Best Story About Travel Experience | Haridwar to Varanasi

Sharing Is Caring:

হরিদ্বার থেকে বারানসী – জয়ন্ত কুমার সরকার

১ম পর্ব

তখন অ্যানড্রয়েড ফোন বাজারে এসে গেলেও এত রমরমা হয়নি। ২০১২ সাল, কাছে তখন উইন্ডোজ-এর স্মার্টফোন, ওটাই আমার সঙ্গী উত্তরভারত ভ্রমণে। অফিস কলিগ সঞ্জয়দা তখন আমাদের ভ্রমণের পরামর্শদাতা। সঞ্জয়দা খুব ভাল ব্রিজ খেলতেন। বিষ্ণুপুরে থেকে বিভিন্ন জায়গায় টুর্নামেন্টে খেলতে যেতেন। সেই সূত্রে সঞ্জয়দার অনেক ভাল ভাল ট্যুরিং স্পট ঘুরে আসার অভিজ্ঞতা ছিল। সঞ্জয়দার সঙ্গে কথাবার্তায় সেবার উত্তর ভারতের কিছু জায়গায় বেড়াতে যাওয়ার কথা চূড়ান্ত হয়ে গেল।

নিজেদের পরিকল্পনা, ট্যুর প্ল্যান, খরচের মোটামুটি হিসেব সবকিছু ঠিকঠাক করে পুরো জার্নিটা ট্রেনে যাওয়া হবে ঠিক হল। তখন ট্যুরিং এজেন্সি বিষ্ণুপুরে ছিলই না, রিজার্ভেশন করার জন্য কয়েকটা ধাবা ছিল। ধাবায় না গিয়ে আমরা নিজেরাই ট্রেন চয়েস করে রিজার্ভেশন করলাম। আমাদের আর এক কলিগ, কম্পিউটারে দক্ষ, মৃত্যুঞ্জয় আমাদের সবার পুরো জার্নিটার টিকিট অনলাইনে রিজার্ভেশন করে দিল। হাওড়া থেকে বোডিং আমাদের। বিষ্ণুপুর থেকে ট্রেনে হাওড়ায় গিয়ে মুল ট্রেনে উঠব। ভ্রমণপথটা ছিল : হাওড়া থেকে হরিদ্বার, ৩ দিন রাত্রিবাস। তারপর অমৃতসর, ১ দিন, রাত্রিবাস নয়। তারপর দিল্লি, ২ দিন রাত্রিবাস। তারপর আগ্রা, ১ দিন রাত্রিবাস। এরপর বেনারস, ৩ দিন রাত্রিবাস। বেনারস থেকে আসানসোল হয়ে বিষ্ণুপুর ফিরে আসা।

আমরা তিন সহকর্মী গোছগাছ শুরু করলাম। অফিসের বরিষ্ঠ সহকর্মী শ্রদ্ধেয় সঞ্জয় দাশগুপ্ত আমাদের পরামর্শদাতা ও পথপ্রদর্শক, সঙ্গে স্ত্রী মহুয়া বৌদি ও ছোটছেলে সৌরদীপ । ২য় সহকর্মী সঞ্চিত রক্ষিত, সঙ্গে স্ত্রী অমিতা, মেয়ে সুস্মিতা ও ছেলে সৌমজিৎ। ৩য় আমি, সঙ্গে স্ত্রী সোমা, মেয়ে পায়েল ও ছেলে দীপ। মোট ১১ জনের দল। শুভযাত্রার দিন নির্ধারিত হয়েছে ২৫শে জুন, ২০১২। রওনা হওয়ার দিন তিনেক আগে সবার পরিবারের মিট-টুগেদার হয়ে গেল সঞ্চিতদার বাড়িতে।

২৫ তারিখ সকালে ব্যাগ-ব্যাগেজ গুছিয়ে বিষ্ণুপুর স্টেশন থেকে পুরুলিয়া এক্সপ্রেস ধরলাম। বোর্ডিং পয়েন্ট হাওড়া। শুকনো খাবার সঙ্গে নিয়েছি সকলে। আগের বছর পুরী বেড়াতে গিয়েছিলাম সকলে,তখন থেকে সকলের মধ্যে সখ্যতা ছিল, এছাড়াও সঞ্জিতদার স্ত্রী আমার পাড়ার মেয়ে, আমার স্ত্রীর সঙ্গে বেশ ভালোই বন্ধুত্ব। সঞ্জয়দার স্ত্রীও খুব হাসিখুশি সহজ, বড়ো হিসেবে সকলকে নিজের মতো করে নিয়েছিলেন।

হাওড়া স্টেশনে আমরা যখন নামলাম বেলা সাড়ে এগারটা। হরিদ্বারগামী উপাসনা এক্সপ্রেস বেলা একটায় ছেড়ে যাওয়ার কথা। ব্যাগ-ব্যাগেজ সঙ্গে নিয়ে নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে উপস্থিত সকলে। গল্প করছি, ট্রেন ঢোকার অপেক্ষায়, সঞ্চিতদা আর সৌরদীপ ফুড-প্লাজায় দুপুরের খাবার আনতে গেছে। হঠাৎ সঞ্জয়দা মাথা ঘোরাচ্ছে বললেন। প্রথমে গুরুত্ব দিইনি, পরে অস্বস্তি শুরু হতে আমরা বেশ ঘাবড়ে গেলাম। ইতিমধ্যে সঞ্জয়দার বড় ছেলে সি-অফ করতে এসেছে। অবস্থা দেখে বাবাকে এই অবস্থায় ভ্রমণে যেতে দিতে চাইছে না কিছুতে। আমি আশ্বস্ত করার চেষ্টা করছি। অস্বস্তি বাড়ছে দেখে দুজনেই ছুটলাম ডাক্তার কোথায় পাওয়া যায়। এনকোয়ারিতে গিয়েও ডাক্তার মিলল না। দুশ্চিন্তা নিয়ে ফিরে আসছি।

ট্রেনের বেশি দেরি নেই। সায়ন্তন ওর বাবাকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় নিয়ে যাবে বলছিল। প্ল্যাটফর্মে ফিরে অবাক, সব গেল কোথায়! ইতিমধ্যে ঘোষণা শুনেছি, হরিদ্বারগামী উপাসনা এক্সপ্রেস প্ল্যাটফর্মে ঢুকছে। হন্তদন্ত হয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছি। কিছুক্ষণ পরে মেয়েকে দেখতে পেয়ে ধড়ে প্রাণ পেলাম। ওরা ব্যাগ-ব্যাগেজ জড়ো করে কামরার সামনে দাঁড়িয়েছিল। অন্যরা ইতিমধ্যে উঠে পড়েছে। কিন্তু সঞ্জয়দা! উনি কোথায়, পাঁচসাত ভাবতে ভাবতে কামরায় উঠে হতবাক। আরে! কী দেখছি, সঞ্জয়দা সিটে বসে পড়েছেন। আমাকে দেখে মুচকি হাসছেন। শুধু তাই নয়, বারমুণ্ডা-গেঞ্জি পরে লাগেজ তুলছেন সৌরদীপকে সঙ্গে নিয়ে! একগাল হেসে বললেন, ভায়া, কোনো চিন্তা নেই, আমি পুরো ফিট। তোমরা গুছিয়ে বসে পড়ো।

সায়ন্তনকে আমরা আশ্বস্ত করলাম। আমরা নিজের নিজের বার্থে লাগেজ তুলে নিলাম। ওঃ ! যা টেনশনে পড়েছিলাম, সঞ্জয়দা রাজি না হলে জার্নিটা কি হবে ভেবে পাচ্ছিলাম না। যাইহোক নিশ্চিত হওয়া গেল। ২৫শে জুন আমার ছেলে বিল্টুর জন্মদিন। ট্রেনে বসেই কেক জোগাড় হয়ে গেল। সকলে ওকে আশীর্বাদ করলেন। আগামীকাল বিকেল ৪-৩০ নাগাদ হরিদ্বারে পৌঁছানোর কথা। আমি ওপরের বার্থে, ওঠার অসুবিধা একটু থাকলেও নির্বিঘ্নে ঘুমানো যায়। বিল্টু আমার ওপাশে। নিচে পায়েল। তার নিচে ওদের মা। সঞ্চিতদা আর সঞ্জয়দারা পাশের কুপেতে। মোগলসরাইতে জল নিতে নেমে কি ফ্যাসাদ, সঞ্জিতদা উঠে গিয়েছিল, ভিড় ঠেলে বোতলে জল ভরছি, আচমকা ট্রেন হুইসেল দিতেই দৌড় শুরু করলাম।

ট্রেনটা স্পীড ধরার আগে অন্য একটা কামরায় উঠে পড়েছিলাম। মিস করলে কি যে ঝামেলায় পড়তাম। ঝুঁকিটা নেওয়া ঠিক হয়নি, নেমেছিলাম, কি করা যাবে, সকলে দুশ্চিন্তা প্রকাশ করে মৃদু ভর্ৎসনা করলেন। রাতের খাবার খেয়ে নিলাম। দুলুনিতে বেশ ভালো ঘুম হয় আমার। গরম লাগছিল বেশ। পুরো জার্নিটায় খরচের কথা ভেবে এ.সি. করিনি। একটু কষ্ট হবে। মনিয়ে নিতে হবে। ভ্রমণটা মূল উদ্দেশ্য। সকালে প্রাতঃকর্ম সেরে সঞ্জয়দার কুপেতেই আড্ডায় বসলাম সবাই। নিজের মতো শুকনো খাবার দিয়ে টিফিন সারলাম। সাধারণ রিজার্ভেশন কামরা। সারাদিনই প্রচুর হকার উঠছে নামছে। সব কিছুই পাওয়া যাচ্ছে। দুপুরে প্যান্ট্রিকারের খাবার নিলাম। থালি সিস্টেম। ভাত, রুটি,পাঁপড় মিলিয়ে আহার পর্ব সারা হল।

আমরা হরিদ্বারে। ২৬শে জুন, ২০১২। বিকেল পৌনে পাঁচটায় উপাসনা এক্সপ্রেস হরিদ্বারে পৌঁছাল। সকলে নেমে পূর্ব নির্ধারিত ভোলাগিরি আশ্রমে উঠলাম। রুমগুলো ভালই, ঝকঝকে হোটেলের মত নয়, কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। নিরামিষ খেতে হবে, রাত দশটায় গেট বন্ধ হয়, নিয়মকানুন মেনেই বুক করেছি। এমনিতেই হরিদ্বারে সব খাবারই নিরামিষ, সুতরাং চলবে। আশ্রমের পাশেই গঙ্গার ঘাট, জানালা থেকে গঙ্গা দেখা যাচ্ছে। সবার গন্তব্য এখন হর-কি-পৌরিতে। আমরা রুমে ব্যাগ-ব্যাগেজ গচ্ছিত করে গঙ্গার বিখ্যাত ঘাট হর-কি-পৌরি-তে চলে এলাম।

সন্ধ্যারতি গঙ্গার ঘাটে একটি আকর্ষণীয় অনুষ্ঠান। সন্ধ্যায় শুরু হয় প্রতিদিনই। ভ্রমণের আগে জায়গাগুলো সম্বন্ধে একটা ধারণা সঞ্চয় করার জন্য গুগল সার্চ করেছি, ইউটিউব চ্যানেল দেখেছি, যা দেখেছি তার অনেক গুণ বেশি সুন্দর হর-কি-পৌরি ঘাট, হর-কি-পৌরি মানে হরি বা বিষ্ণু অর্থাৎ ঈশ্বরের প্রবেশ পথ। গঙ্গামাইয়ার এই আরতি দেখার জন্য প্রতিদিন অসংখ্য পুণ্যার্থে, তীর্থযাত্রী, প্রতি সন্ধ্যায় গঙ্গার ঘাটে ছুটে আসেন। আলো আঁধারিতে গঙ্গার ঘাটে সহস্রাধিক প্রদীপের উজ্জ্বল বর্ণচ্ছটায় আলোকিত। দর্শনার্থীদের আরতির জন্য পিতলের প্রদীপ বা থালা পাওয়া যায়। পাতাতে প্রদীপ রেখেও গঙ্গায় ভাসানো হচ্ছে দেখলাম।

সব মেয়েরা ঘাটে নামল। পাতার ডোঙা কিনে প্রদীপ ভাসানো হল। সারাদিনের ট্রেন জার্নিতে ক্লান্ত ছিলাম। আমি ঘাটের উপরের দিকে সিঁড়িতে বসে গঙ্গার অপরূপ শোভা দেখছিলাম। ওরা নিচে তখনও। এখানে গঙ্গার স্রোতকে কংক্রিটের শক্ত বাঁধনে ঘুরিয়ে রাখা হয়েছে। একটি বিশাল টাওয়ারের মাথায় বড় ঘড়ি বসানো। নিচে প্রশস্ত প্রাঙ্গণ। গ্রুপ ছবি, সেলফি চলতে লাগল । ছেলেমেয়েদের উচ্ছ্বাস ভীষণ, এত অপরূপ গঙ্গার ঘাটের আরতি আগে কোথাও দেখিনি। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। একসঙ্গে হাজার হাজার প্রদীপ জলে ভাসাচ্ছেন অগণিত নারী-পুরুষ পুণ্যার্থী। হাওয়ার সঙ্গে ঢেউয়ের স্রোত ছুটে চলেছে বিপুল ফেনিল তরঙ্গরাশি সঙ্গে নিয়ে। কী অদ্ভুত শান্ত সৌম্য পরিবেশ, অনুভূতিটা অন্য রকম। মন ভাল করে দেয়। আশ্চর্য এক প্রশান্তি জন্মে।

গঙ্গামাইয়ার কোলে আশ্রয় পায় কত দু:খী-অনাথ মানুষ। কত পাপ ধুয়ে মুছে যায়। হর-কি-পৌরিতে অনেকক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম ভোলাগিরি আশ্রমে। পরদিন ২৭ তারিখ, আশ্রমের পাশেই ট্রাভেলার কারের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেল রাত্রে। সকালে আশ্রমের সামনের ঘাটে স্নানে গেলাম। দুটো ধাপ নামতেই প্রবল স্রোত। জলের মাঝেই কংক্রিটের উপর লোহার খুঁটির সঙ্গে লোহার শক্ত চেন লাগানো। যা ধরে স্নান করা যায়। গঙ্গার ঠান্ডা স্নিগ্ধ জলে অবগাহন স্নান চলবে প্রতিদিন। স্নান সেরে হালকা টিফিন করে বের হলাম।

প্রথমে হৃষিকেশ। একটা চটি বই কিনলাম হৃষিকেশে পৌঁছে। ইন্টারনেট ঘেঁটে যা পেয়েছিলাম, মিলিয়ে নিচ্ছিলাম। দেরাদুনে হিন্দুদের অন্যতম পবিত্র তীর্থক্ষেত্র এই হৃষিকেশ। গঙ্গার দুই পাড়ের মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, ভগবান বিষ্ণুর মন্দির, আধ্যাত্মিক পরিবেশ, এককথায় ধ্যান ও যোগসাধনার আদর্শ স্থান এবং এক স্বাস্থ্যকর ভ্রমণক্ষেত্র হৃষিকেশ। তীর্থস্থানে যেমন থাকে, পুজোর সামগ্রী, রত্ন পাথর, ফোটো, ছবি সবই আছে।

