর্টিস্ট হবে পিকু।

পাশের পাড়ায় থাকতো অন্তু। ছোটবেলা থেকেই দারুণ রেজাল্ট। অঙ্কে একেবারে একশোয় একশো, ইংরাজি সহ সব বিষয়ে দারুণ ব্যুৎপত্তি। একবার পড়লে স্থায়ীভাবে সেভ হয়ে যায় ওর মেমরিতে। ওর স্বপ্ন বড় হয়ে বড় শিক্ষক হয়ে দেশের ভবিষ্যৎ তৈরিতে হাত লাগাবে। এ হেন অন্তু যে মাধ্যমিকে ভাল রেজাল্ট করবে, তা আর নতুন কথা কি! করলোও রেজাল্ট। স্কুলের সেরা তো বটেই, সারা শহরের আটটা স্কুলের মধ্যেও সেরা। ব্যস তারপর ছন্দপতন। হায়ার সেকেন্ডারিতে ভর্তির পরই ওর বাবা হঠাৎ ছাদ থেকে পড়ে জখম হলেন। প্রাণে বেঁচে গেলেও উত্থানশক্তি রইল না, একেবারে পঙ্গু। ব্যস হয়ে গেল সব স্বপ্ন শেষ। মফস্বল শহরে মাড়োয়ারি গদিতে খাতা লেখার কাজ সেরে বাড়ি ফিরতে অনেক সময় লেগে যেত। রাত্রি নটায় দোকান বন্ধের পর ট্রেন থেকে নেমে সাইকেলে বাড়ি ফিরতে রাত্রি দশটা-সাড়ে দশটা। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে নাইট স্কুলে কয়েকদিন ক্লাস করেছিল, কিন্তু আর পারল না। সংসারের জোয়াল টেনেই চলেছে এখনও।

একই ভাবে খালপারের রহমান শেখের মেয়ে সেলিনার আর শিক্ষিকা হয়ে ওঠা হয় না ; মেধাবী ছাত্রী ছিল সেলিনা। বরাবরই ভাল ফল করতো। সবে ক্লাস নাইন; তর সয় না আর দিনমজুর রহমানের। আঠারো পার হওয়ার আগেই হয়ে বিয়ের জাঁতাকলে ফেলে ওর বাবা-মা‘ই সব পথ বন্ধ করে দিল। বছর পার হতেই অকালে মা হওয়া আর রক্তাল্পতা-অপুষ্টির স্বীকার মা আর শরীরে জণ্ডিস নিয়ে জন্মানো সন্তান এখন চরম দারিদ্রের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। ওইটুকু মেয়ে অকালে সন্তান জন্মানোর পর রুগ্ন শরীরে অভাবের সংসারে আর কি পড়াশোনা চালানো যায়। সরকার নানান পরিকল্পনা নামালেও সচেতন হয় কই অভিভাবক; কজন আর মুখ ফুটে বলতে পারে, কজন আর খবরের কাগজের শিরোনাম হয়। অশিক্ষাই চরম অভিশাপ, নীরবে সব সহ্য করাই যেন আমাদের দেশের মেয়েদের ভবিতব্য।

অল্পে খুশী

হাসি-খুশীতে থাকতে কে না চায়, যেমনই চেহারা হোক না কেন, হাসলে সকলকেই দেখতে সুন্দর লাগে, হাসলে মন ভাল থাকে, কাজে উদ্দীপনা পাওয়া যায়, হৃদপিন্ড সহ অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সচল থাকে; সকালে রাস্তায় বেরিয়ে কারোর সঙ্গে দেখা হলে হালকা করে হাসুন, দেখুন সে-ও উত্তরে হাসবে, সারাটা দিন ঐ অনুভূতিটা আপনার ভাল লাগবে। মন খারাপ কার না হয়, মন খারাপ বা না হাসা কিন্তু স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর, তাই চাহিদা কমাতে হবে, অল্পে খুশী থাকার চেষ্টা করতে হবে, যতদিন জীবন আছে খুশীতে বাঁচার সংকল্প করতে হবে, আর খুশীতে বাঁচতে গেলে চাওয়া পাওয়া কমাতে হবে, বেশী চাইলেই সমস্যা। জীবনে যা পেয়েছি তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকার অভ্যাস গড়ে তোলা, সমস্যা হলে মাথা ঠাণ্ডা রেখে একটা একটা করে সমাধান করা, মেডিটেশন করা, পরিবারের সঙ্গে বেশী করে সময় কাটানো, বাবা-মার কাছে পুরানো দিনের গল্প শোনা… এসবই হোল খুশীতে থাকার উপায় আর খুশীতে থাকতে গেলে অল্পে সন্তুষ্ট থাকতেই হবে, নইলে নিজের অজান্তেই ব্লাড সুগার, প্রেসার কোলেস্টেরল আপনাকে বিপাকে ফেলবেই।

সংসারে সম্মানের সাথে ভদ্রভাবে বেঁচে থাকার ন্যূনতম চাহিদা নিয়েই তো সন্তুষ্ট থাকা যায় তবুও আমরা বুঝেও বুঝি না, আমরা কেউ কেউ একটুতেই সন্তুষ্ট থাকি, বেশীর ভাগ আমরাই অল্পে খুশী থাকি না, নিজেই নিজের অ-সুখের কারণ হই; আরো সুখ, আরো অর্থ, গাড়ী-বাড়ীর নেশায়, বিলাসিতার চরম শিখরে পৌঁছেও আরো সুখ খুঁজে বেড়ায়, আরো পাওয়ার নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি, আমরণ ছুটে বেড়াই সুখ নামের মরীচিকার সন্ধানে। ভেবে দেখুন, চাইলেই কি সবাই সব পাবে, চাইলেই ছেলে-মেয়ে দারুণ বুদ্ধিমান হবে, ক্লাসে ফার্স্ট, অঙ্কনে, নাচে গানে কুইজে…. সব প্রতিযোগিতায় প্রথম হতেই হবে, প্রতিযোগীতার ইঁদুরদৌড়ে ছেলেমেয়েগুলোকে ছোটাচ্ছি তো আমরাই, কেবল টাকা রোজগার নয়…. ভাল লেখাপড়া করে ভাল মনের মানুষ হতে শেখাই না। যার বেশী অর্থ আছে, তার চিন্তা চুরির ভয়, রাতে ঘুমের ওষুধ খেয়েও ঘুম আসে না, আর যার পরের দিন খাবারের ঠিক নেই, দিনের শেষে নি:সাড়ে কেমন শান্তিতে ঘুমায়! সেই বরং ভাল থাকে ; পৃথিবীতে কিছুই স্থায়ী নয়, কোন প্রাণীও নয়। কেউ কিছু নিয়ে যেতে পারে না, এই সত্যটা বুঝেও বুঝি না আমরা…এটাই অ-সুখ…অল্পেতে খুশীর থাকার পথে এটাই বাধা।

রেল গাড়ীর কামরায়

রেলের কামরায় এক তিক্ত অভিজ্ঞতা বেশ মনে আছে। কলকাতা থেকে ফিরছি, সঙ্গে স্ত্রী। হাওড়া স্টেশনে ‘পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে’ আনরিজার্ভড কামরায় উঠে দেখলাম প্রায় সব সিটেই গামছা বা খবরের কাগজ পাতা: পাশাপাশি সব কামরায় একই চিত্র। ফাঁকা সিটে দখলদারির চিহ্ন দেওয়া; সিট পেলাম না, অগত্যা দাঁড়িয়ে দেখতে থাকলাম, বেশিরভাগই কলকাতায় ব্যবসা করতে আসা নিত্যযাত্রী, একে একে আসছে আর ডেকে বসাচ্ছে ওদের লোক; ট্রেন ছাড়ার পরও সব সিট পূরণ হয় নি দেখে আশান্বিত হলাম। কিন্তু,না! হল না, একদল গামছা পেতে তাস খেলা শুরু করেছে; অন্যদিকে, সিটে খবরের কাগজ পেতে এক রাশ মুড়ি ঢেলে চপ-চানাচুর-শসা এসব মিশিয়ে সকলে আড্ডার মেজাজে খাওয়া শুরু করেছে, এটা যে পাবলিক গাড়ী, বাড়ীর বৈঠকখানা নয়, এসব তোয়াক্কাই করে না; স্ত্রী অসুস্থ বলাতেও কানে দিল না, ভীষণ রাগ হচ্ছে, আমার স্ত্রী ইশারায় তর্কে জড়িয়ে পড়তে নিষেধ করছে; একসময়, একজনের দয়া হল, বলল, “খাওয়া শেষ হোক, দেখছি!” মুড়ির পাহাড় শেষ হল, কিন্তু আমার প্রতীক্ষার অবসান হল না, ওদের দুজনের মাঝের সিটে আমার স্ত্রী বসতে রাজি হল না ; শেষে সিট পেলাম খড়্গপুর স্টেশনে। এরপরের অংশটা বেশ স্বস্তির; ট্রেন ছুটে চলেছে, জানালার পাশেই সিট পেয়েছিলাম আমরা, ফুরফুরে হাওয়ায় ক্লান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই দুচোখে স্বপ্নিল তন্দ্রার ঘোর ; সন্ধ্যে ঘনিয়ে রাতের আদিগন্ত ঘন কালো আকাশে একফালি চাঁদ, যেন আমারই সহযাত্রী! আহা কি অপরূপ! মনে পড়ে গীতা দত্তের কালজয়ী সেই মিষ্টি সুর “নিশিরাত বাঁকা চাঁদ আকাশে, চুপিচুপি বাঁশি বাজে বাতাসে”! কিছুক্ষণ আগের তিক্ত মুহূর্তগুলো ভুলে ভালোলাগায় মন ভরে উঠে ছিল বাকি পথটা ।

জন্মদিন

“জন্মদিনের প্ল্যান! আমার জন্মদিন মানে আমার মায়েরও তো ‘মা’ হওয়ার দিন, তাই মাকে আজ আমি একটা ভালো শাড়ী কিনে দেব“ বন্ধুকে ফোনে ছেলের মুখে কথাটা শুনে গর্বে বুকটা ভরে উঠল সুরেশের। সত্যিই তো এরকমভাবে আমি কেন ভাবতে পারিনি, আমার ছেলে মায়ের ঋণ মনে রাখে, মূল্যবোধ এখনও বেঁচে আছে! এমনভাবে মাকে মনে রাখাটা এখন ভীষণ জরুরী। আমি তো পারিনি, ছেলে পারছে, ভাবছিল সুরেশ। তখনকার দিনে মেয়েদের জন্মদিন পালন করা হত না, তাতে নাকি মেয়েদের বয়সটা সামনে চলে আসে, এখন সময় বদলেছে, ফেসবুক হোয়াট্স-অ্যাপে কোন কিছুই গোপন নেই। আগের দিনে যৌথ পরিবারে তুতো ভাইবোন একসঙ্গে বড় হত, জন্মদিন মনেই থাকত না, এখন নিউক্লিয় পরিবারে একটাই হয়তো সন্তান, তাকে ঘিরেই ইচ্ছা পূরণের স্বপ্ন দেখেন বাবা-মা। তবে যতই আধুনিক হই না কেন, জন্মদিন পালনের সাবেক রীতি এখনও চালু রয়েছে অনেক পরিবারে। তখন জন্মদিন ভুলেই যেতাম। মা কিন্তু ঠিক মনে রাখতেন কার কবে জন্মদিন, খুব সকালে স্নান সেরে শুদ্ধাচারে মা নিজে যেতেন মন্দিরে। প্রসাদী ফুল মাথায় ছুঁইয়ে পায়েস খেতে দিতেন, বলতেন,‘‘ আজ যে তোর জন্মদিন রে! সারাদিন ভাল হয়ে চলবি বাবা, কেমন!” সাধারণ একটা নতুন জামা, একটু ভাল খাবারে আনন্দে আত্মহারা হতাম। আচ্ছা, যাঁদের আগামীকালের খাবারের চিন্তা মাথায় নিয়ে ঘুমোতে যেতে হয়, হত-দরিদ্র বাবা-মা সন্তানের জন্মদিন পালন মাথায় রাখতে পারেন! কি ক্ষতি হয় জন্মদিন না পালন করলে! তখন ভাবতাম, এখনও ভাবি, তবে অন্য ভাবে। জন্মদিন পালন করা অন্যায় তো কিছু নয়! দৈনন্দিন স্কুল-টিউশুনি-হোমওয়ার্ক থেকে মুক্তির একটা দিন ওদের, একটু অন্যভাবে কাটানো ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ছোট ছোট খুশীতে ওদের মুখগুলো কেমন চকচক করে, নতুন করে এগিয়ে যাবার আনন্দ পায় ওরা! জন্মদিনে এটাই তো পরম পাওয়া আমাদের !

প্রতিবেশী

আমার নতুন পাড়ায়, চা-দোকানে বসে পেপার দেখছি, উস্কুখুস্কু চুল, একটি লোক কাউকে খুঁজছিল, নাম বলল, আমি চিনি না, পাশের দু-তিনজন ছোকরাও বলতে পারল না। একটা বাচ্চাছেলে বাবার হাত ধরে দোকানে দাঁড়িয়েছিল, বলল, ঐ কাকুর বাড়িতে ছবি আঁকতে যাই, আমি চিনি। পাড়ারই লোক, চিনি না কেউই। এখন সামাজিক মেলামেশা এতটাই কম যে, পাশের বাড়িরও খবর রাখি না। বিপদের সময় পাশের লোকটিই সবচেয়ে বড় বন্ধু হতে পারে, এমনটাই ছিল আমাদের পুরানো পাড়ায়। আমার বাবাকে দেখেছি, বাবা নাড়ী টিপে জ্বর আন্দাজ করতে পারতেন নির্ভুল। পাশের বাড়িতে রোগীর শিয়রে বসে গোটা রাত কাটিয়ে দিতেন অনায়াসে, জলপটি-বাতাস করতেন নিজের হাতে, আশ্বস্ত করতেন জেঠিমাকে। বেশির ভাগ সময়েই জ্বর কমে যেত। বাবাকে পাড়ার প্রায় সব মহিলা দাদা বলতেন, সেই সূত্রে সবাই আমার পিসিমা, পুরুষরা কিন্তু কাকু কিম্বা জেঠু, পিসেমশাই নয়। পিসিমাদের সবার পোষ্ট-অফিসে রেকারিং পাসবই খুলিয়ে টাকা জমা করাতেন বাবা, ম্যাচিওর হলে ফর্মে সই করিয়ে টাকা তুলে বাড়িতে পৌঁছে দিতেন। দরখাস্ত লেখা, ফর্মপূরণ করে দেওয়া সব কিছুতেই সিদ্ধহস্ত, পাড়ার মাস্টার আমার বাবা সকলের অভিভাবক, পরামর্শদাতা হয়ে উঠেছিলেন। কিছু পাওয়ার আশায় নয়, শুধু নিজে নয়, প্রতিবেশীরাও যেন ভাল থাকে, এই ভাবনায়। বাবার কাছে থেকে দেখা ও শেখা আমার। চেষ্টা করি প্রতিবেশীর বন্ধু হয়ে উঠতে। অন্যের জন্য কিছু করতে পারলে মনে তৃপ্তি আসে, ভালোলাগায় মন ভরে ওঠে, যা অন্য কিছুতে হয় না ! বোঝা যায়, আসল আনন্দ ভোগে নয়, ত্যাগে।