এক রত্নের দোকানে কৌতূহলবশত: দেখতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়লাম, পাথর-রত্নে আমার বিশ্বাস নেই, দোকানদার নাছোড়বান্দা, বিরক্তির একশেষ, শেষে সঞ্জিতদার হস্তক্ষেপে কোনোরকমে মুক্ত হলাম। বিশ্বের যোগ রাজধানীও বলা হয় হৃষিকেশকে। কথিত আছে ভগবান শ্রীরামের অনুজ লক্ষ্মণ রাবণবধের পর তপস্যার জন্য হিমালয়ের কোলে এই হৃষিকেশে আসেন। গঙ্গার উপর লতাপাতা দিয়ে তৈরি একটি সেতু তৈরি করে গঙ্গা পারাপার করেছিলেন। পরে ১৯৩৯ সালে পুননির্মাণ করা হয়। এই সেতুই লছমনঝোলা নামে পরিচিতি। আমরা হৃষিকেশে টিফিন সেরে গীতা ভবনে গেলাম। তারপর লছমনঝোলা।

গঙ্গা নদীর উপর ৪৫০ ফুট লম্বা আইরন সাসপেনশনের দিয়ে তৈরি ঝুলন্ত সেতু লছমনঝোলা। লছমনঝোলা সেতুটি উত্তরাখণ্ডের কোনো এক হড়কাবানে ভেঙে যাওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। পরে উত্তরাখণ্ড সরকার ব্রিজটি নতুনভাবে তৈরি করান। আগামীদিনে গ্লাসব্রিজ তৈরি হচ্ছে, তারই প্রস্তুতি চলছে, শুনেছিলাম তখন। হৃষিকেশে লছমনচক বেশ জমজমাট জায়গা, প্রচুর দোকানদানি। হরিদ্বারের মতো এখানেও সবকিছু নিরামিষ।

লছমনঝোলা ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে ঢালু বাঁধানো রাস্তার উপর দিয়ে রামঝোলা চললাম সকলে। তোতন আর বিল্টু তখন ছোটো, বেশ ফুর্তিতে আছে ওরা। চেহারায় খুশির ঝলক ভাল লাগছিল। পায়েল, পিংকি, ওরা প্রায় সমবয়সী। সঞ্জয়দার ছেলে সৌরদীপও এক সঙ্গেই পড়ে, ও হাসিমুখেই আছে, লাজুক স্বভাবের, কম কথা বলে। যাইহোক, বেশ আনন্দেই আছে। ওরা দুজনেই বেশি সেলফি তুলছে দেখলাম। সীতারাম মন্দির দর্শন করে রামঝোলা চত্বরে নানান মন্দির পেরিয়ে গীতাভবন আশ্রমে গেলাম। গীতাভবন আশ্রম একটি ধর্মশালা, প্রচুর ঘর, প্রতি ঘরে গীতা রাখা আছে। এখানেই পরমার্থ নিকেতন। রামঝোলা একই রকম ঝুলন্ত সেতু। রামঝোলার ওপারে ত্রিবেণী ঘাট।

এখন কনখল। সেদিন পরের দর্শনীয় স্থান ছিল কনখল, পতঞ্জলী আয়ুর্বেদ কেন্দ্র। পতঞ্জলী দেখার খুব উৎসাহ সকলের। অটোতে চেপে পৌঁছালাম, বিশাল প্রতিষ্ঠান, সারা বিল্ডিংটাই এ.সি.র ব্যবস্থা। ভেতরে নানান আয়ুর্বেদ ওষুধের শোরুম, কাউন্টার, ক্যান্টিনও রয়েছে। গাছ-গাছড়া-গুল্ম থেকে ওষুধ তৈরির প্রক্রিয়া ও বিশ্লেষণের ল্যাবরেটরিও আছে, তবে সেখানে প্রবেশ নিষেধ। বাইরে সুবিশাল ঝকঝকে চত্বর, সেখানে চৌবাচ্চায় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ দেখলাম।

মনোমুগ্ধকর পরিবেশ, বৃক্ষরাজি সুন্দর করে বাঁধানো, চরক-সুশ্রুত, দুই প্রাচীন আয়ুর্বেদ মহাচিকিৎসকের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি স্থাপিত রয়েছে। পাশেই কৃপালুবাগ, যোগগুরু রামদেবের বিশাল যোগচর্চাকেন্দ্র। আসার আগে যোগগুরু রামদেবের বিষয়ে কিছু পড়াশুনা করেছিলাম। তখন রামদেবের রমরমা বাজার, যোগসাধনার ক্যাম্প টিভিতে প্রায়ই দেখতাম। দেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরে রামদেবের ক্যাম্প, অসংখ্য অভিজাত ধনী পরিবারের মহিলা-পুরুষ এই ক্যাম্পে যোগ দিত। সেদিন অবশ্য কোনো ক্যাম্প ছিল না। তাই সরাসরি যোগগুরুর যোগাভ্যাস দেখার সৌভাগ্য হল না।

সব মিলিয়ে এক ঝকঝকে প্রতিষ্ঠান হরিদ্বারের এই পতঞ্জলি যোগপীঠ। ওখানকার একজন যোগসাধক বলছিলেন, এটি একটি ন্যাচরোথেরাপি কেন্দ্র। বিভিন্ন জটিল রোগ, মানসিক চাপের কারণে অসুস্থ এমন ব্যক্তিদের যোগচর্চা, মনস্তাত্ত্বিক ও আধ্যাত্মিক পরামর্শ দিয়ে সুস্থ জীবনে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করেন ওঁরা। যার মধ্য দিয়ে বিশুদ্ধ বাতাস, সবুজ প্রকৃতির সাথে আয়ুর্বেদ থেরাপির মধ্য দিয়ে শরীরকে পুনরুজ্জীবিত করে, মানসিক উদ্বেগ নিরাময় করে।

মুসৌরীর পথে। আমাদের পরের গন্তব্য প্রথমে মুসৌরী, ফিরে এসে দেরাদুন শহর ভ্রমণ। সকাল ৮-টায় গাড়ি এল। বেশ ভালোই গাড়িটা। আমরা এগার জন, গাড়িতে তেরটা সিট, পিছনেও পাঁচজনের বসার মতো। ড্রাইভার ছোকরা বলে দিল, পাহাড়ে উঠছি, ভারি খাবার কেউ খাবেন না, শরীর অসুস্থ হতে পারে। হালকা টিফিন করেছি, সুতরাং চিন্তা নেই। মুসৌরী, হরিদ্বার, হৃষিকেশ এই তিন হিলস্টেশনের প্রবেশদ্বার হল উত্তরাখণ্ডের রাজধানী শহর দেরাদুন।

দেরাদুন হয়ে পাহাড়ে ওঠা শুরু হল, ক্রমশ: খাড়া হচ্ছে রাস্তা। দেরাদুন থেকে ৩৪ কিমি দূরে পাহাড়ের রানি মুসৌরী এক সুন্দর সবুজ হিল স্টেশন। সমুদ্রতল থেকে উচ্চতা ৬৫৭৮ ফুট। থাক-থাক সাজানো সবুজ গ্যালারি, সবুজের মাঝে সাজানো ছবির মতো ঘরবাড়ি। আঁকাবাঁকা রাস্তা। যত উপরে উঠছি উত্তেজনা ততই বাড়ছে, আমরা সবাই ছবি তুলছি। কিন্তু চোখের লেন্স আর ক্যামেরা লেন্স অনেক তফাৎ। হাজার ফুট উচ্চতা থেকে যা দেখছি তা স্মৃতিতে সঞ্চয় করছি। ক্যামেরায় বন্দি করা সোজা কথা নয়।

বাঁকগুলোতে ভীষণ ভয় লাগছে। এত স্পীডে ছুটছে, খাড়া রাস্তায় বাঁক না থাকলেও হঠাৎ বাঁক নেওয়ার সময় রীতিমত লোম খাড়া হচ্ছে। এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে ঘুরে ঘুরে উঠছি আমরা। পিংকি সঙ্গে নিয়েছে SLR ক্যামেরা। ওরা ভাইবোনে কাড়াকাড়ি করেছে। আমার ছোট্ট সোনি, অতটা শক্তিশালী নয়, মোবাইলেও বন্দি হচ্ছে অনেক সুন্দর মুহূর্ত। কোনো এক দু:সাহসী সামরিক ক্যাপ্টেন ইয়াং সাহেব নাকি মুসৌরী আবিষ্কার করেছিলেন। উত্তর-পূর্ব হিমালয় পর্বতমালার মধ্যে অবস্থান সৌন্দর্যের রানি মুসৌরীর। তখন ছয় হাজার ফুট ক্রস করছি আমরা, এতটাই উৎফুল্ল, ফোন করেছিলাম বিষ্ণুপুরে আমার অফিস কলিগ মৃত্যুঞ্জয়কে।

এই রোমহর্ষক অভিজ্ঞতা বর্ণনা না করলে মিস করছি মনে হচ্ছিল। ক্রমে মুসৌরীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় স্থান, সর্বোচ্চ বিন্দু লালটিব্বা। এখানে এসে থামল আমাদের গাড়ি, সকলে নেমে পড়লাম। লালটিব্বা ক্যাফেতে নিয়ে এল ড্রাইভার। এখানে বাইনোকুলার রয়েছে, জনপ্রতি পাঁচ টাকা রেট তখন। অদ্ভুত সুন্দর, অবর্ণনীয় পাহাড়ের শোভা, অনেক নিচে গাড়িগুলো দেশলাই বাক্সের মতো মনে হচ্ছে। শ্বাসরুদ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য।

বইতে পড়েছি লালটিব্বায় দাঁড়িয়ে অনেক দূরে বদ্রীনাথ, কেদারনাথের চূড়া দেখা যায়, বুঝতে না পারলেও দেখছিলাম চূড়াগুলো। ক্যাফেতে চা খেলাম সকলেই, এত উঁচুতে কিছু খাওয়ার দু:সাহস হল না কারও, বমির ভয় আছে, ইতিমধ্যে সঞ্জিতদার অ্যাটাক হয়েছে, খুব সাবধানে রয়েছি সবাই, একজনের জন্য সকলের যাত্রা বাঞ্চাল হতে পারে। সময় কম, মুসৌরী আই.এ.এস. ট্রেনিং অ্যাকাডেমি দেখা হল না। আরও দর্শনীয় স্থান ছিল, হল না যাওয়া। খুব দ্রুত নামছি আমরা। দেরাদুন থেকে পরের গন্তব্য ১৫ কিলোমিটার দূরে সহস্রধারা জলপ্রপাত, তারপর কেম্পটি জলপ্রপাত।

এবার সহস্রধারা, কেম্পটি জলপ্রপাত। বলদী নদী থেকে ডাকাত গুহার কাছ থেকে ছোটো-বড়ো অজস্র জলপ্রপাত একসাথে সুউচ্চ পাহাড় থেকে নেমে আসছে। নিচে একসাথে সহস্যধারা বয়ে চলেছে, স্বচ্ছ পাথরের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। চুনাপাথর কার্বোনেট ও সালফারে সমৃদ্ধ শীতল স্বচ্ছ এই জল ত্বকের নিরাময়ে ভীষণ উপকারী। গাড়িতে আসার সময় দূর থেকেই দেখছিলাম, অসম্ভব সুন্দর আকর্ষণীয় স্পট। আয়নার মতো পরিষ্কার, স্ফটিক পাথরের মতো স্বচ্ছ শীতল জল। সঞ্জিতদা তোতন বারমুডা পরে স্নানেই নেমে পড়ল, সঞ্জয়দা, বৌদি, সঞ্জিতদার স্ত্রী ছবু, আমার স্ত্রী, ছেলেমেয়েরা সকলে নামলাম সহস্রধারার স্পর্শে ধন্য হতে। কী দারুণ অনুভূতি। মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায়। পথের ক্লান্তি দূর হয়ে যায়। চোখেমুখে জলের ঝাপটা নিলাম।

ধারে একটা ছোট ক্যান্টিনে বসলাম। আমরা চা-বিস্কুট খেলাম। তোতন আর সঞ্জিতদা লুচি খেয়ে নিল গোটা পাঁচেক করে। আমার সঙ্গে শুকনো বিস্কুট, চানাচুর, লজেন্স রয়েছে। তারই সদব্যবহার করছি মাঝে মাঝে। এরপর কেম্পটি ফলস। মাঝে রাস্তায় তোতন অসুস্থ হয়ে পড়ল, সঞ্জিতদাও বেশ অস্বস্তি বোধ করছে। কাছেই একটা আশ্রম ছিল। ড্রাইভারের পরামর্শ মতো, ওখানেই ওরা থেকে গেল, বিশ্রাম নিয়ে সুস্থ যাক, ফিরে আসার সময় তুলে নেওয়া যাবে, অগত্যা তাই হল, পিংকি আমাদের সঙ্গে থাকল। চললাম কেম্পটি। আরও চার-পাঁচ কিলোমিটার পাহাড়ি রাস্তা পেরিয়ে পৌঁছালাম কেম্পটি ফলস্।

গুগল সার্চ করে দেখেছিলাম, উত্তরাখণ্ডের তেহরি গাড়ওয়াল জেলায় অবস্থিত এই জলপ্রপাত প্রায় ৪৫০০ ফুট উঁচু পর্বতশ্রেণী থেকে থেকে নিচে পড়ছে। কোনো এক ব্রিটিশ অফিসার জন মেকিনান সাহেব এই জলপ্রপাতকে পর্যটক কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলেন। সাহেব-মেমসাহেবরা এখানে ক্যাম্প মানে শিবির স্থাপন করে চা পান করতেন, তা থেকেই ক্যাম্প-টি বা কেম্পটি ফলস নামকরণ হয়েছে। স্বচ্ছ স্রোতের ধারা উপর থেকে নেমে আসছে, নিচে হ্রদের আকার জমা হয়ে বয়ে চলেছে, নিচে নেমে অনেকেই নৌকায় ঘুরতে দেখলাম উপর থেকে। নয়নাভিরাম দৃশ্য। দারুণ, আমি অভিভূত। দেখে আশ মেটে না।

পাশ দিয়ে গাড়ি পেরিয়ে যাচ্ছে, ড্রাইভার বলল, বদ্রীনাথ যাওয়ার রাস্তা ওটা। অনেক গাড়িই উঠছে উপরে। আমরা ফিরে চললাম। ওদিকে তখন তোতন, সঞ্জিতদা অনেকটা সুস্থ। ফিরে এসে বিশ্রাম করলাম অনেকক্ষণ। রাতের খাবার দরকার, বাজারে বের হলাম। পিংকি আমাদের সঙ্গ নিল। বাজারে ঘুরছি, এখানে দাদা-বৌদি নামের হোটেল অনেকগুলো, বাঙালি খাবার সব জায়গায়, বড় বড় হোড়িং হোটেলগুলোর সামনে। উলের জিনিস বেশ সস্তা। সোয়েটার, মাফলার, চাদর নানান আসবাব, বেচাকেনা চলছে, বাজার সরগরম সর্বদা। আমি একটা হাফ জ্যাকেট কিনলাম, বেশ মোটা আর গরম। হর-কি-পৌরিতে এলাম।

সন্ধ্যায় গঙ্গা আরতি আজও দেখলাম। এক জায়গায় গঙ্গার বুকে বিশালাকায় শিবের মূর্তি স্থাপন করা আছে, অপূর্ব সুন্দর সেই স্থাপত্য। শঙ্খধ্বনি, গঙ্গারতি, সাধুসন্ত, পর্যটক, হাজার হাজার ভক্ত দর্শনার্থি সব মিলিয়ে এক বিশাল জনসমাগম। আমরা আজ উপর থেকে সিঁড়িতে বসেই দেখছিলাম আরতি। সেদিন রাত্রে ভোলাগিরি আশ্রমে আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছিল। সকালে যাওয়ার সময় আমরা অনুরোধ করেছিলাম, ওরা একদিন অতিথি-বোডারদের আশ্রমে অন্নভোগের ব্যবস্থা রাখেন, নামমাত্র অনুদান-কুপনের বিনিময়ে। বেশ তৃপ্তি করে প্রসাদ খেলাম। আশ্রমের পরিবেশটি খুব সুন্দর, ক‘দিন ভালই ছিলাম এখানে।

পরের দিন বাজারে কেনাকাটা আর কাছাকাছি জায়গাগুলো ঘুরে দেখার জন্য বরাদ্দ ছিল। সকালেই স্নান সেরে দশটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম। কেনাকাটা করে দাদা-বৌদির হোটেলে ভাত-জাল-আলুপোস্ত খেলাম। বিকেলে মনসামন্দির দেখার জন্য অকুস্থলে পৌঁছালাম। ভীষণ ভিড় রোপওয়েতে। টিকিট পাওয়া যাবে, কিন্তু লাইন দেখে পিছিয়ে গেলাম। পায়ে হেঁটে ঘোরানো সিঁড়ি, সকলের পক্ষে সম্ভব হবে না, ঝুঁকি নিলাম না। উপরে পাহাড়ের চূড়ায় আলো জ্বলতে দেখলাম।

সেদিনই শেষ, হর-কি-পৌরিতে অনেকটা সময় কাটিয়ে ফিরলাম। আমাদের ট্রেন রাত্রি ৮-০০টায়। সেদিন বিষ্ণুপুরে সোজা রথ। ওখানে ৭-টাতেও সন্ধ্যা হয়নি। বিষ্ণুপুরে সাড়ে ছটাতেই অন্ধকার, ফোন করলাম নিমাইদাকে, তখন মদনগোপালের আরতি শুরু হবে জানালো। যাইহোক আমার ক্যামেরা ভর্তি হয়ে গেছে, একটা দোকানে গেলাম সৌরদীপকে নিয়ে মেমরি কার্ডটা পাল্টানোর জন্য। ওরা বলল কার্ড নেই, মেমরি থেকে সিডি বানিয়ে দিতে পারি। সেটাই করা হোল, অনেকটা দেরি হয়ে গেল, ওদিকে ট্রেনের সময় এগিয়ে আসছে। ছুটলাম আশ্রমে, সবাই রাস্তায় বেরিয়ে এসেছে, আমরা দ্রুত চেপে বসলাম অটোতে। হরিদ্বার স্টেশন থেকে অমৃতসর এক্সপ্রেস। ট্রেন এসে গেল, ব্যাগপত্র গুছিয়ে উঠে বসলাম সকলে।

এখন অমৃতসরে। ২৯শে জুন, ২০১২। পরের দিন সকাল আটটা নাগাদ পৌঁছানোর কথা অমৃতসর স্টেশনে। অমৃতসরে সারাদিন বেড়িয়ে রাত্রে ট্রেন। আমি আগের মতেই টপ বাঙ্কারে। সকালে অমৃতসর পৌঁছালাম। আমরা একটা লজে উঠলাম। স্নান সেরে ব্যাগ-ব্যাগেজ রেখে দুটো ট্যাক্সি ভাড়া করলাম। সঞ্জয়দার পরিকল্পনা মতো পাঞ্জাবি ড্রাইভার দুজন দর্শনীয় স্থান ঘুরিয়ে স্টেশনে পৌঁছে দেবে কথা হল।

প্রথমেই জালিয়ানওয়ালাবাগ। ইতিহাসে পড়া স্মৃতিবিজড়িত কুখ্যাত সেই জালিয়ানওয়ালা, ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল, যেখানে বিক্ষোভরত কয়েকশ নিরস্ত্র মানুষকে গুলিবিদ্ধ হতে হয়েছিল। টিকিট কেটে ঢুকলাম। দেওয়ালে অসংখ্য বুলেটের চিহ্ন। শিহরিত হলাম, বড় একটা কুয়োর মুখ জাল দিয়ে সুরক্ষিত, প্রাণভয়ে ভীত অনেকে ছুটতে গিয়ে পড়ে গিয়ে প্রাণ হারান। ব্রিটিশ পুলিশের জেনারেল ডায়ারের নির্দেশে গুলির আদেশে ১০০ গোর্খা সৈন্য এলোপাথাড়ি গুলি চালিয়েছিল বিক্ষোভকারীদের উপর। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ নাইট উপাধি ত্যাগ করেছিলেন। মিউজিয়ামে বিশ্বকবির একটা ছবি দেখলাম। কবিগুরুর এমন রাগত মুখাবয়ব আগে কোথাও দেখিনি। সুউচ্চ স্মৃতিসৌধের সামনে প্রশস্ত বাঁধানে জায়গা, শহিদদের উদ্দেশ্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। ক্যামেরায় বন্দি হলাম নিজেরা।

সৌধস্থল কিছুক্ষণ ঘুরে দেখলাম, নৃশংস হত্যাকাণ্ডের সংরক্ষিত ছবি ও চিহ্নসকল। মনখারাপের জায়গা, বিমর্ষ চিত্তে জালিয়ানওয়ালাবাগ ছাড়লাম। খিদে পেয়েছিল সবার, একটা বড় রেস্তোরায় টিফিন সারলাম। না, পাঞ্জাবি চাপাটি বা তন্দুরি মশলা পরোটা পরখ করা হল না, পেট গড়বড়, তাই ইডলি খেলাম। অপূর্ব স্বাদের অনুভূতি। চললাম বিখ্যাত স্বর্ণমন্দিরের উদ্দেশ্যে। পায়ে হেঁটেই যাওয়া যায়, খুবই কাছে। স্বেচ্ছাসেবকদের একটি দল বিনি পয়সায় চটিজুতো কাউন্টারে গচ্ছিত রাখছে, কুপন দিল সবার জুতোর। পাশেই একটি কাউন্টার থেকে ছেলেদের গেরুয়া উত্তরীয় মাথায় বেঁধে দিলেন ওঁরা, মেয়েদের ওড়না বা ঘোমটা দিতে হবে জানিয়ে দিলেন। খালি পায়ে প্রবেশ করলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে শ্বেত পাথরের তৈরি সুবিশাল সৌধ। বর্গাকৃতি ঝাঁ-চকচকে শ্বেতশুভ্র এতবড় স্থাপত্য ভারতবর্ষে কমই আছে, না দেখলে বিশ্বাস হবে না।

নেটসূত্র অনুযায়ী, পাঞ্জাবের অমৃতসরে অবস্থিত শিখদের পবিত্র গুরুদ্বার এই স্বর্ণমন্দিরের নির্মাণকাল ষোড়শ শতাব্দীতে, চতুর্থ শিখগুরু গুরু রামদাস মনোরম সরোবর ও তার মাঝে গুরুদ্বার ভবনটি নির্মাণ করেছিলেন। পরে ১৮০৯ সালে মহারাজ রঞ্জিত সিংহ মার্বেল ও তামা দিয়ে পুনর্নির্মাণ করেন, তারও পরে সোনার পাত দিয়ে গর্ভগৃহটিকে মুড়ে দেন। তথ্য অনুযায়ী তখন ১৬২ কেজি সোনা ব্যবহৃত হয়েছিল,সেই থেকেই স্বর্ণমন্দির নামে খ্যাত হয় এই গুরুদ্বার। পরে নাকি আরও ৫০০ কেজি সোনা দিয়ে আবরণটির পুনর্নিমাণ করা হয়। স্বর্ণমন্দিরের দৈনন্দিন খরচ, ভবন রক্ষণাবেক্ষণের খরচ সম্পূর্ণভাবে দানের অর্থে নির্বাহ করা হয় এবং লঙ্গরখানার খরচ ও সেবাদান স্বেচ্ছাসেবীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এখানে সবাই স্বেচ্ছায় সেবাদানের জন্য আবেদন করেন, সময় হলেই ডাক পান, দীর্ঘ প্রতীক্ষায় থাকতে হয়, ছুটে আসেন দূরদূরান্ত থেকে স্বর্ণমন্দিরে সেবা দিতে।

গোল্ডেন টেম্পলটি শিখ ধর্মের কর্তৃত্বের প্রধান কেন্দ্র। ১৯৮২ সালে খালিস্তান পন্থী ভিন্দ্রানওয়ালে এবং তার কয়েকজন অনুগামী স্বর্ণমন্দির দখল করে অস্ত্রমজুত ও সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করে। ১৯৮৪ সালে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নির্দেশে অপারেশন ব্লু-স্টার নামে অ্যাকশন ফোর্সের মাধ্যমে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সরিয়ে দিতে ভারতীয় সেনা নামান স্বর্ণমন্দিরে। অনেক সৈন্য,শতাধিক তীর্থযাত্রী মারা যান। উগ্রপন্থীদের উচ্ছেদ করে স্বর্ণমন্দির দখলমুক্ত করা হয়। বহু ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যায় বিখ্যাত এই উপাসনা গৃহটির।

আমরা প্রবেশ করলাম পূর্বদিকের তোরণ দিয়ে। চৌকাকৃতির সমগ্র চত্বর শ্বেতশুভ্র মার্বেল পাথর দিয়ে আগাগোড়া মোড়া। চারপাশেই তোরণ এবং ভবনগৃহ দিয়ে সুরক্ষিত। মূল তোরণ উত্তর দিকে। জুনের শেষ হলেও দিনটা ছিল রৌদ্রজ্জ্বল। ভীষণ উষ্ণ আবহাওয়া, সূর্য তখন মাথার উপরে। মার্বেলের মেঝে ভীষণ উত্তপ্ত, খালি পায়ে চলার সুবিধার জন্য চত্বরে কার্পেট দেওয়া আছে। চারকোণে মহিলা-পুরুষের বিশাল স্বেচ্ছাসেবকবাহিনী পরিষ্কার স্টিলের বাটিতে স্বচ্ছ ঠাণ্ডা জল হাতে হাতে ধরিয়ে দিচ্ছেন পরম যত্নে, পাশেই একদল বাটিগুলি ধুয়ে আবার ব্যবহারের জায়গায় রেখে দিচ্ছেন, একটি দলে অন্তত কুড়িজন নারীপুরুষ সেবা দিয়ে চলেছেন।

প্রচণ্ড রোদে ঘুরে ক্লান্ত সব দর্শনার্থীই জল পান করছেন। উত্তরদিকের তোরণের পাশেই লঙ্গরখানা, ওখানে লুচি-হালুয়া খাওয়ানো হয় জানতেন সঞ্জয়দা। ‘চল তুমি কত খেতে পার দেখি,’ বলে সঞ্জিতদাকে টেনে ওখানে নিয়ে চললেন, ছেলেমেয়েরাও ঢুকল লঙ্গরখানায়। বিল্টুর শরীর অসুস্থ লাগছিল, আমরা গেলাম না, সরোবরের পাশেই একটি গাছের নিচে বিশ্রাম নিলাম, ওরা পরিতৃপ্ত হয়ে ফিরে এলেন। শুনলাম,পরিষ্কার থালা একটি করে নিয়ে কাউন্টারে দাঁড়ালেই পর পর থালা ভর্তি করে দিচ্ছেন, খাওয়া হলে পাশেই রেখে দিয়ে চলে আসতে হচ্ছে, স্বেচ্ছাসেবকরা সঙ্গে সঙ্গে ধুয়ে নিচ্ছেন। দারুণ ব্যবস্থা, সুশৃঙ্খলভাবে হাজার হাজার লোক সেবা দিচ্ছেন, লক্ষাধিক মানুষ খাচ্ছেন, কোথাও কোন গোলমাল চিৎকার হাঁক-ডাক কিচ্ছুটি নেই।

আমরা দেখছি আর অবাক হচ্ছি, অত্যন্ত ধর্মভীরু শিখরা, পরিচালন ব্যবস্থা খুবই পরিকল্পিত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ নইলে যুগ যুগ ধরে মানুষের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে থাকত না স্বর্ণমন্দির। মূল উপাসনাগৃহ অর্থাৎ গর্ভগৃহে যাওয়ার সেতুটিতে লম্বা লাইন, সেখানে শিখ ধর্মাবলম্বীরাই রয়েছেন দেখলাম, প্রচণ্ড রোদে ক্লান্ত সকলে, পাশেই উপাসনাস্থলে হালুয়া প্রসাদ খেয়ে বের হলাম স্বর্ণমন্দির চত্বর থেকে। বাইরে বেরিয়ে কয়েকটা দোকানে ঢুকলাম, সোয়েটার সস্তায় পাওয়া যায় কিনা দেখছিলাম। নাঃ ! বেশ চড়া দাম, কয়েকটা স্মারক ফোটো কিনলাম, বিল্টু আর তোতন স্টিলের বালা কিনল। ট্যাক্সিতে ফিরে এলাম হোটেলে।

কথা হয়েই ছিল, চললাম ওয়াঘা। ড্রাইভারের পরামর্শে একটা ধাবায় গাড়ি দাঁড়াল মধ্যাহ্নের আহারের জন্য। ভাত সবজি ডাল অর্ডার দেওয়া হল। পোস্তু খেতে চাইলাম, বাসমতি চালের ভাত, তৃপ্তি করে খাওয়া যাচ্ছে না। আমাকে পোস্তুর প্লেটটা দিল, ওমা পোস্তু কোথা! এ তো সরষের ঝোল! বুঝলাম, এখানে পোস্তু চলে না।

অমৃতসর থেকে ৩২ কিলোমিটার দূরে ওয়াঘা সীমান্ত। পাকিস্তানের লাহোরের সীমান্ত গ্রাম ওয়াঘা, ভারতের পাঞ্জাবের অমৃতসরের সীমান্ত গ্রাম আত্তারি, এই সীমান্তকে সংযুক্ত করে গ্রান্ট টাঙ্ক রোডের উপর এই আত্তারি-ওয়াঘা সীমান্ত অনুষ্ঠান। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর বর্ণময় আকর্ষণীয় কুচকাওয়াজ দেখতে চলেছি আমরা। তখন পড়ন্ত রোদ, বেলা ৩টা হবে। অকুস্থলে পৌঁছালাম। গেট খোলেনি তখনও। বাইরে প্রচুর দর্শক। চওড়া রাস্তা ওখানেই শেষ হয়েছে, ভারতের শেষ সীমানা। ঘোড়সওয়ার কয়েকজন গেটের বাইরে ঘোরাঘুরি করছে দেখলাম। হাজার পাঁচেক দর্শনার্থী তো হবেই। জায়গাটায় যেন মেলা বসেছে, আইসক্রীম, পতাকা, বাহারি ওড়না এসব বিক্রি হচ্ছে দেদার। সময় কাটাতে আইসক্রীম খেলাম সকলে।