অপরাজিতা

রাতে খাওয়া দাওয়া শেষ করে মোবাইলে কিছু একটা দেখছি,ফোনটা বেজে উঠতেই সব ঘেঁটে গেল। ওপ্রান্ত থেকে পুষ্পিতার ভয়ার্ত গলা, দাদা, আমাকে বাঁচাও, আমি আর পারছি না। কথাবার্তায় যা বোঝা গেল, ওর স্বামী একটা অসভ্য লোক, মুখ খিস্তি,গায়ে হাত তোলা এসব চলছিল, আজ পেটে লাথি মেরেছে।‌ দিনের পর দিন অপমান লাঞ্ছনা আর সহ্য হচ্ছে না। মনে পড়ে, এই তো সেদিন বিয়ে দিলাম। আমাদের পাশের বাড়ি, বোনের সঙ্গে পড়ত পুষ্পিতা, খুব নম্র, শান্ত স্বভাবের। ওর বাবা নেই। দাদা প্রাইভেট সংস্থায়, বেতন কম। চার বোন মা কে নিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরোনোর অবস্থা। পুষ্পিতা হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে ছোট একটা নার্সিংহোমে চাকরি করত।‌ সংসারে টিকে থাকার লড়াইয়ে ওরা চার বোন আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছিল।‌ ইতিমধ্যে পুষ্পিতার বিয়ে হয়ে যায়। জামাইকে উপরে দেখে ভাল মনে হলেও আসলে তা নয়। কয়েকমাসের মধ্যেই মানসিক টর্চার শুরু হয়। আর আজ একেবারে চরম অবস্থা। পরদিন সকালে, আমরা গিয়ে একরকম জোর করেই পুষ্পিতাকে নিয়ে চলে আসি। তখন পুষ্পিতা সন্তানসম্ভবা। ওরা ফিরিয়ে নিয়ে যেতে এসেছিল। পুষ্পিতা অনড়,ও বাড়িতে আর ফিরে যেতে চায় নি। বিয়েটা যাতে না ভাঙ্গে, বোঝানো হয়েছিল, কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। ডিভোর্স হয়ে গেল। পুত্র সন্তানের জন্মের পর শুরু হয় একার সংগ্রাম। চরম দারিদ্র্যের মধ্যে বড় হতে থাকে পুষ্পিতার ছেলে। অসম্ভব জেদ, হারতে রাজী নয়, সে একাই মানুষ করবে তার সন্তানকে। ভীষণ ধৈর্য, শত অভাবের মধ্যেও হাল ছেড়ে দেয় নি। রাতে দিনে ডিউটি, হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে বড় করে তোলে, লেখাপড়া চালিয়ে যায় ছেলের। হায়ার সেকেন্ডারির পর আর পারে না। কম্পিউটার ট্রেনিং নিয়ে এখন চুক্তিভিত্তিক একটা কাজে রয়েছে ছেলেটা। অপরাজিতা পুষ্পিতার লড়াই এখনও জারি কোন এক আলোকবর্তিকা সন্ধানে।

বীরাঙ্গনা

ট্রেজারী বিল্ডিং-এর পাশে বসে মোমো বিক্রি করত মেয়েটা।‌ প্রায়ই খেতাম মোমো,স্বাদ বেশ ভালোই।‌ বয়স বেশি নয়, ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ হবে। কিন্তু সংসারের চাপে ভীষণ দুখী মনে হত। বেশ কিছুদিন যাবৎ আর দেখতে পাই না মেয়েটিকে। ব্যাপারটা ভুলেই গিয়েছি।‌ সেদিন ছুটি, একটা কাজে স্কুটিতে ঘুরছিলাম।‌ পাশের পাড়ায় একটা খাবারের দোকানে দেখলাম ওকে, দোকানটার নাম মোমো ম্যাজিক। কৌতূহলে দাঁড়ালাম। ভাবলাম, মোমো নিয়ে বসে না, এই দোকানে কি কাজ নিয়েছে। চোখাচোখি হতেই হেসে এগিয়ে এল, বলল, আসুন দাদা,বসুন, কি খাবেন বলুন। বসলাম ওর দোকানে। সব শুনে আমি তো অবাক! খুব গরিব ওরা। কলেজে ভর্তির পরই বিয়ে হয়ে যায় অপর্ণার। কয়েকদিন পর বুঝতে পারে, স্বামী মদ্যপ, অসভ্য। প্রতি রাতে নেশা করে অকথ্য গালিগালাজ করত। সেদিন অত্যাচার চরমে, পেটে লাথি মারল। আর সহ্য করেনি অপর্ণা। অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় এক কাপড়ে বেরিয়ে আসে। জেদি অপর্ণা ও বাড়ি ফিরতে রাজি নয়। আত্মসম্মান নিয়ে একাই বাঁচবে সে। শুরু হয় একা টিকে থাকার লড়াই। সন্তানের জন্ম, দেখাশোনা, বড় করে তোলা, সব একাই সামলেছে।‌ অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়েছে, ছেলে এখন ক্লাস ফোরে। মোমো বিক্রি ভাল বুঝে ওখানে না গিয়ে বাড়িতেই দোকান শুরু করেছে, এখন বেশ জনপ্রিয় অপর্ণার মোমো ম্যাজিক। এছাড়াও একটা অনাথ আশ্রমের পাঁচজন দুঃস্থ শিশুর দায়িত্ব নিয়েছে অপরাজিতা অপর্ণা।‌ ভাবি, এত কষ্টের মাঝেও এত উদ্দীপনা কোথায় পায়,কত বড় মন থাকলে এটা হয়! সত্যিই বীরাঙ্গনা অপর্ণা!

চা দিয়ে রায় চেনা

“বাবলু, চা দে…..”বটতলার চা-দোকানে দূর থেকে হাঁকলেই বাবলু একবার শুধু মুখের দিকে তাকিয়েই মুহূর্তে মনে করে নেয়, লিকার চা চিনি ছাড়া, দুধ ছাড়া চিনি-চা, দুধ দেওয়া চিনি বা চিনি দেওয়া লিকার চা, কোনটা কাকে দিতে হবে। জীর্ণ ঢোলা প্যান্ট ততোধিক ময়লা রঙচটা জামার ট্রেডমার্ক বাবলুর উজ্জ্বল চোখ দুটো ভীষণ মায়াবী। হামেশাই অফিসে চা দিতে আসত বাবলু, বড় অভাবী, প্রায়ই পাঁচ-দশ টাকা দিতাম, তাতে অভাব কি আর মিটত, বড় মায়া হত।‌ চা-বিলাসী রসিক বাঙালি কম নেই বিষ্ণুপুরে, শান্তিদার চায়ের টানে দূর-দূরান্ত থেকে খদ্দের আসত। স্পেশাল চা নয়, একটু কষা হালকা মিষ্টি সাধারণ চা শান্তিদা নিজে তৈরি করতেন, বাবলুও এই চা তৈরি করতে শিখে গিয়েছিল। ভাবতাম, এত শত শত খরিদ্দার, কে কোন চা পছন্দ করেন, মুহূর্তে বুঝে নিয়ে ঠিক চা-টি বাড়িয়ে দিত কি করে বাবলু। এক অন্য কৌশলে চা বানাতেন শান্তিদা, পরে বাবলু। চা দিয়েই বাবলু চিনে নিতে পারত খদ্দেরকে। খদ্দেরকে সন্তুষ্ট রাখতে পারলে ওর আলাদা লাভ, পুজোর পাব্বনি-টা ভাল পেত যে! শান্তিদা আর নেই, বাবলুও প্রয়াত, কিন্তু সেই চা আপন মহিমায় আজও মহীয়ান, শান্তিদার ছেলেরা বজায় রেখেছে মিঠেকড়া অপূর্ব চায়ের স্বাদ, আমরাও এতটাই অভ্যস্ত যে চায়ে চুমুক দিয়েই বলে দিতে পারি এটা শান্তিদার দোকানের চা। সত্যিই চা দিয়ে চেনা যায়,কার চা!