গেট খোলার তোড়জোড় চলছে। পরিচিত একজনের কাছে শুনেছিলাম, সামরিক সাজে সুসজ্জিত বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত বি.এস.এফ. জওয়ান এই বিশেষ কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। অনুষ্ঠানটির নাম বিটিং রিট্রিট সেরোমনি।, আক্রমণের চূড়ান্ত উত্তেজনা নিয়ে বিশেষ অঙ্গভঙ্গিতে কুচকাওয়াজ ও ড্রাম বাজানো হয়, সেনারা মিছিলে জোরালো পায়ে স্ট্যাম্পিং করে একটি ভয়ানক যুদ্ধের ছাপ তৈরি করে দেখান। ভারতের বি.এস.এফ. সেনা ও পাকিস্তান রেঞ্জার্স- দুই বাহিনীর মধ্যে অনুষ্ঠান। উভয় দেশ জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষায় মরীয়া এটা বোঝান, তেমনই জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ করেন দর্শকদের।

গেটের ভিতরে দুই পাশে গ্যালারি, কোন টিকিট নেই, আগে এলে আগে বসা যায় গ্যালারিতে। নিয়ম অনুযায়ী দুই দেশের সেনা নিজের নিজের দেশকে সম্মান জানিয়ে কুচকাওয়াজ করবে, পতাকাকে স্যালুট জানাবে ও শেষে সন্ধের আগে জাতীয় পতাকা নামিয়ে অনুষ্ঠান শেষ হবে। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য, বহু প্রতীক্ষিত সেই কুচকাওয়াজ দেখা আর হল না। বিকেল ৪ টা নাগাদ বিশাল ফটক খুলে গেল, বাইরে অপেক্ষমাণ আমরা প্রায় হাজার পাঁচেক নারী-পুরুষ একসাথে ছুটতে শুরু করলাম, মনে হল সংখ্যাটা আরও বেশিই হবে।

বিশাল জনসমুদ্র, পিছনে সামনে দুই পাশে একসাথে ছুটছে সবাই, এত মানুষ একসাথে একই রাস্তায়, যা হবার তাই হল, অনেকে পড়ে গেল, জুতো খুলে গেল, হুমড়ি খেয়ে পড়ল, আগে যাবার দৌড়, আমরা ভীত হয়ে পড়লাম, সঞ্জয়দা, সঞ্জিতদা দাঁড়িয়ে পড়ল, গত্যন্তর না দেখে রাস্তার পাশে বিক্ষিপ্তি জনতাকে পাশ কাটিয়ে পাশে পাশে কিছুটা এগিয়ে যাচ্ছিলাম, কিন্তু ছেলে-মেয়ে-স্ত্রী রাজি নয়, দলের অন্যরাও ক্লান্ত, হতোদ্যম, যে কোন সময় পদপিষ্ঠ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা। ভিড়টা ধীরে ধীরে সরে যেতে রাস্তায় প্রচুর চটি জুতো পড়ে থাকতে দেখলাম, অনেকেই দাঁড়িয়ে পড়েছে। যারা প্রাণের মায়া ত্যাগ করে উদভ্রান্ত হয়ে দৌঁড়াল তারা পৌঁছাল কিনা জানতে পারিনি। ভগ্ন-মনোরথ ফিরে চললাম আমরা। গাড়ি চলল অমৃতসর স্টেশনের দিকে।

দিল্লির রাজপথে। ১লা জুলাই, ২০১২। দিল্লির উদ্দেশ্যে অমৃতসর স্টেশনে পোঁছালাম। প্লাজায় খাবার কিনে নিলাম রাত্রের জন্য। রিজার্ভেশন অনুযায়ী নিউদিল্লি-শতাব্দী এক্সপ্রেসে চেপে বসলাম। সারাদিনের ক্লান্তিতে অবসন্ন সকলে, খাবার খেয়ে যে যার সিটে চলে গেলাম। সাড়ে সাতটায় ট্রেন ছাড়ল। ২রা জুলাই, সকাল ৮ টায় নতুন দিল্লির হজরত-নিজামউদ্দিন স্টেশনে নামলাম, ২রা জুলাই। অটোতে পূর্ব নির্ধারিত দিল্লি কালীবাড়ি গেষ্ট-হাউসে ঢুকলাম। একটা ডরমেটরিতে ব্যবস্থা হল, পৃথক খাট সকলের। চাহিদা অনুযায়ী তোষক চাদর আর বালিশ ভাড়া করলাম। কালীবাড়িতে রাত্রিবাস সুখকর না হলেও খাবার ব্যবস্থা ভালই, ১৩০ টাকায় একজনের দুবেলা আহার, সকালে চা-টোস্ট। সকাল দশটায় ঘন্টা পড়লে ডাইনিং টেবিলে, রাত্রে নটায় ডিনার টেবিলে আসতে হবে। কমন বাথরুমের অবস্থা ভাল নয়।

কালীবাড়ি থেকে দিল্লি বেড়াবার বাস ছাড়ে সকাল ১১টায়। ভাড়া নির্দিষ্ট হয়ে আছে, নন এ.সি ট্র্যাভেলের সঙ্গে ফাইনাল হল। চটপট স্নান সেরে ডাইনিং-এ চলে এলাম সকলে। প্রথম দিন, বরাদ্দ খাবার ভালই ছিল। বাসের ড্রাইভার মাঝবয়সী শিখ ভদ্রলোক নিজেই গাইড, ওনাকে ভ্রমণ শেষে বখশিশ দিলেই হবে জানালেন। সকলকে কোথায় কোথায় নিয়ে যাবেন বর্ণনা করলেন। বাস ছাড়ল, ড্রাইভার-সাব প্রফেশনাল, ব্যবহার অত্যন্ত ভাল। দিল্লির রাস্তা অত্যন্ত সুন্দর, পরিকল্পনামাফিক ঝকঝকে, পরিষ্কার এবং সাজানো। রাস্তার দুপাশে প্রচুর গাছ, বিশাল বিশাল বৃক্ষ সুন্দর করে বাঁধানো। রাজপথ একেই বলে, পথের রাজা। মসৃণ কালো সোজা পিচের চওড়া রাস্তা, গাড়ি ছুটে চলেছে। ছবি তুলছি, ভিডিওতে বেশি স্পেস নেওয়া যাচ্ছে না, আর সুযোগ হবে কিনা জানা নেই, আশ মিটিয়ে উপভোগ করছি সৌন্দর্য।

ফিল্মস্টার শাহরুখ খান আর অমিতাভ বচ্চন সাহেবের বিরাট তারকাখচিত হোটেল প্রায় মুখোমুখি, দিল্লি গেটের পাশের রাস্তা দিয়ে পেরিয়ে গেলাম, সংসদ ভবন, রাষ্ট্রপতি-ভবনের পাশ দিয়ে ছুটছে গাড়ি, দেখার জায়গাগুলো একটু ধীরে নিয়ে চললেন। তখন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সামনে। ড্রাইভার সাহেব জানালেন, ‘‘আপকা বাঙালিবাবু প্রণব মুখার্জী সাব প্রেসিডেন্ট বননে কে লিয়ে লড় রহা হ্যায়। বড়ে দিলওয়ালা, আচ্ছা আদমী হ্যায় বাঙালিবাবু। ও জরুর বনেগা “ আমরা কদিন বেড়ানোর নেশায় খবর রাখতে পারিনি, শুনে খুশি হলাম, দিল্লিতে প্রণব মুখার্জীর জনপ্রিয়তা বুঝতে পারলাম। শুক্রবার কিছু জায়গায় বেড়ানো বন্ধ থাকে। লোটাস টেম্পল দূর থেকে দেখেই সন্তুষ্ট হতে হল।

পুরানো দিল্লিতে কুতুব মিনারে এসে থামল আমাদের গাড়ি। রাত্রে ভালো ঘুম হয়নি, প্রচণ্ড গরম, দিল্লিতে এত গাছ, যেদিকে তাকাই সবুজের সমাগম, পরিকল্পনামাফিক বড়ো-মাঝারি বৃক্ষ সারি সারি। রাজপথের শোভাবর্ধন করেছে, এত গাছের সমারোহ দিল্লিতে, তবুও গরমে দিল্লি সেরা। যাই হোক নটার মধ্যে স্নান সেরে প্রস্তুত হয়ে নেমে এলাম ডাইনিং-এ। আজও সেই বাস, সেই পাঞ্জাবি ড্রাইভার। এদিন শুক্রবার, দিল্লির অনেকগুলো স্পট বন্ধ থাকে। ভাগ্য সুপ্রসন্ন নয়, কি আর করা যায়। তাই গন্তব্য রাজঘাট, দিল্লি প্রগতি ময়দান, দিল্লি হাট এসব। বিকেলে ফিরে কিছু কেনাকাটা। ড্রাইভার ভদ্রলোক বেশ মিশুকে, খুব নিষ্ঠা পেশার প্রতি, কথাবার্তায় বুঝলাম। উনি জায়গাগুলো ঘোরাচ্ছেন, সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিচ্ছেন।

লালকেল্লার দক্ষিণ-পূর্ব দিকে যমুনা নদীর তীর ও রিং রোডের সংযোগ স্থলে রাজঘাট, স্মৃতি বিজড়িত স্থান। এটি একটি স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্স। ড্রাইভার সাহেব বলছিলেন, ১৯৪৮ সালে মহাত্মা গান্ধী আততায়ী বন্দুকের গুলিতে নিহত হওয়ার পর এই রাজঘাটে অন্তিম দাহকার্য করা হয়। পরে জায়গা প্রসারিত করে বিস্তীর্ণ অঞ্চল সংরক্ষিত করা হয়, সেখানে দেশের উচ্চস্তরের রাজপুরুষ-মহিয়ষী নারীর স্মৃতিও সংরক্ষিত, জানলাম। গাড়ি পার্ক করিয়ে আমাদের একঘন্টার মধ্যে ফিরে আসতে বললেন। টিকিট করে সুরক্ষামণ্ডলী পেরিয়ে ঢুকলাম। বিশাল এলাকা জুড়ে সবুজ মখমল প্রান্তর। উদ্যানে প্রচুর গাছ, সাজানো, সুন্দর শান্ত পরিবেশ। যেন শান্তির আশ্রয়ে ঘুমিয়ে রয়েছেন রাজপুরুষ ক‘জন। স্নিগ্ধ সবুজ সৌন্দর্য, শান্ত সুনিবিড় ছায়া, সুশীতল বাতাস রোদের উষ্ণতাকে ম্লান করে দিচ্ছে। একটি বড় চৌকো কালো মর্মরের মঞ্চ, কাঁচের আবরণে রক্ষিত প্রদীপের অহরহ চিরন্তন শিখা, পরিবেশ আশ্চর্য শান্ত মনোরম।

গান্ধীজীর শেষ শব্দ ‘হে রাম’ কালো মার্বেলের উপর লিপিবদ্ধ। ফুল দিয়ে সাজানো মঞ্চে পর্যটকরা শ্রদ্ধা নিবেদন করছেন। পাশেই গান্ধী মেমোরিয়াল। জানা গেল গান্ধীজীর জীবন ও বাণী সম্বলিত ‍বৃহস্পতিবার একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শিত হয়। এত বড় বিশাল প্রান্তরে সাজসজ্জা নেই, মর্মর বেদীতে জাতির জনক মহাত্মার অন্তিম ভস্ম সংরক্ষিত। একে একে ইন্দিরা গান্ধীর স্মৃতি রক্ষিত আছে শক্তিস্থলে,জওহরলাল নেহুরুর শান্তিবন, রাজীব গান্ধীর বীরভূমি দেখলাম। লাল বাহাদূর শাস্ত্রীর বিজয়ঘাট, অটল বিহারী বাজপেয়ীর অভয়ঘাট এরকম বিভিন্ন স্থলে শেষ স্মৃতি রক্ষিত আছে জানালেন একজন গাইড। এ এক অন্য সঞ্চয়, স্মৃতিমেদুর হয়ে অনেকটা সময় কাটালাম, মন বেশ প্রফুল্ল, বেরিয়ে এলাম।

বাইরে এক এ.টি.এমে. টাকা তুলতে গিয়ে ফ্যাসাদে পড়লেন সঞ্জিতদা। কার্ড কিছুতেই বের হচ্ছে না, সিকিউরিটিও পারল না, রাজঘাটে আমাদের মত বেড়াতে আসা একজন অবাঙালি ব্যাঙ্ককর্মী খুব সাহায্য করলেন। পরে আমিও টাকা তুললাম। ওখান থেকে ড্রাইভার-গাইডজী আমাদের দিল্লি হাটে নিয়ে গেলেন। বিশাল বাজার। এখানে ফুড প্লাজা বেশ বড় আকৃতির। ক্রাফট বাজার। স্থায়ী কাঠামো রয়েছে, অস্থায়ী নির্মাণ অনেকগুলো কাঠামো করা আছে। ছোটো ছোটো ছাদ যুক্ত কটেজ, কিওস্ক ও স্থায়ী-অস্থায়ী কাঠামো নিয়ে দিল্লি হাট। ১৫ দিনের জন্য বাজার বসে, আবার নতুন কোন হস্তশিল্পীর দল আসে, বাজার বসে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তের হস্ত-কারু শিল্পের সম্ভার নিয়ে শিল্পীরা আসেন এই দিল্লি হাটে। এখানে ঘূর্ণায়মান অনেকগুলি স্টল আছে, দৈনিক ভাড়ার বিনিময়ে এই স্টলগুলি জিনিসপত্র বিক্রির জন্য পাওয়া যায়।

আমাদের শহর বিষ্ণুপুর থেকে মহকুমা প্রশাসনের উদ্যোগে পর-পর কয়েকবছর বিষ্ণুপুরের বালুচরী-স্বর্ণচরী-হ্যাণ্ডলুম বস্ত্র, শঙ্খ শিল্প, দশাবতার তাস, হ্যাণ্ডলুম, পোড়ামাটির হস্তশিল্পের সম্ভার নিয়ে এসেছিল পুরো পঞ্চাশ-ষাট জনের দল। খুব ভাল বিক্রি হয়েছিল এই দিল্লিহাট থেকে। আমার সহকর্মীরা কয়েকজন এসেছিলেন, গল্প করেন ওঁরা। বিকেলের আগেই ফিরে চললাম কালীবাড়িতে।

কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে দিল্লির বাজার ঘুরতে বের হলাম। প্রথম সরকারি এ.সি. বাসে উঠলাম। সরকারি উদ্যোগে দিল্লিতে চালু হয়েছে তখন, এ.সি.বাস. টাউন সার্ভিস, বাসগুলো বেশ সুন্দর, আরামদায়ক। করোলবাগ মার্কেট দিল্লির বেশ জমজমাট বাজার। সঞ্জিতদার মেয়ে পিংকি একটা বড় ট্রলি সুটকেস কিনল। বেশ ভাল, শক্তপোক্ত মনে হল সস্তাতেই পেয়ে গেল। সঞ্জিতদা সবসময় সস্তাতেই পেয়ে যান। কি করে খোঁজ পান, জানি না, এই নিয়ে ওর বৌ ছবুকে প্রশ্ন সকলের, কি করে পান, কি করে, লেগপুল চলে কিছুক্ষণ। ওর স্ত্রী অনিতা ওরফে ছবু, একই পাড়ায় বড় হয়েছি আমরা, ভাই-বোনের সম্পর্ক, তাই খুনসুটি চলতেই থাকে। উপভোগ করি বেশ।

কেনাকাটা সেরে করোলবাগ মার্কেটের ফুটপাতে পিৎজা খেলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে খাওয়ার মজাই আলাদা। ভোজবাড়িতে সবার সঙ্গে পাতায় খাওয়া, বা সরস্বতী পুজোর আগের রাতে প্যাণ্ডেল তৈরির পর নিজেদের তৈরি সাধারণ খিচুড়ির স্বাদ, অতি সাধারণ খাবারও সুস্বাদু লাগে, তেমনই ফুচকা টিকিয়া পিজা বা অন্য কিছু। খুব দূরে নয় কালীবাড়ি। ঘুরতে ঘুরতে হেঁটেই চলে এলাম। কালীবাড়িতে সন্ধ্যারতি হচ্ছিল। লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দিরও রয়েছে বেশ বড় এবং সাজানো, আরতি দেখলাম কিছুক্ষণ।

আজ শেষ রাত্রি দিল্লিতে। আগামী কাল সকাল আটটায় ট্রেন, গন্তব্য আগ্রা। রাত্রে গরমের চোটে ঘুম আসছিল না। ওপরের জানালা থেকে নিচে দেখছিলাম। কিছু একটা অনুষ্ঠান চলছে। রাস্তার ধারে আলো জ্বলছে সারি সারি, লজে বিয়েবাড়ি মনে হল। হঠাৎ জোরে বাজনার শব্দ শুনলাম। কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার হল। বিয়েবাড়ির নিমন্ত্রণে আসছে লোকজন। আলো-রোশনাই সহ শোভাযাত্রা দেখে বুঝলাম বিয়ের বারাত। কনেযাত্রীর সঙ্গে সুসজ্জিতা কনে বেরিয়ে এল মালা হাতে নিয়ে। বর ঘোড়া থেকে নামল, মালাবদল হয়ে গেল গেটের সামনেই। ভিতরে চলে গেল বর-কনে। আমি আর আমার মেয়ে পায়েল ওদিকে পিংকি জেগে বিয়েবাড়ি দেখছিলাম।

২য় পর্ব

যাচ্ছি আগ্রায়
৩রা জুলাই, ২০১২। সকাল সাড়ে সাতটায় হজরত নিজামউদ্দিন থেকে তাজ এক্সপ্রেসে রিজার্ভেশন ছিল। বেশ আরামদায়ক জার্নিটা। এক নব-বিবাহিত দম্পতি আমার সামনের সিটে, ওদের খুনসুটি বেশ উপভোগ করছিলাম। প্রেমের স্মৃতি তাজমহলই তো দেখতেই চলেছি। মুঘল সম্রাট সাজাহানের অমর কীর্তি তাজমহল। যত কাছাকাছি আসছি তত রোমাঞ্চিত হচ্ছি। কতদিনের শখ তাজমহল দেখার। নামলাম আগ্রা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে। এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের সঙ্গে চুক্তি হয়ে গেল। দুটি ট্যাক্সিতে ওরা আমাদের আগ্রা থেকে মথুরা, বৃন্দাবন, ফতেপুর সিক্রি, আগ্রাফোর্ট ঘুরিয়ে দেখাবে, পরের দিন ট্রেন ধরানো পর্যন্ত। মেয়ের আবদার কালীবাড়িতে খুব কষ্ট হয়েছে, এবার যেন ভাল হোটেলে উঠি। পরিচিত এক হোটেলে নিয়ে গেল। বেশ ভাল হোটেল। গোটা হোটেলটা সেন্ট্রাল এসি। সোফা, বিছানা ভীষণ আরামদায়ক। খাবার ওখানেই পাওয়া যাবে, রুম সার্ভিস ছাড়াও ডাইনিংরুমে গিয়ে খাওয়া যায়। রুমে ব্যাগ-ব্যাগেজ গচ্ছিত করে টিফিন করলাম। কথামতো বেরিয়ে পড়লাম আগ্রাফোর্ট দর্শনে।

প্রথমে আগ্রাফোর্ট পরে তাজমহল
আগ্রাফোর্টে পৌঁছাতে গাড়িতে বেশিক্ষণ লাগল না, দূরত্ব মাত্র ৫ কিলোমিটার। ফোর্টের কাছে পৌঁছে একজন গাইড নিলাম। আসলাম ওখানকারই ছেলে, বেশ ধোপদুরস্ত, কথাবার্তায় চৌকস, ইংরাজি হিন্দি উর্দুতে মিশিয়ে কথা বলছিল। বই পড়ে, ইন্টারনেট ঘেঁটে যা জেনেছিলাম ওর কথার সঙ্গে কিছু মিলছিল আবার মেলেনি। যাইহোক আমরা ঘুরছিলাম। লাল বেলে পাথরের বিশাল দুর্গ আগ্রাফোর্ট। ঐতিহাসিক লাল দুর্গ ৯৪ একর জমির উপর তৈরী, প্রাঙ্গণের আয়তন ২.৫ কিলোমিটার। ভেতরে অনেকগুলি প্রাসাদ, মিনার ও মসজিদ রয়েছে। পঞ্চদশ শতাব্দীতে লোদি রাজবংশ শুরুর পরে মুঘল সম্রাট বাবর ১৫২৭-এ ইব্রাহিম লোদিকে পাণিপথের প্রথম যুদ্ধে পরাজিত করে আগ্রাফোর্ট দখল করেন। আগ্রাকে রাজধানী করে মুঘল সাম্রাজ্য বিস্তার শুরু হয়। পরে আগ্রাফোর্ট সংস্কার করেন সম্রাট আকবর। তারও পরে শাহজাহান আরও স্থাপত্য নির্মাণ করেন। এই কেল্লা মুঘল সাম্রাজ্যের রাজকীয় আবাসস্থল এবং এক অনবদ্য স্থাপত্য নিদর্শন। দেওয়ানী আম, এক প্রশস্ত প্রাঙ্গণে বাঁধানো আসন, যেখানে বসে মুঘল সম্রাটরা প্রজাদের অভাব-অভিযোগ শুনতেন, বিচার করতেন, দেখাচ্ছিল আসলমভাই। দেওয়ান-ই-খাস, রাজকীয় সুসজ্জিত ভবন, যেখানে সম্রাট বিশিষ্ট অভ্যাগতদের ও রাষ্ট্রীয় দূত বা অতিথিদের অভ্যর্থনা করতেন। যে কক্ষে শাহজাহানকে পুত্র আওরঙ্গজেব বন্দী রেখেছিলেন সেই কক্ষ এখন বন্ধ, দেখাল আসলম। ওখান থেকে তাজমহল দেখলাম, তাজমহল আগ্রাফোর্ট থেকে খুব কাছে, মাত্র ২.৫ কিলোমিটার দূরে। ওখান থেকে যমুনা নদী কিছুটা দূরে ক্লান্ত বয়ে চলেছে। দর্শনীয় আরও কয়েকটি জায়গা শীশমহল, মোতি মসজিদ দেখলাম। শীশমহল সম্পূর্ণ কাঁচের তৈরী। মোতি মসজিদ, নাগিনা মসজিদ এর নির্মাণ শৈলী পারসিক-ভারতীয় শিল্পকলার মিশ্রণ। ভাঙা বাংলায় কথা বলছিল আসলম। বিশাল তোরণ, সুবিশাল চত্বর, অজস্র ঐতিহাসিক স্থাপত্যের নিদর্শন ক্যামেরায় বন্দী করছিল সকলেই। স্মৃতিপটে সব ছবি সংরক্ষিত হচ্ছিল। বেরিয়ে এলাম আগ্রাফোর্ট থেকে, তখন বেলা পড়ে আসছে। আসলমকে ওর প্রাপ্য মিটিয়ে দিলাম, ও সেলাম জানিয়ে চলে গেল।

বিশ্বের বিস্ময় তাজমহল
বিশ্বের বিস্ময়, বিস্ময়ের খনি তাজমহল। তাজমহলের যত কাছাকাছি আসছি তত শিহরণ বাড়ছে। ৫০০ মিটার আগে থেকেই গাড়ী আটকে দিল। এখান থেকে কাউন্টারে টিকিট করে জুতোর কাউন্টারে কুপন নিলাম। বিশেষ ধরণের হুডখোলা গাড়ীতে চেপে তাজমহলের গেটের সামনে যাওয়া যায়। চাপছে কেউ কেউ। আমরা হেঁটেই যাচ্ছি দুধারের সুন্দর বাগান দেখতে দেখতে। তাজমহলের মূল ফটকও লাল বেলেপাথরের তৈরি, স্থাপত্য দেখার মতো, কত নিখুঁত কারুকার্য, প্রায় ৪০০ বছরের পুরানো, কিন্তু অটুট কারুশৈলী, এখনো। তোরণ পেরিয়ে প্রবেশ করলাম মূল চত্বরে। বিশাল চত্বরের মাঝে তাজমহল, সামনে কেয়ারি করা ঝাউয়ের সারি, মাঝে অবিরাম ঝর্ণাধারা। দুধারে দুটি পৃথক স্থাপত্য, লাল রঙের মুঘল অতিথিশালা। চোখের সামনে তাজমহল, অবাক পৃথিবী অবাক, অপূর্ব, অনন্যসাধারণ, অতুলনীয় কারুশিল্প, মন্ত্রমুগ্ধ হতে হয়। সম্রাট শাহজাহানের প্রিয়তমা পত্নী সম্রাজ্ঞী মমতাজের স্মৃতিতে এই মমতাজমহল। ১৬৩২ সালে নির্মাণ শুরু হয়ে ১৬৫৩ সালে সম্পূর্ণ হয়। নির্মাণশৈলীতে পারস্য, তুরস্ক, ভারতীয় ও ইসলামী স্থাপত্যশিল্পের মিশ্রিত রূপ। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় স্থান পেয়েছে ১৮৯৩ সালে, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম তাজমহল আইভরি-সাদা মার্বেল পাথরের গম্বুজাকৃতি রাজকীয় স্মৃতিসৌধ। মার্বেল পাথরের অপরূপ স্থাপত্যশৈলী, সুউচ্চ মিনার, কারুকার্যখচিত সুবিশাল স্তম্ভ, সব মিলিয়ে অতীব সুন্দর তাজমহল, কবিগুরুর ভাষায় – ‘‘যায় যদি লুপ্ত হয়ে থাকে শুধু থাক এক বিন্দু নয়নের জল, কালের কপোলতলে শুভ্র সমুজ্জ্বল এই তাজমহল”। কত গৌরবগাঁথা তাজমহলের কারুকার্যে, কত গোপন কথা, কত ঘাম, কত রক্ত এই অপরূপ মহল যাতে দ্বিতীয় আর একটি তৈরি করতে না পারে, পারস্যদেশের শিল্পী, মুল মিস্ত্রী ওস্তাদ ঈশাকে সরিয়ে দেওয়া হয় পৃথিবী থেকে। মুঘল ইতিহাসে যেমন অনেক গৌরবগাঁথায় সমৃদ্ধ, তেমনই চক্রান্তে, ক্ষমতার লালসায় রক্তাক্ত। ভাইয়ের হাতে ভাই, পুত্রের হাতে পিতার রক্ত ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। কত স্মৃতি বয়ে নিয়ে চলেছে যমুনা, বয়ে চলে স্রোত, থেমে থাকেনি সময়।

চাঁদের জ্যোৎস্নায় তাজমহলের রূপ আমাদের মুগ্ধ করে, ভুলে যাই রক্তাক্ত ইতিহাস। প্রশস্ত প্রাঙ্গণে ফোয়ারার সামনে চৌবাচ্চায় রক্ষিত জলে তাজমহলের প্রতিচ্ছবি। একটি সুন্দর ছো্ট্ট মার্বেল পাথরের বেঞ্চ। একটু জিরিয়ে নেওয়ার জন্য, বসে ফটো তোলার জন্যও হতে পারে। বাইরে থেকে ছবি তোলা গেলেও ভিতরের ছবি নিষেধ ছিল তখন। তাজমহল বিশ্ব ঐতিহ্যের সর্বজনীন প্রশংসিত শ্রেষ্ঠ স্থাপত্যকর্ম। তাজমহলের উপরের চত্বরের ওঠার একধরণের কাপড়ের তৈরি রঙিন জুতো পরতে হয়, জুনমাসের রোদ। তপ্ত মেঝে, তাই জুতোর ব্যবহার। উপরে উঠে চারদিকের চারটি সুবিশাল স্তম্ভ, ঘুরে ঘুরে দেখলাম, স্পর্শ করলাম। দুধসাদা মার্বেল নয়, আইভরি কালারের মার্বেল পাথরের তৈরি তাজমহল। এত বড় সুবিশাল স্থাপত্য, মার্বেলের কারুকার্য খোলা আকাশের নিচে, যুগের পর যুগ গর্বিত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে প্রিয় তাজমহল। প্রবেশদ্বারের দেওয়ালে আরবি ভাষায় ক্যালিগ্রাফিতে খোদিত বানী,দূর থেকে সুন্দর অঙ্কনশৈলী মনে হয়। চারদিকে ঢোকার বেরুবার পথ এবং প্রশস্ত বারান্দা। একেবারে গর্ভগৃহে শায়িত সম্রাটের প্রিয়তমা পত্নী সম্রাজ্ঞী মমতাজের সমাধি পাশেই শায়িত সম্রাট শাহজাহান। উপরে রঙিন বস্ত্র ঢাকা দেওয়া। সুবিশাল তাজমহলের নিচে দাঁড়িয়ে নিজেকে কত ক্ষুদ্র মনে হচ্ছিল। কত সুবিশাল, মানুষের নিজেকে চেনার আসল জায়গা সুউচ্চ মিনার কিম্বা সুবিশাল বৃক্ষের নিচে দাঁড়ানো। চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে আমার কোমরে ব্যথা করছিল। ব্যথা বেশি হলে মারাত্মক হয়, সকলে চিন্তিত। ব্যথা বাড়তে পারে এই ভয়ে পরিবারের হেলথ্ গাইড-কাম-ফ্রেণ্ড ফিজিও শ্রীমান চিরঞ্জিতকে স্মরণ করলাম ফোনে, উনি একটা ব্যথার ট্যাবলেট আর জেল-মলম সাজেস্ট করলেন। অভয় দিলেন। ব্যস, ওতেই কাজ হয়ে গেল। ফিরে চললাম প্রহরীদের তাড়ায়, সাতটার পর বন্ধ হয় তাজমহলের মুল ফটক। একরাশ সুখানুভূতি, চোখ জুড়ানো হাজার স্থাপত্যের স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে বের হলাম। তাজমহল তুলনাহীন স্থাপত্য, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের অন্যতম কেন এখন বুঝলাম। জীবনের অনেক কিছুই বাকি থেকে যায় তাজমহল না দেখলে। পাশের রেস্টুরেন্টে, চা-টিফিন সারলাম, সাদা মার্বেলের ছোট্ট একটি তাজমহল শোপিস কিনলাম। ফিরলাম হোটেলে। রাত্রে খাওয়ার তেমন আগ্রহ ছিল না সবার। আমি খাবার কেনার জন্য বের হলাম। সঙ্গে পিংকী, বিল্টু, পায়েল আর আমার স্ত্রী সোমা। অটো ভাড়া করলাম হোটেলের সামনে থেকে। অজানা জায়গা, অনেকটা দূরে রেস্টুরেন্ট, জানাল ড্রাইভার। মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা। ভয় হচ্ছিল, সঙ্গে স্ত্রী, কন্যা দুজন। মুসলিম হোটেলে তোলে কি না সেটাও ভাবনা ছিল। অটো ড্রাইভার আমার মুখচোখ দেখে কিছুটা আন্দাজ করেছিল। অভয় দিল,এখানে কোন ভয় নেই, টুরিস্টদের কেউ অসম্মান করি না আমরা। আমাদের পেশা টুরিস্টদের নিয়ে। নিশ্চিন্তে থাকুন। প্রায় পাঁচ কিলোমিটার হবে। রেস্টুরেন্টে বসে বজরঙ্গবলীর ছবি দেখলাম, যাক, বাঁচা গেল। নিশ্চিন্ত হয়ে তন্দুরি রুটি আর চিকেন খেলাম। সঞ্জিতদার জন্য খাবার নিলাম। আগামীকাল সকালে সকাল আটটায় গাড়ি আসবে হোটেলে, বলে গেল। রাত্রে ভাল ঘুম হল না, বিছানার নরম গদিতে আরামের চেয়ে অস্বস্তিই বেশি, তাই আমরা নিচে, ছেলেমেয়েরা গদিতেই ঘুমোল। বাথরুম নি:সন্দেহে পরিস্কার, সাজানো, কিন্তু বাথটবে ছাড়া স্নান করা যায় না, সে এক অস্বস্তিকর অবস্থা। কোনক্রমে স্নান সারলাম। মালপত্র ক্লোকরুমে থাকল, টিফিন সেরে বের হলাম দুটো গাড়িতে সদলবলে। মথুরা বৃন্দাবন ফতেপুর সিক্রি ঘুরে এসে আগ্রা ছাড়ব।