ঠিকানাটা বলতে পারেন

মেট্রো শহরে ঠিকানা খুঁজে পেতে মফস্বলের মানুষ সমস্যায় পড়েন, সংশয়ে ভোগেন। চিকিৎসার কারণে, চাকরীর ইন্টারভিউ, পড়াশোনা কিম্বা অন্য কোন কারণে বড় শহর কলকাতা, দিল্লী, ব্যাঙ্গালোর এসব জায়গায় এখন প্রায় ছুটতে হয় অনেককেই। অজানা শহরে উৎকণ্ঠা হয়, যদি দুষ্ট চক্রের পাল্লায় পড়েন, পকেটমারী, ছিনতাই হয়, নানা অজানা বিপদের আশঙ্কা জাগে মনে। ঠিকানা খুঁজে বের করার ব্যাপারে সুরেশ ওর তুতোভাই নিমাইদার উপর নির্ভর করত, এক কথায় সুরেশের ফ্রেণ্ড-ফিলোজাফার এণ্ড গাইড। নিমাইদার সঙ্গে চাকরীর পরীক্ষা, চিকিৎসার জন্য গিয়েছে অনেক জায়গায়, প্রায়ই বলত সুরেশ, রাস্তায় ঠিকানা খুঁজে পেতে কি ধরণের লোকের কথা বিশ্বাস করা যায়, ও খুব ভাল বুঝত। এ অভিজ্ঞতা পরে আমার খুব কাজে লেগেছে কলকাতায় অবাঙালী কাউকে ঠিকানা জিজ্ঞাসা করলে ওরা বলতেন, ইঁহা সে সামনেই হ্যায়, বাঁয়ে মোড়কে বগলমে চলা যাইয়ে, মিল যায়েগা।“ হাড়ে হাড়ে বুঝেছি, ওই বগলমে, মোটেই খুব কাছে নয়! তখন ছাত্র সুরেশ, কলকাতায় ইউ.পি.এস.সি.‘র পরীক্ষা দিতে গিয়েছে, সঙ্গে নিমাইদা। সহজেই ঠিকানা খুঁজে পেয়ে গেল, সঠিক সময়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে পৌঁছে যথারীতি পরীক্ষা দেওয়া হয়ে গেল, কিন্তু বাড়ী ফেরার ট্রেন বা বাস নেই। হোটেলে থাকার অনেক খরচ; নিমাইদা পরিচিত এক ব্যবসায়ীর স্টোর রুমে থাকার ব্যবস্থা করে ফেলল। দুজনে নাইট শোতে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল, ফেরার সময় ঠিকানা ভুল, মাঝরাতে সে কি হয়রানি! প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর ঠিকানায় পৌঁছে দেখি বিল্ডিং-এর গেট বন্ধ। কি ঝকমারি, দরজা ঠোকার আওয়াজে পুলিশ ছুটে এল। ভাগ্যিস তখন কেয়ারটেকার নেমে এসেছিল, অনেক অনুনয়-বিনয় করে সে যাত্রা পার পেয়েছিল, বলছিল সুরেশ। সেদিনকার সেই প্রথম কলকাতায় পরীক্ষা দেওয়ার স্মৃতিকথা এখনও মাঝে মাঝেই শেয়ার করে বন্ধু সুরেশ।

ফাঁদ

কাজলীকে সুরেশের মা খুব ভালবাসতেন, খুব ছোটতে এসেছিল তো! ওর মা-ই ওকে যত্ন করেছেন, বড় করেছেন। ওদের চারটির মধ্যে ওই কাজলীকেই মা, শুধু মা কেন সুরেশের পরিবারের সকলেই খুব ভালবাসতেন ওর ঠাণ্ডা স্বভাবের জন্য। ধূসর মোলায়েম চকচকে সারা গা, গলা থেকে চোখের কোল পর্যন্ত কালো রঙ, তাই ওরা নাম দিয়েছিল কাজলী। বড় মায়াময় ওর কাজলপরা চোখগুলো। সুরেশ কথায় কথায় সেদিন বলছিল ওদের পরিবারের কিছু কথা, খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু সুরেশ। ওর মনটাও সরল, তাই আমার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। মানুষ সহানুভূতি পেলে অনেক সময় মনের আবেগে ভেতরের কথা বলে, বুকের ভিতরটা হালকা হয়। বলছিল সুরেশ, ওদের পরিবারে তখন খুব অভাব ছিল, ওর বাবার খুব সাধারণ একটা সরকারী চাকরী, তার উপরে ওরা তিন ভাই,,দিদি আর বাবা-মা, মোট ছয় জনের সংসার। কষ্ট করেই লেখাপড়া শিখেছে সুরেশ, আমার সহপাঠী তো, দেখেছি খুব কাছ থেকে প্রতিদিন। ওদের কিভাবে ফাঁদে পড়তে হয়েছিল সুরেশের মুখেই শুনি বরং, ভাল লাগবে।, খুব কষ্টে, বড় হয়েছি, বলছিল সুরেশ, রীতিমত লড়াই করে, সংসারে অভাব ছিল, কিন্তু কষ্টে ছিলাম না আমরা। ঘরের জন্য মা নিজেই মুড়ি ভেজে নিতেন। সেজন্য ঝাঁটি-কাঠ কিনতে হতো। বিষ্ণুপুরের পাশের গ্রাম দালানডাঙা থেকে কাঠ দিতে আসত এক মাঝবয়সী মহিলা। লম্বা পাতলা ঢ্যাঙ্গা বলে ওকে ঢেঙি বলত পাড়ার সবাই। তা থেকেই মা ঢেঙিদি বলতেন, আমরা ঢেঙিমাসী বলতাম। প্রায় আসত, কাঠের বোঝাটা মাথা থেকে দুম করে ফেলত উঠোনে। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে জল খেত, চা করে দিত মা, তারপর বেশ আয়েশ করে বিড়ি ধরাত। সুরেশ বেশ হেসেই বলছিল, আমরা অবাক হয়ে দেখতাম,কোন মহিলাকে বিড়ি খেতে দেখিনি তো, তাই। কাজলী তখন পূর্ণ গাভী। বাড়ির সব কাজ একা হাতে সেরে সন্ধেবেলায় মা আর পেরে উঠতেন না। সংসারের কাজ ছাড়াও গোয়াল পরিষ্কার একটা বড় কাজ। সুরেশ তখন খুব ছোট, ওর দিদিও করত, মায়ের সঙ্গে থেকে টুকটাক কাজ করে দিত, কিন্তু বেশ কিছুদিন ধরে মা আর পারছিল না গরুর চর্চা করতে । তাই, বাড়িতে পালন করবে এই শর্তে গরুগুলো একে একে বিক্রি করা হচ্ছিল। ঢেঙ্গিমাসীর লোভ হয়েছিল বুঝতে পারতাম, কিন্তু মুখে বলতে পারেনি, সুরেশের মা যখন কাজলীকে বিক্রির প্রস্তাব দিল, ঢেঙিমাসী খুব খুশী, প্রস্তাবটা যেন লুফে নিল। এককথায় রাজি, কিছু বেশি টাকাই দিতে রাজি হল। মা যেন এরকমই চাইছিলেন। এত পরিচিত ঘনিষ্ঠ মানুষের ঘরে কাজলী ভালই থাকবে। আমরাও রাজি হলাম। ঢেঙি কিনে নিয়ে গেল কাজলীকে। আসলে মা ঢেঙীমাসীর কথার ফাঁদে পড়ে গিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, নিজেও পারছি না, ঢেঙী মানুষটা ভাল, যদি কাজলীকে যত্নে রাখে, তবে যাক। খুব কষ্ট হয়েছিল মা’র, আমাদেরও। চোখে জল দেখেছিলাম মায়ের। কাজলী প্রথমে বুঝতে পারেনি, ওকে গলায় মাথায় হাত বুলিয়ে ঢেঙীমাসী নিয়ে চলে গেল। কাজলীকে দেওয়ার পর থেকে মা কেমন মনমরা হয়ে গেলেন, কথায় কথায় হা-হুতাশ করতেন। মায়ের মনমরা দেখে খুব খারাপ লাগত। আমরা বুঝতে পারছিলাম মায়ের কষ্ট। রাত্রে মায়ের ঘুম হত না, খাওয়া কমে আসছিল। এসব দেখে বাবা ঢেঙীমাসীর কাছ থেকে কাজলীকে ফেরত চাইতে বললেন মা-কে। বলা হোল, কিছুতেই রাজী তো হোলই না, তারপর থেকে আসা-যাওয়া বন্ধ করে দিল ঢেঙিমাসী। বেশি টাকার লোভ দেখানো হল কিন্তু কিছুতেই কিছু হল না। আর ফিরে পেলাম না কাজলীকে। বহুদিন পর সুরেশদের পাশের পাড়ায় রাস্তার ধারে কাজলকে মাঠে চরতে দেখেছিল। বলছিল সুরেশ, জানিস, কাছে গিয়ে গলায় হাত বোলাতে করুণ চোখে তাকিয়েছিল। ঘরে ফিরে মা-কে বলতেই বললেন, তাই! চল আমাকে নিয়ে! তখন সন্ধে হয়ে গিয়েছে। মাকে আশ্বস্ত করেছিলাম পরে দেখতে পেলেই ডাকব তোমায়, এই বলে। বহুকাল কাজলীর আক্ষেপ যায়নি সুরেশের মায়ের মন থেকে। এখন ওর মা নেই, কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়লে কাজলীকেও মনে আসে। বলতে বলতে চোখ ছল ছল করছিল সুরেশের। সুরেশদের এই কাহিনী শুনেছিলাম, ঘটনার প্রায় বছর দশেক পর; ফাঁদে পড়ে ওর মায়ের অবস্থা থেকে শিক্ষা নিয়েছিলাম আমরা, যতই আপন মনে করি না কেন, নিজের স্বার্থের বাইরে গিয়ে ত্যাগ করার মত মানুষ কমই থাকে। ফাঁদে পড়ার এরকম অজস্র উদাহরণ ছড়িয়ে আছে দুনিয়ায়।