এবার মথুরায়
এই সেই মথুরা নগরী, যেখানে কংসের কারাগার, যেখানে কৃষ্ণের জন্ম। দেবকীর অষ্টম গর্ভের সন্তান কৃষ্ণই কংসের মৃত্যুর কারণ জানতে পেরে অহংকারী অত্যাচারী রাজা কংস বন্দি করে রেখেছিলেন আপন সহোদরা দেবকী ও তার স্বামী বসুদেবকে। টিকিট কেটে মথুরায় কংসের কারাগার চত্বরে প্রবেশ করলাম। কারাগার দেখার জন্য লাইন, ভেতরে অন্ধকারাচ্ছন্ন সরু পথ, চওড়া পাথরের দেওয়াল, কারাগারের গর্ভগৃহে ঘুলঘুলি দিয়ে আলো এসে পড়ছে, ভিতরে এত ঘন অন্ধকার, বিদ্যুতের আলো অপ্রতুল,ম্লান, গৃহের একপাশে উঁচু দাওয়ায় সাজানো সিংহাসনে কৃষ্ণের বিগ্রহ, পূজা আরাধনা চলছে, এই কক্ষই কৃষ্ণের জন্মভূমি। ছোট্ট ঘুলঘুলি পথে আলো এসে পড়ছে পাথরের মেঝেতে। মহাভারতের বর্ণনা অনুযায়ী এই কারাগারের দেওয়ালেই দেবকী-বসুদেবের পর পর ছয় সন্তানকে আছড়ে হত্যা করেছিল কংসের অনুচর, দেবকীর সপ্তম গর্ভের সন্তানকে রোহিণীর গর্ভে ধারণ করানো হয়, জন্ম হয় বলরামের। অষ্টম সন্তানকে হাতে পায়নি জল্লাদ অনুচরেরা। ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথি, এক ঘনঘোর বর্ষায় পিতা বসুদেব সদ্যজাত কৃষ্ণকে দৈব সহযোগিতায় গোকুলে যশোদা-নন্দলালের ঘরে রেখে আসেন। পাশের গ্রাম গোকুল তোলপাড় করেও কৃষ্ণের খোঁজ না পেয়ে হতাশ কংস। নানা ছলে-কৌশলে আপন ভাগ্নে শিশু কৃষ্ণকে বারংবার হত্যা করতে ব্যর্থ হন বাহুবলী রাজা কংস। পরে যুবা বয়সে কংসকে বধ করে মধুরা উদ্ধার করেন কৃষ্ণ। কারাগারের চারপাশ ঘিরে একটি সুদৃশ্য মন্দির নির্মাণ করেছিলেন কৃষ্ণের প্রপৌত্র বজ্য। মন্দিরটি নাকি সতেরো বার আক্রমণ করা হয়ে ধনরত্নের খোঁজে। সারা দেশে জনপ্রিয় মন্দিরগুলির মধ্যে মথুরার কৃষ্ণজন্মভূমি মন্দিরটি অন্যতম। জন্মাষ্টমীতে লক্ষাধিক দর্শনার্থী ও কৃষ্ণভক্তের সমাগম হয় জানালেন মন্দিরের এক পুরোহিত। পাশেই একটি মিউজিয়াম, মাখনচোরা কৃষ্ণের বিগ্রহ, ছবি ঝুলনের মত করে সাজানো রয়েছে, শুনলাম। গেলাম না, সর্বত্রই টিকিট, অর্থ উপার্জনের ফন্দিফিকির ভালই চলে এইসব পর্যটন জায়গাগুলোতে।

আমরা বৃন্দাবনে। বৃন্দাবন নামটির উৎপত্তি বৃন্দা থেকে, যার অর্থ তুলসী, অর্থাৎ তুলসীর বন বৃন্দাবন। উত্তরপ্রদেশের মথুরা জেলার গুরুত্বপূর্ণ পর্যটন কেন্দ্র, মথুরা থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আগ্রা-দিল্লি হাইওয়ের উপর এই বৃন্দাবন, রাধা-কৃষ্ণের বিখ্যাত লীলাভূমি, হিন্দুদের পবিত্র তীর্থক্ষেত্র। বৃন্দাবনের অদূরেই বরসানা উপবন, শ্রীরাধার জন্মক্ষেত্র, এখানে নাকি রাধারানী প্রথম জীবনে পিতার সঙ্গে প্রাসাদে থাকতেন। রাধারানী মন্দির বরসানার প্রধান আকর্ষণ। বৃন্দাবন মন্দিরের আশেপাশে, মন্দিরের ভিতরে প্রচুর বানর, লাল মেনিগুলো এত সোহাগী যে, হাতের থেকে বাদাম ছাড়িয়ে খেয়ে নেয়, মন্দিরের গায়ে অপরূপ কারুকার্য, আধুনিককালে স্থাপত্য শিল্পের এমন নমুনা খুব কম দেখেছি। আনমনে মন্দিরের শোভা দেখছিলাম সবাই, আচমকা একটা পুঁচকে বানর আমার স্ত্রীর হাত থেকে পার্সটা খপ করে তুলে মন্দিরের ভিতরের এক উঁচু কিনারে লাফিয়ে গিয়ে বসল, কিছুতেই বানর আর নামে না, ব্যাগও ছাড়ে না, শেষে পাণ্ডার পরামর্শে বাদামের ঠোঙা দেখিয়ে নামিয়ে আনা হল, ঠোঙা তুলে পার্স নামিয়ে রেখে চলে গেল খুদে বানরটি। আমরা অন্য বানরদেরও খাবার দিয়ে সন্তুষ্ট করলাম, যতটা পারা যায়। এবার সোনার তালগাছ। এক পাল্ডার কবলে পড়েছি, সে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে গালগল্প এত বলছে, যে ধৈর্যচ্যুতি ঘটছে। রঙ্গনাথ মন্দির, বিশালকায় সুউচ্চ দক্ষিণের আদলে তৈরি হাজার হাজার বছরের পুরানো এই রঙ্গনাথ মন্দির। ভিতরে বেলেপাথরের প্রশস্ত চত্বর। বেশ সুন্দর একটি চৌবাচ্চা। উড়িষ্যায় জগন্নাথ মন্দিরে ভক্তদের যেমন ‘ধাঁই কিড়ি কিড়ি’ প্রচলিত ধ্বনি, তেমনই বৃন্দাবনে ‘রাধে-রাধে’ সবার মুখে। এখানে বৈকুণ্ঠের দরজা রয়েছে, পাণ্ডারা একটা দরজা দেখিয়ে বললেন। পাশেই সেই বিখ্যাত সোনার তালগাছ। মোটেই তালগাছ সদৃশ নয়, তবুও, যা দেখায় তাই সই। অনেকগুলো রিং দিয়ে তৈরি সুউচ্চ, সোনার পাতের তৈরি বৃহৎ ফাঁপা স্তম্ভ, প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু থাম্বা, যার উপরে মন্দিরের পতাকা তোলা হয়। একেবারে শীর্ষে পতাকা উড়ছে পতপত করে। রয়েছে বাঁকে বিহারী মন্দির। ভিতরে শ্রীকৃষ্ণের বাস, বিশ্বাস করেন পূজারী থেকে দর্শনার্থী ও ভক্তরা। পাণ্ডাদের দিয়ে পুজো দেওয়া হোল, একশ টাকার ডোঙা দিলাম। পাণ্ডা লালাজি আমাদের সঙ্গে নিয়ে বৃন্দাবনের বৃদ্ধাবাসগুলি দেখালেন। তৎকালীন হিন্দু বিধবাদের শেষ আশ্রয়। সারা ভারতবর্ষের বিভিন্ন সংস্থার দান পৌঁছায় এখানে, সেই অর্থেই স্থায়ীভাবে বৃদ্ধাদের থাকাখাওয়া, ভরণপোষণ চলে। এখানকার হিন্দু বিধবারা ভগবান কৃষ্ণের সাধনায় শেষ জীবন অতিবাহিত করেন শুদ্ধাচারে। বৃন্দাবন দর্শন শেষ। খুব ইচ্ছে ছিল, কিন্তু সময়ের অভাবে বরসানা যাওয়া হল না।

গন্তব্য ফতেপুর সিক্রি
৪ঠা জুলাই, ২০১২। বৃন্দাবন থেকে ৭৪ কিলোমিটার দূরে মুঘল সম্রাটদের তৈরি আর এক দুর্গ। নামলাম ফতেপুর সিক্রিতে। একদিকে তীব্র গরম। মাথার উপরে সূর্য, দুর্গটা অনেকটা উঁচুতে, পাথরের প্রশস্ত ধাপ উপরের দিকে উঠে গেছে। অসংখ্য পর্যটক ইতস্তত ঘোরাফেরা করছে। ছবি তুলছে। আমরাও উঠছি ধাপগুলো দিয়ে । পায়েলের শরীর অসুস্থ, ঠাণ্ডা লেগে অস্থির অবস্থা। নাক দিয়ে জল ঝরছে। কোনোক্রমে উপরে সবাই উঠলাম। কষ্ট হলেও। পাথরে বাঁধানো চওড়া সুন্দর সিঁড়ি। সিঁড়ির শেষে এক বিশালাকায় ফটকের সামনে উপস্থিত করাল আমাদের গাইড সেখ দিলাবর। মুসলিম যুবক। অনেক তথ্য ওর কাছ থেকেই পেলাম। ফতেপুরের এই দুর্গে প্রথম দিকে মুঘল রাজধানীর প্রস্তুতি থাকলেও নানা কারণে স্থানান্তরিত হয় নি। ফতেপুরের এই দুর্গেই নাকি আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয়েছিল। সিকরি নামের এক গ্রামের নাম থেকে এই নামকরণ জানা গেল। গাইডের দেওয়া বর্ণনার সঙ্গে বইয়ের বিবরণ মেলাচ্ছিলাম। সম্রাট আকবর গুজরাট জয়ের পর এই রাজশাহী প্রাসাদের নাম হয় ফতেপুর সিক্রি অর্থাৎ বিজয়ের শহর। মূল প্রবেশদ্বারটি তখনই নির্মাণ করা হয়। নাম হয় বুলন্দ দরওয়াজা। ইতিহাসের পাঠ্য বইতে এই সুবিশাল কারুকার্যখচিত স্থাপত্যের ছবি দেখেছি। ১৭৭ ফুট উঁচু অত্যন্ত সুদৃশ্য বুলন্দ দরওয়াজা। এখন চাক্ষুষ করলাম। বেলে পাথরের তৈরি বিশাল প্রাসাদ, সুবিশাল চত্বরের কোণায় কোণায় লুকিয়ে আছে কত অজানা রহস্য, যার কিনারা আজও হয়নি। এখানে সেলিম চিস্তির সমাধিক্ষেত্র। মার্বেল পাথরে নির্মিত সমাধিভবন ও সংলগ্ন প্রশস্ত প্রাঙ্গণ তৈরি করান সম্রাট আকবর। জানা যায়, সেলিম চিস্তি ছিলেন একজন সুফি সাধক, যিনি সিক্রির পাশেই একটি গুহায় বাস করতেন। এই মহাসাধক আকবরের পুত্র জাহাঙ্গীরের জন্মের ভবিষ্যৎবাণী করেছিলেন। আকবর তাঁর প্রতি শ্রদ্ধার চিহ্ন হিসাবে এই সমাধি তৈরি করিয়েছিলেন। অপূর্ব মার্বেল পাথরে নির্মিত সৌধ। মুল ভবনটির চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। ভবনটির প্রশস্ত প্রাঙ্গণে আরও কয়েকটি সমাধি রয়েছে, যেগুলি সেলিম চিস্তির আত্মীয়স্বজনের। সমাধি গৃহের চারিদিক অত্যন্ত সূক্ষ্ম মার্বেল পাথরের পর্দা দিয়ে ঘেরা, যা তুলনাহীন। সমাধি ভবনের গর্ভগৃহের দরজা খোদাই করা, বহু রঙের পাথর দিয়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য করা। সমাধি কক্ষটির সাদা মার্বেলের মেঝে বহু রঙের পাথর, হীরা-পান্নার টুকরো দিয়ে সাজানো। এক কথায় সাদা মার্বেল পাথরের তৈরি এই সমাধি ক্ষেত্রটি মুঘল স্থাপত্যের অন্যতম সেরা নিদর্শন। আমরা ফিরে চললাম, আগ্রা হোটেলে। রাস্তার ধাবায় খাওয়াদাওয়া সারলাম। হোটেলে ক্লোকরুম থেকে জিনিষপত্র নিয়ে ওই ট্যাক্সিতেই স্টেশনে চললাম, রাতের ট্রেন।

বেনারসে শেষ
৬ই জুলাই, ২০১২। আগ্রা থেকে বেনারস সুপারফাস্ট এক্সপ্রেসে রিজার্ভেশন আমাদের। আগ্রা স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ল বিকেল ৪-৫০ এ। উত্তরপ্রদেশের এক জেলা শহর বেনারস, আগ্রা ক্যান্টমেন্ট থেকে রেলে ৫৫৩ কিলোমিটার পথ। বেনারস পৌরাণিক সময় থেকে বারানসী নামেও পরিচিত। বেনারস পৌঁছাব আমরা আগামীকাল বিকেল ৪ টা নাগাদ। আমাদের গোটা ভ্রমণ পথটাই রাত্রে এক শহর থেকে অন্য শহর, দিনে ঘোরাঘুরি, রাতের জার্নি আমাদের ভালোই হচ্ছে। ট্রেন থেকে যখন নামলাম, তখন বৃষ্টি হচ্ছে বেনারসে। বেনারসের বিখ্যাত পান এখানে খেতে হবে। অনেক পানের দোকান সার দিয়ে, এখানে পানের যে আলাদা কদর তা বাহার দেখলেই বোঝা যায়। বেশ সাজানো-গোছানো, আলোর ফুলঝুরি চারদিকে। জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহ, অন্য কোনো শহরে বৃষ্টি পাইনি, বেনারসে বৃষ্টিই বাধা হয়ে দাঁড়াল। অটো থেকে নেমে হোটেল খুঁজতে একটু দেরি হওয়ার জন্য কিছুটা ভিজতে হল। হোটেল বুকিং ছিল না। ভ্রমণপথটা সাজিয়েছেন সঞ্জয়দা, ট্রাভেল এজেন্সির মাধ্যমে এলে হয়তো আর একটু স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়া যেত। কিন্তু খরচের দিকটা হিসেব করে সকলে মিলে ঠিক করা হয়েছিল নিজেরাই যাব খরচের হিসেব করে। রাস্তায় সব খরচের ভার আমার উপর ছিল। পকেট ফাঁকা হলেই সকলের কাছে থেকে টাকা নিয়ে অ্যাডজাস্ট করছিলাম। যাইহোক, হোটেল পাওয়া গেল, বাঙালি খাবার পাওয়া যাবে জানাল ম্যানেজার। টপ ফ্লোরে ডাইনিং, একটু কষ্ট করে উপরে উঠতে হবে, বাকি রুমের ব্যবস্থা ভালই। ম্যানেজার সাজেশন দিলেন, গঙ্গার ঘাটে ঘুরে আসার। সামান্য বৃষ্টিতে কিছু হবে না। একজন বিশ্বস্ত মাঝি আমাদের সঙ্গে দিলেন। যদিও ক্লান্ত, তবুও সঞ্জয়দার উৎসাহ দেখে রাজি হয়ে গেলাম। সামান্য টিফিন করে বেরিয়ে পড়লাম। টিপ টিপ বৃষ্টি পড়ছে। পুরানো বেনারস। বড় ঘিঞ্জি। আঁকাবাঁকা গলি। অন্ধকারময়। ভিড়ের মধ্য দিয়ে নিয়ে চলেছেন মাঝি-কাম-গাইড মুরুলীধর। ফিরে আসার সময় বিশ্বনাথ দর্শন হয়ে যাবে জানালেন।

হোটেল থেকে শর্টকাটে পৌঁছালাম ঘাটে। থাক থাক সিঁড়ি নিচে নেমে গিছে গঙ্গার ঘাটে। সব ঘাট একই রকম প্রায়, অনেক উপর থেকে দীর্ঘ সিঁড়ির সারি। একেকটা ঘাটের দিকে নেমে গেছে। বৃষ্টি পড়ছে ঝিরিঝিরি। অনেক নৌকা নোঙর করা রয়েছে। কিন্তু তখন গঙ্গায় ভাসছে দু-একটি নৌকাই দেখলাম। আমরা গঙ্গায় নামতে ইতস্তত করছিলাম। আজকের আবহাওয়ার জন্য। কিন্তু সঞ্জয়দার জেদ। ওপারে আজ যাবেনই এবং আজকের স্নানও ওপারে হবে। যদিও তখন পৌনে পাঁচটা প্রায়। নিমরাজি ছিলাম, সঞ্জদার জেদ দেখে রাজি হলাম সকলে। এভাবে হাতে টানা নৌকায় কখনো নদীতে নামিনি। সঙ্গে আবার পরিবারের সকলে। আমার পরিবারে আমি ছাড়া কেউ সাঁতার জানে না, খুবই ভয়ে ভয়ে নৌকায় উঠে বসলাম। সামনেই সঞ্জয়দা, কিটু ও বৌদি, পাশেই সঞ্জিতদা, তার পিছনে পিংকি, ছবু, পায়েল, সোমার পাশে বিল্টু, শেষে আমি উঠলাম। পাটাতনের টলমল অবস্থা। কোনরকমে বসা যায়, বৃষ্টি আর ঝিরঝিরে নেই, বাড়ছে মাঝে মাঝে, সঙ্গে ঝোড়ো হাওয়া। এক হাতে ছাতা অন্য হাতে নৌকার ছই ধরে বসে আছি। কতক্ষণে ওপারে পৌঁছায় এই অপেক্ষায়। গঙ্গার অনেকগুলি বিখ্যাত ঘাট রয়েছে। কয়েকটা বড় ঘাটের নাম বলল। সব ঘাট মনে করতে পারছে না মুরুলিধর। মণিকর্ণিকা বেনারসের সবচেয়ে পবিত্র ঘাট। এখানে নাকি মোক্ষ লাভ হয়। অনন্ত মুক্তি লাভ। মৃত্যুপথযাত্রী বয়স্ক মানুষ বিশ্বাস করেন। এই ঘাটে প্রাণত্যাগ করলে মানবজীবন থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। শুনেছি এখানে চিতার আগুন কখনো নেভে না, এতই জনপ্রিয় এই শ্মশান ঘাট। সার সার চিতা নামানো থাকে সৎকারের অপেক্ষায়। মণিকর্ণিকা ঘাটের সঙ্গে পৌরাণিক কাহিনী জড়িয়ে আছে। রাজা হরিশচন্দ্রকে এই ঘাটে ডোম হয়ে নিজপুত্রের দাহকার্য করতে হয়েছিল ঋষি বিশ্বামিত্রের অভিশাপে। এরই মাঝে মুরুলীধর আধা-হিন্দি আধা-বাংলাতে গঙ্গার নানান কাহিনী বর্ণনা করে যাচ্ছে।

মাঝ গঙ্গার একটা জায়গায় একবার ঘূর্ণিতে পড়েছিল। সে এক ঘনঘোর বর্ষা, ভীষণ বিপদ এক লোক নিয়ে, পাশের নৌকার মাঝির সাহায্যে কোনরকমে বেঁচে গিয়েছিল। ঠিক সেইখান দিয়ে পেরনোর সময় গল্পটা বলছে মুরুলীধর, সবাই নিশ্চুপ। দমবন্ধকর অবস্থা। ঘূর্ণিটায় পড়ে সলিল সমাধি কতগুলো দেখেছে সেটাও বলছে। ভাবছি, এবার ওসব বন্ধ কর। তুমি ঘূর্ণির জায়গাটা পার কর আগে। যাইহোক, ওপারে পৌঁছালাম। নৌকাটা নোঙর করল, মোটা রসা দিয়ে পাড়ের খুঁটির সঙ্গে। একটা আড়াল করাই ছিল, সঞ্জয়দা সর্বাগ্রে চেঞ্জ করে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, সঙ্গে আমরাও, তখন বেশ ভালো লাগছে। গঙ্গায় স্নানের এক অন্য অনুভূতি। মেজাজ ফুরফুরে হয়ে গেল। বেশ আরামদায়ক স্নান। তৃপ্ত হলাম সকলে। জামাকাপড় পাল্টে নৌকায় উঠে পড়লাম। তখন বৃষ্টি থেমে গেছে। ঠাণ্ডা শিরশিরে অনুভূতি। হালকা বাতাস বইছে। সন্ধের মুখে তখন। কথা হয়েই ছিল। ঘাটগুলো ঘুরিয়ে দেখানোর। পর পর ঘাটগুলো ঘুরছি, নাম সব জানি না। কিন্তু সন্ধ্যারতি দেখতে বেশ ভালো লাগছিল। চেত সিং ঘাট পেরোচ্ছি, এখানে লর্ড হেস্টিংস-এর সঙ্গে চেত সিং-এর লড়াই হয়েছিল, চেত সিং-এর কেল্লা ব্রিটিশরা দখল করে। মীর ঘাট এল, মুসলিম সেনানায়ক মীর রুস্তম আলির নামে নামাঙ্কিত শুনলাম। এরপর এল দ্বারভাঙ্গা ঘাট। মুরুলীধর বলছিল, শ্রীধর নারায়ণ মুন্সি এই ঘাট নির্মাণ করেন, এজন্য এই ঘাটের আরেক নাম মুন্সিঘাট। ছবি তোলার আদর্শ স্থান, এই দ্বারভাঙা ঘাট। পরে এল সিন্ধিয়া ঘাট, এই ঘাটের অর্ধেক জলমগ্ন শিবমন্দির রয়েছে। কথিত আছে দেবতা অগ্নি এই ঘাটে জন্মেছেন। তারপর এল সেই বিখ্যাত দশাশ্বমেধ ঘাট। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আর লালমোহন গাঙ্গুলীর রসায়ন। গঙ্গার ঘাটে কুস্তি অভ্যাস, মুগুর ভাজা, বাইসেপস-ট্রাইসেপস প্রদর্শন, তোপসের রহস্য উন্মোচনের চারণক্ষেত্র, বিখ্যাত এই ঘাট। পুরাণমতে প্রজাপিতা ব্রহ্মা অশ্বমেধ যজ্ঞ করার পর যজ্ঞের দশটি ঘোড়াকে বলিদান করেন এই জায়গায়, তাই এই নাম। পেরিয়ে চলেছি আরও অনেকগুলি ঘাট, সন্ধ্যারতি গঙ্গার সব ঘাটে, একসঙ্গে সে এক অভূতপূর্ব আলোর দীপাবলী, অনির্বচনীয় সৌন্দর্য, কথায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। পেরিয়ে গেলাম মানমন্দির ঘাট, অসি ঘাট, অহল্যা ঘাট, কেদার ঘাট, গঙ্গামহল ঘাট সহ আরও কয়েকটি ঘাট, সবার নাম জানা ও মনে রাখা দুঃসাধ্য মুরুলীধর স্বীকার করে নিল। যাইহোক আমরা এবার উঠলাম। প্রায় একঘন্টা গঙ্গাবক্ষে ঘাটগুলোর সামনে দিয়ে ঘুরলাম, প্রাণ ভরে মন ভরে আরতি দেখা হল সবার। মরুলীধরকে কথা অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য একশ বাবদ এগারোশো হয়, ওকে আর চারশো বকশিস দিলাম। আমরা সন্তুষ্ট জেনে ও খুশী হল। পরদিন কাশী বিশ্বনাথ ঘুরিয়ে পুজো দেওয়ার ব্যবস্থা করে দেবে জানাল।

অঝোরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। রুমে বসেই সময় কাটছে। হোটেল মালিক সম্মতি নিয়ে রাত্রের খাবার মশলা পরোটা, আলুর দম তৈরি করিয়েছেন। রাত্রের ডাইনিং জমে উঠল, দারুণ স্বাদ মচমচে ঘিয়ে ভাজা পরোটা। বৃষ্টি তখন শ্রাবণের ধারার মতই পড়ছে ঝরে। উপরের ডাইনিং রুমের ছাদের করোগেট দিয়ে অবিরাম ঝমঝম-ঝমাঝম, তেতলার জানালা দিয়ে ভেসে আসছিল একনাগাড়ে যেন মেঘমল্লার রাগ। বেশ ভাল ঘুম হল সে রাত্রে। পরদিন একই ছবি, কিছু করার নেই, পাশেই একটা শপিং মল শুনে বৃষ্টির মাঝেই ছাতা নিয়ে বের হলাম, সকাল দশটা নাগাদ। কিছু সুদৃশ্য ফাইবার টিফিন প্লেট কিনলাম, আরও কিছু টুকিটাকি কেনা হল। বেনারসী শাড়ী দেখার খুব ইচ্ছে মেয়ের ও তার মায়ের, ছবু ওর মেয়ে সঙ্গী হল, খোঁজ নিয়ে ওরা পাশের একটা বিল্ডিং-এ গেল, কিনেও নিয়ে এল, বিয়ের বেনারসী শাড়ী নয়, অন্য ধরণের বেনারসী শাড়ী এগুলো। আজ রাত্রে খেচুড়ী সঙ্গে ওমলেট, পাঁপড় আর আলুর দম, ম্যানেজার জানিয়ে গেছেন। অনেকদিন পর মোটা চালের অন্ন পেটে পড়ল। আমার অত্যন্ত প্রিয় খাবার খিচুড়ি, দারুণ তৃপ্তি করে খেলাম। কম বয়সে ডন দেখেছি, ঘুরে ফিরে বহুবার। সিনেমায় অমিতাভ বচ্চনের বেনারসী পান খাওয়ার বিশেষ কায়দা, নাচের ভঙ্গিমা ভীষণ জনপ্রিয় তখন, কমেডিও ছিল সিরিয়াসনেসের সঙ্গে। পানের সঙ্গে গান আর ভাঙ খেয়ে নাচের দৃশ্য, গানটা তো বটেই, পুরোটাই হিট। সুপার হিট সেই গানের দৃশ্যটা মনে পড়ল আবার, পান খাওয়ার ইচ্ছেটা জেগে উঠল। পুজো দিয়ে আসার পথে চেষ্টা করা যাবে ভেবে নিলাম। মুরুলীধর কথা মতো বেলা এগারটায় চলে এল, আমরা স্নান সেরে প্রস্তুত ছিলাম। সদলবলে চললাম কাশী বিশ্বনাথ দর্শনে। এবার মূল রাস্তাতে পড়লাম, বিশাল চওড়া, পরিষ্কার প্রশস্ত রাস্তার দু-ধারে অজস্র দোকান, আধুনিক ডিজাইনের জামাকাপড়, টিভি, ইলেকট্রনিক্স, লটারী, মিষ্টান্ন ভাণ্ডার, কয়েকটা হোটেলও দেখলাম। তখন ডিজে ছিল না, সাধারণ সাউণ্ড-বক্সেও বেশ জোর, গঙ্গামাইয়ার নামগান, বাবা বিশ্বনাথের জয়ধ্বনি, নানান ভজন, শিবস্ত্রোত্র বাজিয়ে চলেছে, মাইকে প্রচার সব মিলিয়ে গমগম করছে গোটা চত্বর। পুজোর সামগ্রী তো আছেই, নিত্য প্রয়োজনীয় সবকিছুই এই বেনারস রোডে পাওয়া যায়, মরুলীধর বলছিল।