এখন ডিজিটাল যুগ, অনলাইন সিস্টেমে সব কাজ হয়। হাতে হাতে মুঠোফোন, অনলাইন কেনাকাটা, ফাণ্ড ট্রান্সফার, বিভিন্ন অ্যাপে টাকা লেনদেন হয়, কম্পিউটার হ্যাকাররা সব শিক্ষিত বুদ্ধিমান, যত আঁটসাট হয় সিকিউরিটির কৃৎকৌশল, তত নতুন কায়দায় ফাঁদ তৈরী করে ব্যাঙ্কের গ্রাহকদের তথ্য হাতিয়ে নেয় ওরা, পাসওয়ার্ড জানতে পারলেই বাজিমাৎ। ব্যাঙ্ক কর্তৃপক্ষ যতই সাবধান করুন না কেন, হ্যাকারদের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেন বারে বারে আর বোকামি করে ফেলেন সরল মানুষ। চাকচিক্য দেখিয়ে প্রেমের ফাঁদে ফেলে ঘনিষ্ঠতার সুযোগ নেওয়া, গয়না, টাকাপয়সা হাতানোর ঘটনা হামেশাই খবরে আসে। প্রেমের ফাঁদে পড়ে স্বামী-সন্তান ফেলে প্রেমিকের সঙ্গে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনাও শিরোনামে আসে। নীতি নৈতিকতা মূল্যবোধ, সততা, মানবিকতা এসব শব্দ বোকাদের জন্য, চালাক ঠকবাজদের ভাবনাটা এরকমই; যেভাবে হোক অর্থ উপার্জন, নিজে সুখে থাকার বাসনায় মত্ত লোভী মানুষ। পুরাণের গল্পগাথায় এরকম অনেক কাহিনী আমরা জানি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ত্রয়োদশ দিনে অপ্রতিরোধ্য পান্ডবদের পর্যদুস্ত করতে মরিয়া কৌরব সেনাপতি দ্রোণাচার্য বীর সেনাদের দিয়ে চক্রব্যূহ রচনা করেন। চক্রব্যূহে প্রবেশ ও নির্গমনের কৌশল অর্জুন জানতেন। অর্জুনের কিশোর পুত্র অভিমন্যু চক্রব্যূহে প্রবেশ করতে জানতেন, কিন্তু নির্গমনের কৌশল জানতেন না। যুদ্ধের প্রয়োজনে অর্জুনের অনুপস্থিতিতে সাহসী বীর অভিমন্যু জীবন বাজি রেখে দ্রোণাচার্যের তৈরি ঐ ফাঁদে প্রবেশ করেন, বীরবিক্রমে যুদ্ধ করে কৌরববাহিনী ছত্রভঙ্গ করে দেন। তখন অন্যায় পথে কৌরব সেনারা পিছন থেকে আক্রমণ করল, অভিমন্যু চক্রব্যূহ ভেদ করতে পারলেন না, নিরস্ত্র অভিমন্যুকে বধ করলেন কৌরব বীরপুঙ্গবের দল। এই চক্রব্যূহের কৌশল অনুসরণ করেই কাবাডি খেলায় বিপক্ষ দলকে ফাঁদে ফেলা হয়। আবার, ফাঁদ পেতেই মাছ ধরেন জেলে, তাই তো মাছে-ভাতে থাকে বাঙালী! ছিপের ফাৎনা নড়ার অপেক্ষায় বসে থাকার অভ্যাস তো কোন ছোটবেলাতেই ছিল আমাদের, টিকিট কেটে ছিপে মাছ ধরার ফাঁদ পেতেও বসেন শখের মৎস্যশিকারি। আসলে ফাঁদ পাতা আছে গোটা দুনিয়ায়, সাবধানতার যত পথ বের হয়, আরও নতুন কায়দায় চলে ফাঁদ পাতা। ফাঁদের কথায় আরও অনেক কিছু কথা মনে আসে যা আমরা কল্পনাও করতে পারি না, অবাক হই, ভাবনাতেও আসেনি যা সেটাই তাই ঘটে যায় অবলীলায়!

নেট দুনিয়ায় সরল সাধাসিদে মানুষকে ফাঁদে ফেলে অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা আত্মসাৎ করে এক শ্রেণীর বুদ্ধিমান দুর্বৃত্ত। নানান কায়দায় মানুষকে ফাঁদে ফেলতে কৃতকৌশল উদ্ভাবন করে নতুন নতুন। আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল বিগত পাঁচ বছর আগেও, অনলাইন পরিষেবায় মানুষ এত যন্ত্রনির্ভর হয়ে উঠবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় উল্লম্ফন গতি, কোথায় নিয়ে যেতে চলেছে মানব সভ্যতাকে! মানুষের সৃষ্টিশীলতা কি এভাবে পথ হারাবে। ইন্টারনেট মাধ্যমে নগ্নভাবে নিজেকে তুলে ধরার কি উদগ্র বাসনা, ফাঁদে ফেলতে নানান রঙিন অ্যাপ, একটা চাইলে হাজারটা সুযোগ। নিজেকে জাহির করা, নিজের সৌন্দর্যকে সবার সামনে তুলে ধরার সুবর্ণ সুযোগ। নানান ফাঁদে নানান স্বাদে নানান ভঙ্গিমায় মানুষের রূপের পসরা। জাল পাতা আছে আমার আপনার চারিদিকে, কোন কিছুই এখন গোপন নেই, কোন আব্রু নেই। ব্যক্তিগত তথ্য সরকারী নানান কায়দায় অন্তর্জালের সঙ্গে যুক্ত হতে হচ্ছে, নইলে বাঁচার উপায় নেই। আমার চাহিদা কি, কি খেতে পছন্দ করি, কি পরতে ভালবাসি, কি ধরণের ছবি, কি ধরণের লেখা ভালবাসি সব, সবকিছু নিমেষে চোখের সামনে হাজির। এমন সুকৌশলে মানুষের মনের কথা জেনে যাচ্ছে কি করে। টেকনোলজির কি উল্লম্ফন গতি, ফাঁদে ফেলার অন্তর্জাল ছড়িয়ে রয়েছে আমার চারদিকে। নিস্তার নেই। মোবাইল থেকে, ইন্টারনেট পরিষেবা থেকে পালিয়ে যাবার উপায় কিছু জানা নেই। কত দিন পরিষেবা না নিয়ে থাকবেন। একসময় আত্মসমর্পণ করতেই হয় আমাদের মত গৃহী মধ্যবিত্ত ছা-পোষা মানুষকে। নিজের ঢাক নিজে পেটানোর কি নির্লজ্জ বহিঃপ্রকাশ! এসব তো আগে কল্পনাই করা যেত না, মানুষের মনোজগতের উপর ইন্টারনেট এত দ্রুত প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এই তো মাত্র দুবছর আগেও কোভিডের সময়, আমরা কখনো ভেবেছিলাম কি, একটা সাত-আট বছরের শিশু দিব্যি নিজে মোবাইলে স্কুলের দেওয়া লিঙ্ক খুঁজে নিয়ে অনলাইন ক্লাসে যোগ দিচ্ছে, চ্যাট করছে, ভার্চুয়াল মাধ্যমে পরীক্ষা দিচ্ছে। এটাও ফাঁদ কি সুন্দর বাচ্চা ছেলেটা মোবাইলে ক্লাস করছে, গর্ববোধ হয় বাবা-মায়ের। এত অল্প বয়সে আমরা কিছু জানতাম-ই না। কত এগিয়ে গিয়েছে আমার আপনার ভবিষ্যৎ। না: ! আপাত ক্ষতি কিছু দেখা যাবে না। কিন্তু এত গতি, এত রকেটীয় গতির শেষ কোথায়, কোথায় চলেছি আমরা এই ফাঁদ পাতা দুনিয়ায়। এখন ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং হচ্ছে যখন-তখন, অফিসিয়াল মিটিং কিম্বা দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে জরুরি আলোচনা কিম্বা ফোন-কনফারেন্সে আলোচনা, সশরীরে উপস্থিত না হয়েও সিনিয়ার ডাক্তারের নির্দেশে জটিল অস্ত্রোপচার কিম্বা ভি. সি. তে চাকরীর ইন্টারভিউ। কল্পনার অতীত ছিল আমার মায়ের এভাবে চলে যাওয়া। ক’বছর আগের কথা, প্রচণ্ড ঠাণ্ডা লেগে শ্বাস-প্রশ্বাসের অসুবিধা, ডাক্তারবাবুর পরামর্শে বিষ্ণুপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করা হল,পরের দিনই বাঁকুড়া মেডিকেল কলেজে আই. টি. ইউ. বিভাগে। পাঁচদিন ধরে পরীক্ষা নিরীক্ষা হল, বুকে সর্দি জমেছিল। কড়া ডোজের স্টেরয়েড ইনজেকশন শরীরে আর নিতে পারলেন না মা। চলে গেলেন কল্পনার ওপারের জগতে।

ফাঁদ পাতা এই দুনিয়ায় এরকমই কল্পনায় না আসা অনেক কিছুই ঘটে চলে প্রকৃতির আঙিনায়, তারই মাঝে বয়ে চলে মানুষের জীবনপ্রবাহ। মনে হয় পৃথিবীটা কত ছোট হয়ে গিয়েছে। গোটা পৃথিবীটাকেই আমার ঘর মনে হয়। পৃথিবীকে আপন ঘর ভাবার মত মুক্তমনা বিশ্ব নাগরিক বোহেমিয়ান মানুষ পৃথিবীতে কম নেই। ড: ভূপেন হাজারিকার গানের লাইনগুলো মনে আসে, আমি এক যাযাবর, পৃথিবী আমাকে আপন করেছে, ভুলেছি নিজের ঘর……। দুই দশক আগেও আমরা যা ভাবতে পারতাম না, অজানা পৃথিবীটা এখন হাতের মুঠোয়! অজানা দেশ, অচেনা মানুষ, অচেনা সংস্কৃতি, অপরিচিত পরিবেশ এখন আর দূরে নেই, বিশ্বায়ন সেই দূরত্ব ঘুচিয়েছে। ভৌগোলিক কারণে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে পৌঁছানো সম্ভব না হলেও ভার্চুয়াল জগতে স্বচ্ছন্দেই ঘোরাঘুরি করতে পারি। এখন খুব সহজেই আমেরিকার ছাতা, জাপানের জুতা, ব্রিটেনের গাউন, থাইল্যাণ্ডের মোবাইল, কিম্বা চিনের ইলেকট্রনিক্স দ্রব্য ঘরের দরজায় হাজির হচ্ছে। জি.আর.ই. – টোয়েফল দিয়ে কিম্বা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পড়তে যাওয়ার সংখ্যাটা দুই দশক আগেও অল্প ছিল। ফ্রান্স কিম্বা বস্টনের বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাসের ফাঁকে লনে বসে ভিডিও-কলে আপনার ছেলে-মেয়ে আপনাকে দেখছে, কথা বলছে, আপনি যখন-তখন ভিডিও কনফারেন্সে মিটিং করছেন, তখন মনেই থাকে না মাঝখানের দূরত্ব কতটা। দুই দশক আগেই যখন গ্লোবালাইজেশন হয় নি, তখন এসব কল্পনাতেই আসত না। পৃথিবীটাকে এখন সত্যিই একটা বিশ্ব-গ্রাম মনে হয়। বিশাল পৃথিবীর দিগন্ত ব্যাপ্ত আকাশ এক ক্ষুদ্র পরিসরে মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের খবর, ছবি,ভিডিও নিমেষে চলে আসছে হাতের মুঠোয়। মনে হচ্ছে আমরা বৃহত্তর জগত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ক্রমে সংকুচিত পরিধির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি। পৃথিবীর এখন এটাই সংকট। আমরা তো বিশাল পৃথিবীটাকে হাতের তালুর মধ্যে আমলকীর মত হয়ে যাক, ভাবতে পারি না। আকীর্ণ, অনন্ত অফুরান পৃথিবীকে পরিশ্রম করে জয় করতে চাই। যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে মানুষ কেমন করে ঘুরছে দেখতে চেয়েছেন কাজী নজরুল তার সংকল্প কবিতায়। অজানাকে জয় করার আনন্দ আমরা পেতে চাই কিন্তু কোন ফাঁদে পড়তে চাই না। চাই না বললেই বা ছাড়ছে কে ? কিন্তু সেলফোনে তো বিশ্ব জয় করা যায় না। সেলফোন ক্রমশ: জড়িয়ে ফেলছে জীবনের জটিল ঘুলঘুলাইয়ার ঘূর্ণাবর্তে। পৃথিবীর আবর্তন গতিতে ঘূর্ণায়মান আমরা সবাই। মহাবিশ্বের মহা-ফাঁদে পড়ে আমরা হাঁকপাঁক করছি। এর থেকে মুক্তির উপায় জানা নেই।