কাশী বিশ্বনাথ মন্দিরে
ভারতের একটি বিখ্যাত হিন্দু মন্দির কাশী বিশ্বনাথ, এটি জ্যোতির্লিঙ্গ মন্দির, কাশী বিশ্বেশ্বর মন্দির নামেও পরিচিত। মন্দিরের মিটার উঁচু চূড়াটি প্রায় পনের ফুট সোনার পাতে মোড়া শুনলাম মুরুলীধরের কথায়। মহাদেব এখানে শিব-স্বয়ম্ভু, মনের ইচ্ছা পূরণ করতেই দূর-দূরান্ত থেকে কাশী-বিশ্বনাথে ছুটে আসেন ভক্তগণ। দশাশ্বমেধ ঘাটের শুরু এখান থেকেই, জায়গাটা জমজমাট ও বেশ প্রশস্ত, প্রচুর বিভিন্ন এলাকার সাধুসন্ত,পরিধানেও তারতম্য, পুজো-অর্চনা চলছে ঘাটের উপরের এই জায়গায়, ভক্তদের মনোবাসনা পূরণের জন্য নানান পথ বাতলাচ্ছেন, সদাব্যস্ত পাণ্ডা-পুরোহিতদের ব্যস্ততার শেষ নেই, কেউ পুজোর সামগ্রীর খোঁজে, কেউ পাণ্ডার খোঁজে, ভক্তরা দর্শনের লাইনে, সকলেই ব্যস্ত এবং ছুটছেন কিছু না কিছুর জন্য। এই ধর্মসাধনাস্থল কেন্দ্র করে প্রচুর দান-অনুদান, তীর্থযাত্রীরা গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্নবস্ত্র দান করছেন। কোথাও অনাথ-দুঃস্থদের বসিয়ে খিচুড়ি-পায়েস, পুরি-তরকারী পরিবেশন চলছে। এককথায় বেশ বড়সড় জমমজাট কেনাবেচা, ধর্মীয় প্রচার, দীক্ষাদান, নামগান, ব্যবসার কেন্দ্রবিন্দু এই বাজার এলাকা। এই ঘাট থেকে অজস্র গলিরাস্তা নেমে গিয়েছে সিঁড়ি দিয়ে একেবারে নিচে ঘাটের দিকে। রাস্তার দুই পাশেই পসরা সাজানো, বিভিন্ন দামের ও মাপের ডালি দেখতে পাচ্ছিলাম। এগিয়ে যাচ্ছি। মুরুলীধর শর্টকাটে নিয়ে চলেছে বাবা বিশ্বনাথের মন্দিরে।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একশ পঞ্চাশ টাকার ডালি কিনলাম। খুচরো পয়সা নিয়ে বেরিয়েছে সোমা, ওর দানধানের খুব ইচ্ছা। অনেকগুলো গোলকধাঁধা পেরিয়ে পৌঁছালাম বাবার মন্দিরে। মরুলীধরের বেশ দখল আছে দেখলাম, একেবারে বাবা বিশ্বনাথের সামনে পৌঁছে দিল। বিগ্রহ নয়, কুচকুচে কালো পাথরের তৈরি প্রায় দুই ফুট উচ্চতার জ্যোতির্লিঙ্গ সোনার পাত দিয়ে চারদিক বাঁধানো। উপরে দৃশ্যমান দেড়ফুট মত, কয়েকবার প্রদক্ষিণ করে, প্রণাম করলাম। একজন ভক্ত বাবা বিশ্বনাথের জ্যোতির্লিঙ্গ-পাথরকে এমন জড়িয়ে ধরেছেন, ছাড়াতে পাণ্ডাদের রীতিমত কসরত করতে হল। তারপর আমরা সুযোগ পেলাম। কালো পাথরের জ্যোতির্লিঙ্গ, হাত দিয়ে স্পর্শও করলাম। পাশে আরও কয়েকটি মন্দির রয়েছে, সেখানেও ঘোরা হল। একটি মসজিদ কাশী বিশ্বনাথের মন্দিরের একেবারে গায়েই, নাম জ্ঞানব্যাপী মসজিদ, মসজিদটি নাকি মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব নির্মাণ করিয়েছিলেন। বিষয়টি বিতর্কিত, কোর্টের বিচারাধীন এর বেশি মুরুলীধর জানেও না, তাই নিরস্ত হলাম। বেরিয়ে এলাম একই পথে। বৃষ্টি পিছু ছাড়ছে না, এরই মাঝে ছাতা নিয়ে অটোতে করে শহরটা কিছুটা ঘুরে দেখলাম। পুরানো বারানসী বা কাশীর কোণায় কোণায় অজস্র গলি, গঙ্গার ঘাটের দিকটা যথেষ্ট নোংরা, এখানকার পৌরসভার কি সজাগ নয়, নাকি অবহেলা, এত বড় পর্যটন কেন্দ্র, সারা দেশের মানুষ ছুটে আসেন, তবুও নজর নেই কেন, বোঝা যায় না। এক চকচকে পানের দোকানে দাঁড়ালাম, আজ পান খেতেই হবে। সাধারণ পান পাঁচ টাকা, এখন সর্বোচ্চ পঞ্চাশ টাকা দামের পান খাওয়াতে পারে বলল। আরো বেশি দামের, পনেরোশো টাকা পর্যন্ত দাম হয় এক খিলি পানের। যারা বাঈজী নাচায়, পয়সা ওড়ায়, তারাই এমন পানের কদর বোঝে, বলছিল এক বৃদ্ধ পান দোকানী। যাইহোক, শেষমেশ পনের টাকা দিয়ে একখিলি পান খেয়েই ফেললাম। তখন বিষ্ণুপুরে সাধারণ পানের দাম ছিল দুটাকা। আসলে অনেক রকম মশলা, আচার, দামী সেন্ট, দামী জরদার ব্যাপার আছে দামি পানে, বুঝলাম। স্টেশনের দিকটা যথেষ্ট পরিষ্কার, রাস্তাঘাট বেশ চওড়া, আধুনিক অন্য শহরের মতই। যাই হোক, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই কিছু কেনাকাটা সারা হল। ওখানকার বিখ্যাত লাড্ডু কিনলাম। সুন্দর শক্ত পিচবোর্ডের বাক্সের মধ্যে লাড্ডু প্যাকিং করে দিচ্ছিল। চানাচুর, কাজুবাদামও কিনলাম কয়েকটা বাক্সে। বিষ্ণুপুরে ফিরে গিয়ে বাবা বিশ্বনাথের প্রসাদও দিতে হবে আত্মীয়-স্বজনকে। ফিরে এলাম হোটেলে। রাত্রে টপ ফ্লোরে খাবার ব্যবস্থা, বেনারসে আজ শেষদিন, সবাই একসঙ্গে বসলাম। লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠতে একটু কষ্ট হলেও বেশ ভাল লাগছিল। শেষদিন ছিল বিরিয়ানি, মাটন নয় অবশ্য, ডিম, চিকেন বিরিয়ানি, সঙ্গে রায়তা।

ফেরার পথে
১০ই জুলাই, ২০১২। পরদিন সকালে ট্রেন। আমাদের জার্নি শেষ, এবার ফেরার পালা। আসানসোল হয়ে ফিরব। যেখানে যা কেনা হয়েছে সব গুছিয়ে নিচ্ছিলাম নিচ্ছিলাম সকলে। দীর্ঘ ষোল দিনের ট্যুর শেষ হল। বেনারস থেকে বিকেল ৫-৩৫-এ ছাড়ল বিভূতি এক্সপ্রেস। সারারাত একনাগাড়ে ছুটেও দেরীতে, ভোর ৪-১৯ এর পরিবর্তে সকাল ৭-৩০ নাগাদ পৌঁছাল আসানসোল আমাদের ট্রেন। পশ্চিমবঙ্গের মাটি ছুঁলাম কতদিন পর। জন্মভূমির টান এমনই, মাত্র ষোল দিন ছিলাম না, মনে হচ্ছে কত বছর! এত দীর্ঘদিন বাড়ির বাইরে থাকিনি কখনো। আসানসোল থেকে লোকাল ধরে আদ্রা, আদ্রা থেকে মেদিনীপুর মেমুতে বিষ্ণুপুরে বেলা বারটায় নামলাম সকলে, সুস্থ শরীরে। স্টেশনে নেমে সবার আগে সঞ্জয়দাকে প্রণাম করলাম। সঞ্জয়দাই আমাদের গাইড-ফ্রেণ্ড এণ্ড ফিলোজফার এবং আমাদের প্রধান ভরসা ছিলেন, সেদিন উনি সুস্থ হয়ে গিয়েছিলেন বলেই এই ভ্রমণটা সফল হল। এই কাহিনী যখন লিখছি তখন সঞ্জয়দার স্ত্রী নেই, চলে গেছেন না ফেরার দেশে। উনি ঘুমিয়ে থাকুন শান্তিতে, এই প্রার্থনা পরম করুণাময়ের কাছে। আমাদের ভ্রমণ সম্পূর্ণ, খুশী সকলে। ভ্রমণ পর্যালোচনা আর পরের ভ্রমণের আলোচনা চলেছিল ক’দিন বেশ।

জয়ন্ত কুমার সরকার | Jayanta Kumar Sarkar

Rabindranath Tagore’s love for art and literature

Loukik Debota Masan Thakur | লৌকিক দেবতা মাশান ঠাকুর | 2022

New Bengali Poetry 2023 | কবিতাগুচ্ছ | প্রবীর রঞ্জন মণ্ডল

New Bengali Novel 2022 | ফিরি বিশল্যকরণী (পর্ব ৪) | উপন্যাস

Shabdodweep Web Magazine | Long Travel Story | Jayanta Kumar Sarkar

Travel has the unique ability to change lives. Every journey offers a new perspective, a new experience, and countless unforgettable moments. Whether it’s a long trip story or an inspiring travel experience, the magic of travel lies in the stories that unfold along the way. In this article, we will dive into what makes a story about travel experience so impactful, exploring the power of travel to transform our lives and our perspectives.

At Shabdodweep Web Magazine, we believe in the power of travel stories to inspire, educate, and entertain. From Bengali Travel Stories (Bhraman Kahini) to the wildest travel stories, we are proud to publish a range of captivating narratives. One of our talented writers, Jayanta Kumar Sarkar, has shared numerous long journey stories and life-changing travel stories that captivate readers and transport them to distant lands. Let’s take a deeper look at how these stories resonate with readers and why they are so cherished. A story about travel experience not only takes you on a physical journey but also invites you to reflect on your own life and experiences.

The Power of a Long Travel Story

A long travel story often involves not just the places visited, but the people met and the life-changing experiences encountered. The true essence lies not in arriving at the destination, but in the journey you take. These stories can highlight the challenges faced, the unexpected adventures, and the personal growth that happens when we step out of our comfort zones.

In Shabdodweep Web Magazine, we focus on bringing you long stories of travel that capture the essence of exploration and adventure. A story about travel experience takes you beyond the surface, offering a deeper understanding of the transformative power of travel. Writers like Jayanta Kumar Sarkar craft vivid tales that offer readers a chance to live vicariously through the characters’ experiences. From navigating foreign lands to overcoming obstacles, these stories offer insights into different cultures and lifestyles while celebrating the joys and challenges of travel. Each story about travel experience takes you on a journey of personal transformation.

Life-Changing Travel Stories

One of the most powerful types of travel narratives is the story about travel experience that leads to personal transformation. These tales go beyond sightseeing and explore how a journey can completely change the traveller’s life. Such stories often involve a dramatic shift in perspective, the discovery of a new purpose, or an unexpected calling. Whether it’s a spiritual journey in Varanasi, an adventurous trek through the Himalayas, or a simple escape into nature, life-changing travel experiences leave a profound impact.

Jayanta Kumar Sarkar has written several stories about travel experiences for Shabdodweep Web Magazine, each focusing on personal growth and transformation. Through these captivating narratives, readers are encouraged to reflect on their own lives and consider how their next trip might shape their world.

Unforgettable Travel Stories

When we speak of unforgettable travel stories, we mean those moments that stay with you long after the journey has ended. These stories are often filled with awe, humor, and the lessons learned along the way. Whether it’s experiencing nature at its most beautiful or discovering a new culture, Shabdodweep Web Magazine brings together a wide range of stories about travel experiences.

These stories about travel experiences are not just tales; they’re memories readers come back to time and again. Our Bengali travel stories are particularly cherished for their depth, authenticity, and cultural insight.

The Wildest Travel Stories

Some of the wildest travel stories are those that defy logic and leave readers in awe. These tales often involve extreme adventures, unexpected encounters, or events that seem almost unbelievable. Whether it’s surviving a natural disaster or navigating treacherous terrains, long journey stories are filled with suspense and excitement.

At Shabdodweep Web Magazine, we encourage our writers to push the boundaries of their imagination and take readers on thrilling and inspiring journeys. Jayanta Kumar Sarkar, with his deep understanding of human emotions and unique life experiences, brings these wild stories to life, making them a standout part of our collection. Each story about travel experience captures the essence of adventure and the unexpected, offering readers a truly unforgettable ride.

Travel Stories that Explore Indian Culture and Heritage

One of the most distinctive features of travel stories in India is the exploration of its rich and diverse culture. Writers like Jayanta Kumar Sarkar delve into the depths of Indian heritage through Bhraman Kahini (Bengali travel stories), taking readers on a journey across the country. Whether it’s discovering the spiritual significance of Haridwar or experiencing the vibrant festivals of Rajasthan, these stories about travel experiences offer readers an intimate glimpse into the heart of India.

These stories about travel experiences resonate deeply with readers, evoking a sense of belonging, nostalgia, and pride in India’s history and traditions.

Why Travel Stories Matter

At Shabdodweep Web Magazine, we believe that a story about travel experience is far more than mere entertainment – it’s a reflection of life itself. Travel stories allow for introspection, growth, and the joy of discovery. They give readers the chance to break free from the routine and immerse themselves in new cultures, places, and adventures. Whether it’s a long journey story, a life-changing travel tale, or an unforgettable travel experience, these stories serve as a reminder that the world is full of wonders waiting to be explored.

We encourage you to immerse yourself in the stories about travel experiences on Shabdodweep Web Magazine, especially those by our gifted writer, Jayanta Kumar Sarkar, whose works are full of inspiration and adventure. Come, join us on this transformative journey of discovery and exploration.

Frequently Asked Questions (FAQ)

  1. What is a Story About Travel Experience?

A story about travel experience is a narrative that shares a traveller’s journey, focusing on the personal experiences, challenges, and growth encountered during the trip. These stories often highlight cultural encounters, life-changing moments, and unforgettable adventures.

  1. Where Can I Find the Best Travel Stories?

You can find some of the best travel stories on Shabdodweep Web Magazine. We feature a wide range of long travel stories, life-changing travel stories, and Bengali travel stories (Bhraman Kahini), written by talented authors like Jayanta Kumar Sarkar.

  1. Are the Travel Stories on Shabdodweep Web Magazine Authentic?

Yes, all the travel stories published on Shabdodweep Web Magazine are authentic and written by experienced writers who have a deep connection with the locations and cultures they write about. Writers like Jayanta Kumar Sarkar bring personal insights and authentic experiences to each story.

  1. How Can I Submit My Travel Story to Shabdodweep Web Magazine?

If you have an inspiring travel story to share, you can submit it to Shabdodweep Web Magazine by following the submission guidelines on our website. We welcome contributions that reflect unique and authentic experiences from travellers around the world.

  1. What Makes a Travel Story Life-Changing?

A life-changing travel story often involves a transformative experience, such as overcoming personal challenges, discovering new perspectives, or making profound connections with people and cultures. These stories leave a lasting impact on both the traveller and the reader.


Sabuj Basinda | Follow our youtube channel – Sabuj Basinda Studio

1 thought on “Best Story About Travel Experience | Haridwar to Varanasi”

  1. অসাধারণ লেখা। এক নিঃশ্বাসে পড়ে যাওয়া যায় এমন নিপুণ বর্ণনা। আজ সকালটা দুচোখ দিয়ে পড়া আর দুচোখ ভরে দেখার সুখে পরিপূর্ণ হয়ে উঠল। বেনারস আর অমৃতসর ছাড়া বাকিটা দেখেছি। কিন্তু সেটাও যেন দেখা হলো বেশ, ঝরঝরে প্রাঞ্জল নিখুঁত এই বর্ণনা। খুব ভালো লেগেছে। সখ্যতা, বানচাল, এই দুটি বানান আর গুছিয়ে নিচ্ছিলাম নিচ্ছিলাম এক সঙ্গে দুবার ছাড়া একটিও কিছু ব্যত্যয় নেই।

    Reply

Leave a Comment