বৃদ্ধাশ্রম

যদিও আমরা সবাই জানি কেউ কারো নয়, প্রত্যেকে স্বতন্ত্র মানুষ, একা পৃথিবীতে আসে আর একাই বিদায় নিতে হয়, তবুও আমরা বড় আশাবাদী। আশা-ই সংসার। তবুও আমরা বাঁচি সংসারের জন্য মা বাবা স্ত্রী পুত্রকন্যা পরিবারের জন্য ।আশায় বাঁচে চাষা। বড় আশা নিয়ে নিজেদের জীবনের সবটুকু সময়, সঞ্চয় বিনিয়োগ করে সন্তানকে মানুষ করি, সুশিক্ষিত করি, নিজের জন্য কিছু না রেখেই। যে মা নিজের দু:খ কষ্ট বুকে চেপে রেখে আরামকে হারাম জ্ঞান করে সন্তানের হাসি মুখ দেখার পাগল হয়েছেন, সন্তান না খেলে নিজে খেতে পারেন না, সন্তান না ঘুমালে নিজে ঘুমাতে পারেন না, অসুস্থ হলে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকেন সন্তানের শয্যার পাশে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত। বৃদ্ধ বয়সে এসে সেই সন্তান তার নিজের পরিবারের জন্য খরচ যোগাতে হিমশিম খায় আর বাবা-মাকে বোঝা মনে করে। নিজে স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে নিয়ে আরও একটু ভাল থাকার জন্য বাবা-মা কে পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে। নয়তো বা অবহেলা দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করে যাতে বাবা-মা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে। কেউ বা যথেষ্ট রোজগার করেও নিজে পরিবার নিয়ে জীবনকে উপভোগ করার জন্য বাবা-মা কে দূরে সরিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেন। শেষ বয়সে ছেলে,ছেলের বউ নাতি-নাতনি নিয়ে সুখ-দু:খ ভাগ করে বাঁচার চেষ্টা করেন অনেকে, কিন্তু সন্তান বাবা-মায়ের সেই ইচ্ছের কোন দাম দেয় না। যে বাবা-মা ছাড়া ছোটবেলায় কিছু্ই জানত না তাঁদের আত্মীয় পরিজনহীন নির্বাসনে পাঠায় কি করে, দয়ামায়ার কি কোন স্থান নেই ঐসব সন্তানদের, এত কঠোর, এত নির্মম হয় কি করে ওরা। আপনার চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম – এই সত্যকে অনেক বাবা-মা মেনে নিয়ে বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় নেন। সন্তানের কাছ থেকে আর চাওয়া পাওয়ার নেই কিছু ওঁদের। যতই ঝাঁ চকচকে বিল্ডিং, বেড়ানোর বাগান, ঝকঝকে ঠাকুর মন্দির, ধবধবে শয্যা, হাত বাড়ালেই ডাক্তার – এসব দেখানো হোক না…মন কি ভরে তাতে; বাধ্য হয়েই যে মেনে নিতে হয়। বেশ ভালো অঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট না দেখে নেয়ও না বৃদ্ধাশ্রম কর্তৃপক্ষ। এখন অনেক উচ্চবিত্ত নি:সন্তান দম্পতি আগে থেকেই অবশ্য বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়ার পরিকল্পনা করে রাখেন, তাদের কথা একটু পৃথক। কিন্তু গরীব নিম্নবিত্ত বাবা-মারা কি করবেন। কর্মজীবনে সন্তানদের মানুষ করতে তো সব গেছে, অবসরের পর মাথা গোঁজার মত একটা আস্তানা ….হাতে আর থাকে কি… ভাল ভাবে বেঁচে থাকার মত গাঁটের কড়ি কই হাতে!

আজ যারা বৃদ্ধ তারা নিজেদের জীবনের সবটুকু সময়, ধনসম্পদ বিনিয়োগ করেছিলেন সন্তানের জন্য, নিজের জন্য রাখেননি কিছুই। কিন্তু বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের কাছ থেকে এর একটি ক্ষুদ্র অংশও তারা পাচ্ছেন না। কখনো দেখা যায়, সন্তান তার নিজের পরিবারের খরচ জোগাতে হিমশিম খাচ্ছে, তাই বাবা-মাকে মনে করছে বোঝা। নিজে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একটু ভালো থাকার জন্য বাবা-মার ঠাঁই করে দিয়েছেন বৃদ্ধাশ্রমে। আবার এমনও দেখা যায়, সন্তানের টাকা-পয়সার অভাব নেই, কিন্তু বাবা-মাকে নিজের কাছে রাখার প্রয়োজন বোধ করছে না, বা বোঝা মনে করছে। হয় নিজেই পাঠিয়ে দিচ্ছে বৃদ্ধাশ্রমে, নয়তো অবহেলা ও দুর্ব্যবহার করে এমন অবস্থার সৃষ্টি করছে- যেন তাদের বাবা-মা নিজেরাই সরে যান তার সাধের পরিবার থেকে।

বৃদ্ধাশ্রম মানে বৃদ্ধদের আশ্রয়স্থল। বর্তমান সময়ের দিকে লক্ষ্য করে বললে, বলতে হবে- বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য পরিবার ও স্বজনদের থেকে আলাদা আবাস বা আশ্রয়ের নাম বৃদ্ধাশ্রম। মূলত অসহায় ও গরীব বৃদ্ধদের প্রতি করুণার বোধ থেকেই হয়ত বৃদ্ধাশ্রমের সৃষ্টি- যেখানে বৃদ্ধদের প্রয়োজনীয় সেবা ও আশ্রয়ের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু বৃদ্ধাশ্রমের সেই ছবি এখন আর নেই। এখন যা আছে তা হল, ছোট বেলায় যে বাবা-মা ছিলেন আমাদের সবচে’ বেশি আপন, যাদের ছাড়া আমরা কিছুই করতে পারতাম না, যারা নিজেদের আরাম হারাম করে আমাদের মানুষ করেছেন নিজের সব দুঃখ কষ্ট বুকে চেপে আমার হাসি মাখা মুখ দেখার জন্য যে মা ব্যকুল থাকতেন, আমি না খেলে যিনি খেতেন না, আমি না ঘুমালে যিনি ঘুমাতেন না, অসুস্থ হলে যিনি ঠায় বসে …

“আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম।” কঠিন এক সত্য। আর এ সত্যকে মেনেই অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানের কাছে যাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই; শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করবার ইচ্ছা এতোটুকুই যা চাওয়ার। আর এ নিয়েই প্রতিটি পিতা-মাতা প্রহর গুণতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে মস্ত ফ্ল্যাটের ঘরের কোণেও জনমদুখী মা-বাবার এতোটুকুও জায়গা মিলে না। ওদের ছুঁড়ে দেয়া হয় প্রবীণ নিবাসনামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানা বাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না। নাড়ী ছেঁড়া ধন ওরা। তাই চুপ থাকেন!

তবুও বৃদ্ধ গর্ব করে বলেন, ছেলে আমার মস্ত মানুষ, মস্ত অফিসার মস্ত ফ্ল্যাটে দেখা যায় না এপার ওপার। নানান রকম জিনিস আর আসবাব দামী দামী সবচেয়ে কম দামী ছিলাম একমাত্র আমি। ছেলের আমার আমার প্রতি অগাধ সম্ভ্রম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম। আমার ব্যবহারের সেই আলমারি আর আয়না ওসব নাকি বেশ পুরনো, ফ্ল্যাটে রাখা যায় না। ওর বাবার ছবি,ঘড়ি-ছড়ি, বিদেয় হলো। ওদের স্বামী-স্ত্রী আর আ্যালসেশিয়ান-জায়গা বড়ই কম আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।। নিজের হাতে ভাত খেতে পারতো না খোকা, বলতাম, আমি না থাকলে কি করবি রে বোকা? ঠোঁট ফুলিয়ে কাঁদতো খোকা আমার কথা শুনে- খোকা বোধ হয় আর কাঁদে না, বুঝি বা মনে নেই। ছোট্টবেলায় স্বপ্ন দেখে উঠতো খোকা কেঁদে্। এখন ওসব গালগল্প, আমার ঠিকানা তাই বৃদ্ধাশ্রম।

দর কষাকষি

“না দিদি, এই ঝুল-ঝাড়ুটা ৩০ টাকায় বিক্রি করতে পারলে ৫ টা টাকা লাভ থাকে, তার থেকে খুব জোর ২ টাকা কমাতে পারি, না দিদি, পঁচিশে কিছুতেই নয়, শেষ দাম আঠাশ!” বাড়ির দরজায় মহিলাদের সঙ্গে ফেরিওয়ালার এরকম দরকষাকষি ছবি খুবই পরিচিত। মধ্যবিত্ত বাঙালীর দু টাকা পাঁচ টাকার জন্য এরকম দরদাম করার অভ্যেস থেকেই থাকে। সবজি বাজারে দরকষাকষি তো করতেই হয়,নইলে ঠকে যাব যে,বিক্রেতারা দাম কমাতে হতে পারে বুঝে একটু বাড়িয়েই বলেন, যাতে লস না হয়। অনেকে দাম ফিক্স রেখে মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন,বিক্রি কম হয় হোক। আসলে আম বাঙালীর অভ্যেস যে দর কষাকষির, দাম না কমিয়ে কিছু কিনে ফেললে মনটা কেমন যেন খচখচ্ করে, তাইতো ঠকে গেলাম কি ! যদিও এখন অনলাইনে কেনাকাটা,দর কষাকষির প্রশ্নই নেই। ব্রাণ্ডেড জিনিসেও তাই। একটু এলিট শ্রেণীর দোকানে তো ফিক্সড প্রাইস। তবুও অভ্যেস যে, দর করতেই হয়। দর কষাকষির টাগ-অফ-ওয়ার কোথায় নেই! শুধু কেনাকাটাই নয়। বিয়ের ‘পাকা কথা’ও তো আসলে বরপণ নিয়ে দর কষাকষির আসর। যদিও ব্যতিক্রম আছেই। দর কষাকষি আবার সবার দ্বারা হয় না,এটা একটা আর্ট। কিছু কিনতে গিয়ে কোনো জিনিস খুব পছন্দ হলেও খুশীতে আত্মহারা হওয়া যাবে না, বিক্রেতা আপনার হাবভাব বুঝতে পারলেই ব্যস! আপনি বধ! বড় শহরে, যেখানে প্রচুর পসরা,অনেক হকার, সেখানে দর কষাকষি সাবধানেই করতে হয়,এখানে দুশো টাকার জিনিস পঞ্চাশ বলে ফ্যাসাদে পড়তেও পারেন। কিন্তু তবুও, দর কষাকষি চলবেই, অভ্যেসটা বাঙালির রক্ত-মজ্জায় মিশে আছে যে!

জয়ন্ত কুমার সরকার | Jayanta Kumar Sarkar

Valentine Day Speciality | ভালোবাসা দিবস | Top New Bengali Article 2023

Param Gyan O Sadhan Tathya | পরমজ্ঞান ও সাধন তত্ত্ব | New Article 2023

Ananta Bikeler Rupkathara | অনন্ত বিকেলের রূপকথারা | New Bengali Story 2023

Natun Bangla Galpo 2023 | গল্পগুচ্ছ | দেবযানি দত্ত প্রামাণিক | New Bengali Story

Shabdodweep Web Magazine | Online Bangla Hasir Golpo | Jayanta Kumar Sarkar

Bengali literature has always been a source of immense joy, with its rich storytelling traditions covering every emotion. However, nothing entertains as much as a well-crafted Online Bangla Hasir Golpo. Humour has always played an essential role in Bengali literature, adding light-hearted moments to everyday life.

Why Read Online Bangla Hasir Golpo?

With the increasing digital presence of Bengali literary works, reading Online Bangla Hasir Golpo has become an easy and enjoyable experience. Readers can explore a variety of Bangla funny stories from classic to modern eras, filled with wit, sarcasm, and relatable social humour.

Shabdodweep Web Magazine: A Hub for Bengali Humour

If you are searching for quality Bangalir Hasir Golpo, look no further than Shabdodweep Web Magazine. This online platform is dedicated to curating some of the best humorous stories written by Bengali writers. One such name is Jayanta Kumar Sarkar, who has contributed numerous Bengali stories that leave readers laughing and thinking at the same time.

The Role of Humour in Bengali Literature

Bengali literature is known for its depth, but humour has always been an integral part of it. From Sukumar Ray’s nonsense rhymes to contemporary social satire, Bangla funny stories provide not just amusement but also meaningful commentary on life and society.

Benefits of Reading Online Bangla Hasir Golpo

Unlimited Laughter: Humour relieves stress and brings joy.

Free & Easy Access: Explore an extensive Bengali story collection without any cost.

Variety of Content: Read everything from satire to light-hearted jokes.

Learn Bengali Culture: Get insights into everyday life through humorous narratives.

Engage with New Writers: Discover emerging Bengali writers alongside legends.

Popular Categories of Bangla Funny Story Available Online

Classic Bengali Humour: Timeless works from legendary authors.

Social Satire: Stories that comment on society with a touch of humour.

Children’s Comedy Stories: Light-hearted fun for younger readers.

Modern Day Humour: Contemporary tales reflecting today’s reality.

Political Satire: A witty take on current affairs and governance.

How to Read Online Bangla Hasir Golpo?

Visit Reliable Websites: Platforms like Shabdodweep Web Magazine provide high-quality Bangalir Hasir Golpo.

Browse Different Genres: Choose from satire, comedy, and witty storytelling.

Start Reading: Enjoy stories directly online without any downloads.

Stay Updated: Subscribe for new story releases.

Shabdodweep Web Magazine: Your Destination for Bengali Humour

At Shabdodweep Web Magazine, readers can explore an exclusive collection of Online Bangla Hasir Golpo, featuring the best of Bengali humour. With contributions from Jayanta Kumar Sarkar and many other talented Bengali writers, this platform is a treasure trove of literary entertainment.

FAQ – Online Bangla Hasir Golpo

Where can I read Online Bangla Hasir Golpo for free?

You can read Online Bangla Hasir Golpo for free on Shabdodweep Web Magazine, which offers a wide collection of humorous Bengali stories.

Who are the best Bengali writers of humour?

Many renowned Bengali writers have contributed to humour, including Jayanta Kumar Sarkar, whose works are featured on Shabdodweep Web Magazine.

What kind of Bangla funny stories can I find online?

You can find Bangalir Hasir Golpo, including satire, modern humour, classic comedy, and social parody, all available on platforms like Shabdodweep Web Magazine.

How often does Shabdodweep Web Magazine update its collection?

New Bangla funny stories are added regularly to keep readers entertained and engaged.

Can I contribute my own Bengali humour stories to Shabdodweep Web Magazine?

Yes, Shabdodweep Web Magazine welcomes submissions from aspiring Bengali writers who want to share their Bengali humour with a broader audience.

Why should I read Online Bangla Hasir Golpo on Shabdodweep Web Magazine?

Because it offers authentic, well-curated Bangalir Hasir Golpo by talented Bengali writers, including works by Jayanta Kumar Sarkar.

Is Bengali humour suitable for all age groups?

Yes, Bengali literature includes humour for all ages, from children’s funny tales to adult satire.

Can I download Bangla funny stories from Shabdodweep Web Magazine?

Currently, the stories are available for online reading only, ensuring easy access anytime.

How can I stay updated on new humorous stories?

Subscribe to Shabdodweep Web Magazine to receive updates on new Online Bangla Hasir Golpo and never miss a laugh!

What makes Bengali humour unique?

Bengali humour blends wit, satire, and social commentary, making it one of the most engaging forms of literature.

Reading Online Bangla Hasir Golpo is a delightful experience that connects readers to the joy of Bengali humour. With platforms like Shabdodweep Web Magazine, filled with works from Bengali writers like Jayanta Kumar Sarkar, literature lovers can enjoy a rich blend of comedy and storytelling. Start reading today and immerse yourself in the laughter-filled world of Bengali literature!


Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio

Leave a Comment